বিকট
(১)
Disk Error. Please reboot or press any key to continue.
কম্পিউটারের মনিটরে কালো আবহে নিষ্ঠুর কয়েকটি শব্দ ববির বুকে হিমভয়ের বৃক্ষ বুনে দিয়ে শেকড় ছড়িয়ে দিল অভ্যন্তরীন সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। পাঁচ বছরের বেকারত্ব জীবনে বহু তদবীর করেও যে কাজটি হয়নি, মাসছয়েক আগে হঠাৎ স্বাভাবিক পদ্ধতিতেই তা হয়ে গিয়েছিলো, অপ্রত্যাশিত কর্মযোগে গতিময় হয়ে উঠেছিলো তার স্থবির জীবন। কবে যেন কোন একটা এনজিওর সার্কুলার দেখে সম্ভবত তার তিনশতম সিভিটা পাঠিয়েছিল তাদের দপ্তরে, এবং কী অবাক ব্যাপার, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সেখান থেকে ফোন এলো, এরপর ইন্টারভিউ দিয়ে একটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারও পেয়ে গেল! বেতনের অংকটাও লুকিয়ে রাখার মত না, ভদ্রসমাজে বলা যায়। মেসভাড়া, সিগারেটের ব্র্যা ন্ড পাল্টানোর বিলাসিতা, সেলফোনে বাড়তি কিছু টাকা ভরার পরে বাড়িতেও হাজারখানেক পাঠানো যায়। আরো একটা বড় ব্যাপার হল, বেশিরভাগ কাজই অন্তর্জাল সম্পর্কিত হওয়াতে সে সারাক্ষণ সামাজিক যোগাযোগ রক্ষাকারী ওয়েবসাইটে দৃশ্যমান থেকে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগও রাখতে পারে কাজের ফাঁকে।
বন্ধুরা বেশ সমীহই করে তাকে এখন, এমন এক চাকরী বগলদাবা করেছে, যাতে সর্বক্ষণীক ইন্টারনেট কানেকশন আছে, না জানি কি উচ্চস্তরের ব্যাপার স্যাপার! ববি জানায় না ব্যাপারটা সেরকম কিছুই না এবং জানে তেমন হবার সম্ভাবনাও নেই, তবে ঠাঁট বজায় রাখার খাতিরে সেও ইদানিং লাঞ্চের সময় কলা আর পাউরুটি খেতে খেতে অন্তর্জালের বন্ধুদের জানিয়ে দেয়, "At office. Heavy load of work. feeling tired".
-এই যে ববি ভাই আমাদের ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল-২০১৪ এর একটা প্রিন্টআউট দেন তো। কুইক! স্যার বলছে জরুরী দরকার।
পাশের ডেস্ক থেকে সহকর্মী ফারুক তাগাদা দেয়।
-এখন হবে না ভাই। কম্পিউটারে সমস্যা হইছে।
স্ক্রিনে দৃশ্যমান নিষ্ঠুর শব্দগুলোর দিকে তাকিয়ে ববি আমসিমুখে জানায়।
-ক্যান, কী হইছে? অপারেটিং সিস্টেম ক্রাশ?
-মনে হয়!
ঢোঁক গিলে বলে ববি। যদিও তার আশঙ্কা আরো খারাপ কিছুর।
-ঝামেলা হয়ে গেল। সমস্যা নাই, ব্যাক আপ রাখসেন তো?
