আবুল কালাম আজাদ চট্টগ্রামের একটি স্কুলে শিৰকতা করতেন। স্কুলে চাকরি করে তিনি বেশ স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করছিলেন। মাস পাঁচেক আগে হঠাৎ করে স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিলেন আজাদ। এলাকায় খবর রটে গেলো আজাদ এখন আগের চেয়ে ভালো টাকা আয় করেন। তিনি এখন ‘ইউনিপে টু ইউ’-এ কাজ করেন।
এলাকার বড় বাজারে আজাদ খুলে বসেন অফিস। হাতে ল্যাপটপ। অফিসে দিনরাত কাজ, মানুষের লম্বা লাইন।
কেবল একজন আজাদ নন, এমন অনেক তরুণ-তরুণী, পুরুষ-মহিলা এমনকি বয়স্করাও অতি লাভের আশায় ছুটছেন ইউনিপে টু ইউ-এর দিকে। কারণ ইউনিপে টু ইউ-এর কর্মীরা বলছেন, সেখানে বিনিয়োগ করলে ১০ মাসে পাওয়া যাচ্ছে দ্বিগুণ টাকা।
মাসে মাসে এ টাকা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ডলারে পরিশোধ করা হবে।
চট্টগ্রামসহ দেশে এখন ইউনিপে টু ইউ-এর মতো একাধিক মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি কাজ করছে। এসবের মধ্যে স্পিক এশিয়া, টিভিআই ও লিজেন্ড ভ্যাঞ্জার উলেৱখযোগ্য। দ্বিগুণ লাভের আশায় প্রচুর মানুষ লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করছে এসব এমএলএম
কোম্পানিতে। চট্টগ্রাম এবং সিলেটে এসব কোম্পানির প্রসার বেশি।
দুই অঞ্চলের প্রবাসীরা কোম্পানিগুলোতে টাকা রাখছেন। অনেককে স্বর্ণালঙ্কার বন্ধক রেখেও টাকা রাখতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত সোমবার শেয়ারবাজারে বিপর্যয়ের পর এসব এমএলএম কোম্পানির বিষয়টি সামনে চলে আসে। অর্থমন্ত্রী ইউনিপে টু ইউ-এর নাম উলেৱখ করে বক্তব্য দেন। তিনি বলেছেন, চট্টগ্রামের শেয়ারবাজারে তারা ঢুকে ১০০ টাকার বদলে ২০০ টাকার অফার দেয়।
তাদের সবাইকে ধরতে হবে। এর আগে রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলারে এমএলএম ব্যবসায় কিছু প্রতিষ্ঠান উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে প্রতারণামূলকভাবে অর্থ সংগ্রহ করছে বলে সতর্ক করে দেয়। বলা হয়, বিদেশের স্বর্ণের বাজার বা মুদ্রাবাজারে বিনিয়োগের নামে কিছু প্রতিষ্ঠান মাসে দশ শতাংশেরও বেশি মুনাফার আশ্বাস দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, বেশ কয়েকটি এমএলএম কোম্পানির কার্যক্রম স্থগিত করা হলেও তারা অন্য নামে একই কাজ চালাচ্ছে।
এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী এসব প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বলেছেন, তাদের ব্যাপারে বেশ কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করতে একটি খসড়া নীতিমালা প্রস্তুত করে তার ওপর মতামত সংগ্রহ করা হচ্ছে। শিগগির খসড়াটি চূড়ান্ত করা হবে। নীতিমালার লৰ্য হলো, মানুষ যাতে প্রতারিত না হন।
এসব কারণে গত সোমবার এবং মঙ্গলবার সারাদিন ইউনিপে টু ইউ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এমন গুঞ্জন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কে এমএলএম কোম্পানির বিভিন্ন অফিসে ধরনা দেন। ইউনিপে টু ইউ-এর কর্তাব্যক্তিরা জানান, অন্যদিনের তুলনায় গতকাল বিনিয়োগকারীর সংখ্যা একবারে কমে গেছে। সেখানে বিনিয়োগের উদ্যোগ নেয়া লোকজন থমকে গেছে। তারা দেখছেন সামনে কী হয়।
অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
প্রশ্ন উঠেছে, ইউনিপে টু ইউ বা এ ধরনের এমএলএম কোম্পানির কারণে শেয়ারবাজারে ধস নামছে।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, শেয়ারবাজারে গত কয়েকদিন ধরে যে ধস অব্যাহত আছে, এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম হলো গুজব এবং অতি মুনাফার লোভে বিনিয়োগকারীদের ইউনিপে টু ইউসহ এ ধরনের এমএলএম কোম্পানির দিকে ঝুঁকে পড়া। শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলে সাধারণ লোকজন এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগের ফলে বাজারে তারল্য সংকট দেখা দেয়। এর প্রভাবে শেয়ারবাজারে নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়।
তিনি বলেন, শেয়ারবাজারের অন্তত একটি ঠিকানা আছে। সময়ের ব্যবধানে বাজার আবার চাঙ্গা হওয়ার অনেক সম্ভাবনা আছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, এমএলএম কোম্পানিগুলোর যে ডিজিটাল ঠিকানা আছে, হঠাৎ করে একদিন তা উধাও হয়ে গেলে এতোগুলো বিনিয়োগকারীর কী হবে, কে নেবে তাদের দায়দায়িত্ব।
এসব অভিযোগ ফালতু বলে মন্তব্য করে ইউনি পে টু ইউ বাংলাদেশের আইন উপদেষ্টা সরোয়ার আলম ভোরের কাগজকে বলেন, অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজারের দরপতনের দায়ভার ইউনি পে টু ইউ-এর ওপর চাপাতে চাচ্ছেন। এটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো।