-হ্যাঁ সেটা নিয়মিতই করি।
সি ড্রাইভ আর ডেস্কটপের সব জিনিসপত্র এফ ড্রাইভে রাইখা দিসি।
-তাইলে আর কী! উইন্ডোজটা সেটআপ দিয়া ফালান। ঘন্টাখানেক লাগবো তো? স্যাররে আমি ম্যানেজ কইরা নিমু ঐ সময়টা। আরে আপনি এত টেনশন নিয়েন না তো! বি ইজি।
শুকনোমুখে হেসে ববি ফারুক সাহেবের এই আন্তরিকতার প্রত্যুত্তর দিলো।
ইজি থাকার কোন আভাস অবশ্য সামনে দেখা যাচ্ছে না। হার্ডডিস্কটা বোধ হয় গেছে। অপারেটিং সিস্টেমের সিডি প্রবেশ করানোর পরে অসহায় চাকতিটির গোয়ার্তুমি এবং সবশেষে অক্ষমতা প্রকাশ এই ব্যাপারে নিশ্চয়তা প্রদান করলো ববিকে অনিঃশেষ অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়ে। নতুন হার্ডডিস্ক এত দ্রুত ক্র্যাশ করবে সে ভাবতেও পারেনি। তাই যাবতীয় ফাইলপত্তর সে সি ড্রাইভ থেকে সরিয়েই নিশ্চিত ছিল।
আলসেমি করে ডিভিডি রাইট করে ব্যাক আপ রাখেনি। পেন ড্রাইভে রাখলেও হত!
-ববি ভাই, একটু ডিস্টাপ করব।
বিনীত স্বরে পিয়ন দেলোয়ার তার ঘরে প্রবেশের অনুমতি চায়।
-কি ব্যাপার দেলোয়ার ভাই?
-এই ইন্টারনেটটায় একটু যায়া দেখেনতো এসএসসির রেজাল্ট দিছে কী না। আমার মাইয়াডা বড় পেরেশান হইয়া আছে।
আসগর তার হাতে ধরা কাগজটা ববির কাছে দিয়ে অনুরোধ করে।
-আজকে হবে নারে ভাই। কম্পিউটার নষ্ট হয়ে গেছে।
-ওহ তাইলে আর কী করা!
কী করা যায় ভেবে কূল পাচ্ছেনা ববি। গত ছয়মাসে সে মন দিয়ে কাজ করেছে।
ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে টাইপ করতে করতে হাত এবং পিঠ ব্যথা হয়ে গেছে। এতদিনের পরিশ্রম সব জলে গেল! শুধু তার পরিশ্রম বৃথা যাচ্ছে বলে না, সবকিছু আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে গিয়ে তাকে যদি অনেকগুন ধকল পোহাতে হয়, সে তাতেও রাজী আছে। কিন্তু এই কদিনে কাজ বিঘ্নিত হবে চরমভাবে। ববির ছন্নছাড়া জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসা এই চাকুরী এবং সংশ্লিষ্ট ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের প্রতি তার একটা ভৃত্যসুলভ আনুগত্য এবং নীরব কৃতজ্ঞতা আছে। তাদের উচ্চস্তরের কর্মকান্ড, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, বিদেশ গমন প্রভৃতির সাথে নিজের সংযোগ আছে ভেবে সে আত্মশ্লাঘা অনুভব করতো।
এখন তার অদূরদর্শীতার কারণে যদি তাদের কাজেকর্মে ক্ষতি হয়, তাহলে সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। পরবর্তী এক ঘন্টা ববির কাটলো কম্পিউটারে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ওপরে অসফল সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে এবং পরীক্ষায় ব্যর্থ হবার পরিণামে গোঁয়ার যন্ত্রগুলোকে তার আক্রোশের মুখোমুখি করে।
বেলা তিনটার সময় ববির ডাক পড়লো সিইও'র কক্ষে। সিইও ভদ্রলোক অন্যান্য প্রাইভেট কোম্পানীর মত রাশভারী বা পায়াভারী না। তার আচরণে অভাবনীয় কোমলতা এবং আশকারা ববিকে এক ধরণের নির্বোধ বিনয়ে আচ্ছাদিত করে তোলে দিনদিন।
-কি খবর ববি? কেমন চলছে তোমার কাজ?
মূল প্রসঙ্গে যাবার আগে কুশল বিনিময় করাটা ভদ্রলোকের একটি বিশেষ সদগুন।
-জ্বী স্যার। এইতো ভালোই আছি!
-কম্পিউটারে নাকি সমস্যা হয়েছে?
-একটু আর কি... মানে... জ্বী স্যার!
-কদ্দিন লাগবে ঠিক করতে?
-ফোন দিয়েছি দোকানে। এখনই চলে আসবে সার্ভিসিং সেন্টারের লোক। দেখি কী বলে...
-ডাটাগুলোর ব্যাকআপ রেখেছে তো?
*
সার্ভিস সেন্টার থেকে কমবয়সী কিন্তু বেশ চটপটে একটা ছেলে এসে মুহূর্তেই যন্ত্রটাকে স্ক্রু ড্রাইভারের প্যাচে ফেলে খন্ড খন্ড করে ফেললো।
তার কর্ম তৎপরতা ববিকে বেশ আশান্বিত করে তোলে। এই গুণধর ছেলেটাকে দিয়ে হবে! কিন্তু আশা নামক বায়বীয় পদার্থটি দৃষ্টিসীমার বাইরে, দূর গগনে উড়ে যেতে সদা তৎপর থাকে বরাবরই।
-হার্ড ডিস্ক চেঞ্জ করতে হবে।
ববির আশঙ্কাটাই শেষতক সত্যি হল। মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর আত্মীয় যেমন কাতর কন্ঠে ডাক্তারের কাছে আশার বাণী শুনতে চায়, ববি ঠিক তেমন কন্ঠেই ছেলেটির কাছে অনুনয় ভরে জানতে চাইলো,
-কিছুই কী করার উপায় নেই?
-নাহ।
নতুন হার্ডডিস্ক লাগবে। পিয়নটারে দিয়া কিনা আনান। কাছেই তো এলিফ্যান্ট রোড। আমি একটা দোকানের কথা বলতাছি, ওখানে যায়া আমার কথা বললে মার্কেট প্রাইসের চেয়ে কম দামে পাবেন। জলদি করেন, নতুন হার্ডডিস্ক লাগায়া সবকিছু সেটআপ দিয়া বিকালের মধ্যেই ঠিক কইরা দিমু।
-ডাটা রিকভারির কোন উপায় নাই?
-তা করা যাবে। তবে তাইলে আজকের মধ্যে হবে না।
-আরে আজকের মধ্যে লাগবে এমন তো কোন কথা নাই! কয়দিন লাগবে?
-তিন-চারদিন তো লাগবেই।
-আপনি সময় নেন। তবে ডাটা সব রিকভার করে দিতে হবে।
আমি রিকুইজিশন স্লিপ লিখে দিচ্ছি। এক্ষুণি দেলোয়ার একাউন্টস থেকে টাকা নিয়ে হার্ডডিস্ক কিনে আনবে নতুন। তবে কাজটা ঠিকমত কইরেন ভাই। ডাটাগুলা খুবই দরকার।
*
-হ্যালো! কী রে ভাই আপনি ফোন ধরেন না কেন? ডাটা রিকভারির কতদূর কী করলেন?
-ফরম্যাট নিচ্ছেনা হার্ডডিস্ক।
আমি সেই সকাল থেকে চেষ্টা করতেছি।
-হবে না?