ইউনিপে টু ইউ-এর একটি অফিসের ইনচার্জ আবুল কালাম আজাদ বলেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হাজার কোটি টাকা। সে তুলনায় ইউনিপে টু ইউ কিছুই না। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ইউনি পে টু ইউ বন্ধ হয়নি; কিন্তু আজ আবার শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে কিভাবে।
ইউনি পে টু ইউ-এর আইন উপদেষ্টা সারোয়ার আলম ভোরের কাগজকে জানান, গত বছরের এপ্রিল মাসে ইউনি পে টু ইউ-এর প্রায় শতাধিক ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করা হয়। এটা নিয়ে তারা রিট করে।
আগামী সপ্তাহে এর শুনানির দিন রয়েছে।
জানা যায়, চট্টগ্রামের বিভিন্ন দামি হোটেলে বিনিয়োগকারীদের জন্য এ ধরনের কোম্পানির পার্টি দেয়া ছাড়াও একটু উন্নত রেস্টুরেন্টে গেলেই চোখে পড়বে তাদের তৎপরতা। রেস্টুরেন্টে ল্যাপটপ খুলে চলছে কার্যক্রম, তাদের ভাষায় পিন নম্বর আদান-প্রদান।
জানা যায়, বছর দেড়েক আগে দেশে ইউনিপে টু ইউ তাদের কার্যক্রম শুরু করে। বাংলাদেশে বলা হচ্ছে, এটি একটি মালয়েশিয়ান কোম্পানি।
বিশ্বের ৮টি দেশে চলছে এ কোম্পানির কার্যক্রম। ইউনিপে টু ইউ-এর ওয়েবসাইট িি.িঁহরঢ়ধু২ঁ.পড়স-এ গিয়ে দেখা যায়, এটি একটি স্বর্ণ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান।
জানা যায়, ইউনিপে টু ইউ-এর মতো একই রকমের সব এমএলএম কোম্পানির ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীর একাউন্টে ডলারের পিন নম্বর দেয়া হয়। ওই পিন নম্বরটি বিক্রি করে ডলার নগদ করতে হয়।
যে কেউ ইচ্ছা করলে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে পারেন ভিন্ন ভিন্ন একাউন্ট খুলে।
জানা যায়, ইউনিপে টু ইউতে সর্বন্বি ২১ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে ১০ মাসে দ্বিগুণ টাকা দেয়া হবে বলে প্রচারণা আছে। স্পিক এশিয়ায় সর্বন্বি ১৬ হাজার ৫০০ টাকা, টিভিআইতে সর্বন্বি ২১ হাজার ৫০০ টাকা এবং লিজেন্ড ভ্যাঞ্জারে সর্বন্বি ৮ হাজার ৫০০ টাকা বিনিয়োগ করা যায়।
এদিকে ওয়েবসাইটে ইউনিপে টু ইউ স্বর্ণ ব্যবসা করছে বলা হলেও তাদের আইন উপদেষ্টা সরোয়ার বলেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, এটি মালয়েশিয়ার ওয়েবসাইট।
বাংলাদেশের কোম্পানি তাদের সাইটটি কেবল ব্যবহার করছে। তিনি দাবি করেন, ইউনপে টু ইউ স্বর্ণ ব্যবসায় জড়িত নয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউনিপে টু ইউ-এর এক কর্মকর্তা জানান, ইউনিপে টু ইউ বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ টাকা যায় স্বর্ণ ব্যবসায়।
গতকাল চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট, জিইসি মোড়, রাউজান, হাটহাজরীসহ বিভিন্ন স্থানে এমএলএম কোম্পানির কর্মীদের আতঙ্কিত অবস্থায় দেখা গেছে।
কয়েকটি অফিসে গিয়ে দেখা গেছে, ধীরগতিতে তাদের কার্যক্রম চলছে।
মোহছেনা বেগম নামের রাউজানের এক ছাত্রী জানান, তিনি লৰাধিক টাকা বিনিয়োগ করেছেন। দ্বিগুণ লাভ পাওয়া যাবে তাই ইউনিপে টু ইউতে বিনিয়োগ করেছেন বলে জানান তিনি। এখন এটি বন্ধ করে দেয়া হতে পারে শুনে তিনি ছুটে এসেছেন অফিসে।
নগরীর জিইসি মোড়ের ইউনিপে টু ইউ-এর অফিসের সাইফুল ইসলাম জানান, সরকার যদি এটি এখন বন্ধ করে দেয় তাহলে লাখ লাখ মানুষের টাকা খোয়া যাবে।
তাই উচিত হবে এটিকে একটি নীতিমালায় আনা, যাতে সাধারণ মানুষের ৰতি না হয়।
যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ৭০টি এমএলএম কোম্পানি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে জানানো হয়, দুর্নীতি দমন কমিশন এ রকম কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। বেশ কয়েকটি এমএলএম প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বাংলাদেশ ব্যাংক স্থগিত করেছে। এরপরও তারা অন্য নামে কার্যক্রম চালাচ্ছে।
উলেৱখ্য, এমএলএম কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনার জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে ২০১০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় নীতিমালা তৈরির জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ২৩ সেপ্টেম্বর খসড়া নীতিমালা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করলেও এখন পর্যন্ত তা চূড়ান্ত হয়নি।
View this link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।