-আমি আপনাকে পরে ফোন দিব। এখন রাখি।
অভদ্রের মত লাইনটা কেটে দিল ছোকড়া।
গত কয়েকদিন ববির সময় কেটেছে ব্যাপক উদ্বিগ্নতায়।
হার্ডডিস্কে শুধু যে তার কাজের স্মৃতি তা না, এর ওর কাছ থেকে সংগ্রহ করা গান, সিনেমা, নাটক, মজার ভিডিও ক্লিপ, ববি কাজের অবসরে এসব দেখে বিনোদিত হত। তার তো বাসায় কম্পিউটার নেই, তাই এটাই ভরসা ছিলো। থান ইটের সমান একটা শক্ত চাকতি তার জীবনের সাথে এভাবে জড়িয়ে যাবে সে ভাবতেই পারে নি। ডাটাগুলো যদি রিকভার নাই করা যায় তবে আবার হার্ডকপি দেখে দেখে সফটকপি বানানো সবকিছুর, একদম নাভিঃশ্বাস উঠে যাবে। গাধার মত খাটতে হবে আগামী অন্তত এক সপ্তাহ, ছুটির দিন সহ।
সিইওর শান্ত সমাহিত মুখের রেখাগুলো কঠোর হবার আগেই সেরে ফেলতে হবে কাজ। তবে এখনও পুরোপুরি আশা ছাড়েনি ববি। ছোকড়া তো চেষ্টা করে যাচ্ছেই। হয়তোবা কোন একটা উপায় বের করে ফেলবে। পুনরুদ্ধার করা যাবে সকল তথ্য।
কাঁপা কাঁপা হাতে ববি আবার ডায়াল করে। বুকের ভেতর অনিশ্চয়তা আর ভয়ের ভয়ারিজম। তারা পারভার্টের মত দূর থেকে দেখছে ববির বুকের ভেতরের নগ্ন কাঁপন। সময় বুঝে ঠিক ঠিক ঝাঁপিয়ে পড়বে।
-হ্যালো! কি অবস্থা হার্ডডিস্কের? ডাটা রিকভার করা গেছে?
-না ভাই।
পারা গেলো না। হার্ডডিস্ক ভাঙতে হবে। তারপরেও ম্যালা ঝামেলা। আর অনেক এক্সপেনসিভ।
-এক্সপেনসিভ মানে কত টাকা লাগবে?
-মিনিমাম দশ হাজার তো লাগবেই! তারপরেও পাওয়া যাবে কী না শিওর না।
এত বাজেভাবে ড্যামেজড হইসে।
ববি হিসেব কষে দেখল, তার অসচেতনতার খেসারত স্বরূপ কোম্পানী এত টাকা ব্যয় করতে মোটেও রাজী হবে না। বা হলেও তার বেতন থেকে কেটে রাখবে। এমন কী ক্ষেপে গিয়ে তাকে ছাটাইও করে দিতে পারে। দরকার নেই ডাটা রিকভারির।
সে জানপ্রাণ দিয়ে খেটে সমস্ত ডাটা নতুনভাবে তৈরি করবে আবার। মানুষ চাইলে কী না পারে!
-ক্ষ্যাতা পুড়ি ডাটা রিকভারির!
খিস্তি প্রয়োগের মাধ্যমে স্বস্তি আনয়নের চেষ্টা চালায় ববি। তবে খিস্তিতে উপশম না হওয়াতে বাস্তববাদী হয়ে শেষ চেষ্টা হিসেবে ব্যাপারটা সরেজমিনে যাচাই করে আসার সিদ্ধান্ত নেয় সে।
(২)
তার মনে হচ্ছে যেন সে হাজার-অযুত-লক্ষ-কোটি বছর ধরে শুধু বেঁচে আছে, বেঁচেই আছে। জীবন, মৃত্যু, সময়, চেতনা সবকিছু জট পাঁকিয়ে আছে এখানে।
মস্তিষ্কে রক্ষিত স্মৃতিগুলো ঝাপসা, এলোমেলো, অর্থহীন এবং বিমূর্ত হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কোন এক উন্মাদ শিল্পী যেন তার মনের ভেতর বিশাল একটা ইজেল বসিয়ে এঁকে যাচ্ছে ইচ্ছেমত। মুছে দিচ্ছে রঙ, অনুভূতি, ব্যথা, বেদনা, আকাঙ্খা, কামনা। তুলির খেয়ালী আঁচড়ে পাল্টে দিচ্ছে সব। অর্থহীন এবং অবর্ণনীয় একঘেয়েমীতে মারা যেতে ইচ্ছে করছে নাকি বেঁচে উঠতে, তাও সে জানে না।
এখানে বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার অনুভূতিগুলো গা জড়াজড়ি করে তুমুল বেগে নাচতে থাকে, তাদের মুখ দেখা যায়না। চেনা যায়না কোনটা জীবন, কোনটা মৃত্যু। মাঝেমধ্যে চেতনার জলাশয়ে ঢিল ছোড়ে কে যেন। তরঙ্গায়িত হয় সারা শরীর। এইটুকু যন্ত্রণাই তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন এখন।
এই যন্ত্রণাটুকুই মাঝেমধ্যে তাকে জানিয়ে দেয়, সে বেঁচে আছে। জানিয়ে দেয় মনের স্লেটে চক দিয়ে অঙ্কিত শব্দাবলী দ্রুত ডাস্টার দিয়ে মুছে দিচ্ছে কোন এক দুরভিসন্ধিকারী।
-ওর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু?
-নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। বেঁচে যাবে হয়তো, তবে তার আগের জীবনের কোন স্মৃতি থাকবে না। জড়ভরত হয়ে কাটাতে হবে বাকিটা জীবন।
*
-ডাটা রিকভারির সম্ভাবনা কতটুকু?
নিজের রুমে অপ্রসন্ন মুখে বসে আছেন সিইও মহাশয়। ববি ছেলেটার ওপর প্রচন্ড বিরক্ত তিনি। হার্ডডিস্ক ক্র্যাছশ করল, সে কোন ব্যাকআপ রাখেনি। কতগুলো ডাটা মুছে গেল! রিকভার করতে নাকি অনেক টাকা লাগবে। কোম্পানির অবস্থা ভালো যাচ্ছে না।
এই মুহূর্তে এতগুলো টাকা খরচ করা, তাও আবার এমন একটা ক্ষেত্রে, যেখানে বিনিয়োগের সুফল নিশ্চিত না...সার্ভিসিংয়ের ছেলেটাও কিছু বলতে পারছে না নিশ্চিতভাবে।
-শিওর না স্যার। হার্ডডিস্ক ভেঙে দেখতে হবে। তারপরেও পাওয়া যাবে কী না বুঝতে পারছি না। আর খরচের কথাটা তো বললামই।
এর চেয়ে নতুন হার্ডডিস্ক কিনে হার্ডকপি থেকে সফ্টকপি বানানোই ভালো হবে।
এতসব ঝক্কি ঝামেলার ভার কে নেবে? নতুন ছেলেটা এসেছে কী যেন নাম...ববি। ওকে দিয়েই করাতে হবে। সিইও সাহেব ববিকে জরুরী তলব করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন।
-এই দেলোয়ার! ববিকে পাঠাওতো একটু।
-স্যার ববি সাহেব তো একসিডেন করসে। হাসপাতালে ভর্তি কয়েকদিন ধইরা।
-তাই নাকি? কেন? কীভাবে?
সবকিছু শোনার পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন,
-তো রিকভার করতে পারবে?
*
"ববি, আমি কে তোমার জানার দরকার নেই। তোমার অধিকাংশ নিউরন সেল মরে গেছে দলবেঁধে। তোমার মনটা এখন আস্ত একটা মাইনফিল্ড।
বিশাল এক ভস্মকীট। তোমাতে প্রবেশ করে দগ্ধ হয়, ভস্মীভূত হয় পুরোনো স্মৃতিরা। ব্ল্যাকহোলের মত তীব্র আকর্ষণে গ্রাস করে নাও আবেগ, ভালোবাসা, স্মৃতি। হয়তোবা আমি তোমার খুব কাছের কেউ, রক্ত সম্পর্কের। হয়তোবা বন্ধু-বান্ধব বা সহকর্মী।
তোমার কি কোন প্রেমিকা ছিল? তোমার কি কাউকে ভালো লাগতো? এসব প্রশ্নের উত্তরে মস্তিষ্কের কোষগুলোতে শক্তিশালী সার্চ ইঞ্জিন দিয়ে চষে ফেলেও কিছু পাওনা তুমি। অতি স্বল্পমাত্রার উদ্দীপনায় প্রশ্নটা ধরে নিতেই ব্যর্থ হও শোচনীয়ভাবে, উত্তর দেবে কী! মনীষীরা স্মৃতির অবিনশ্বরতা সম্পর্কে অনেক বড় বড় বুলি ছেড়েছেন। তার কিছু হয়তো তুমি পড়েছিলে। মানুষ মারা যায়, ক্ষয়ে যায়, কিন্তু রয়ে যায় স্মৃতি। কোথায় তোমার স্মৃতি ববি? তোমার স্মৃতি ছড়িয়ে থাকবে এখানে, সেখানে, ইথারে, বেতারে।
কেউ পড়ে থাকা স্মৃতিখন্ড দিয়ে প্রজাপতি বানাবে কেউ বানাবে পাপোষ, আর অধিকাংশই অবলীলায় অগ্রাহ্য করে যাবে।
আমি তোমার সম্মিলিত স্মৃতিগোষ্ঠীর দুর্লভ সুজন।
একবার চেষ্টা করে দেখবে ববি, ঘ্রাণ পাওয়া যায় কী না? শীতের সকালে মায়ের বুক ঘেষে শুয়ে থাকার ঘ্রাণ? কুয়াশার ঠোঙায় করে নিয়ে আসা তরতাজা এক টুকরো সকালের ঘ্রাণ? তা কী আমি!
তুমি যে দুর্ভেদ্য অপস্মৃতিবলয় তৈরি করেছ, তা কী করে ভেদ করি আমি?
দেখতে কি পাও ববি? এ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটারে মুদ্রিত তোমার নাম। বন্ধুদের সাথে উদযাপনের আনন্দ। ভাঙা গ্লাস, অসংখ্য সিগারেটের বাট।
স্টেডিয়ামে গিয়ে তোমার পাশে উত্তেজনার মুহূর্তগুলোতে সঙ্গ যুগিয়েছে, সে কী আমি! সে কী আমি!
তোমার কোষ থেকেই আমার জন্ম, অথচ কী ভীষণ মৌন তিরস্কারে তিরোহিত করলে আমায়! এখন আমি কী করে ফিরে আসি তোমাতে?
ববি, তোমাকে দেখতে ফারুক সাহেব আসছেন। তোমাদের অফিসের একাউন্টেন্ট। মজার ব্যাপার কী জানো? তার ব্যাগের ভেতর নষ্ট হার্ডডিস্কটা রয়েছে। কি করে জানলাম? তোমার বিশাল স্মৃতিমন্ডলীর অতি ক্ষুদ্র এক উপগ্রহ হিসেবে ফারুক সাহেবও তো আছেন, হয়তোবা! সম্ভাব্যতা এবং যুক্তিবর্তনী এখনও অদৃশ্যভাবে ক্রিয়াশীল। ডাটা রিকভারির চেষ্টা এখনও অব্যাহত আছে।
সে এলে পরে আমি কি বলব হার্ডডিস্কটাকে তোমার বিছানার পাশে রেখে দিতে? সত্যি কথা বলতে কি, এমন সহচর তুমি আর পাবেনা। তোমাদের দুজনের মেমরিতেই ব্যাড সেক্টরের আগ্রাসন। রিকভারির চেষ্টা চলছে। অত্যন্ত ব্যয়বহুল, এবং ধীর এক প্রক্রিয়া। মানুষজন আর কতদিন সহ্য করবে বল? তোমাদের দুজনের পরিণতিই তো এক হতে যাচ্ছে।
আমি শুধু দেখে যাই। শুধু দেখে যাই। কিচ্ছু করার ক্ষমতা নাই। তোমাকে চুপিচুপি এসব বলার পথও রুদ্ধ হয়ে আসছে...
*
-হার্ডডিস্কটা ঠিক করা গেলো না তাহলে?
-না স্যার! এখন কী করব ওটা দিয়ে?
-যা ইচ্ছা কর! ফেলে দাও। এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে আমাকে আর বিরক্ত করোনা তো!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।