আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার প্রতিদিন

,,,কুয়াশার আড়ালে লুকানো ঘটনা কুয়াশার চাদরে জড়ানো সকালের মোহনীয় রূপের মত নিস্পাপ, নিস্কলঙ্ক, নির্মোহ নয়,,,

ক্লাস শুরু সেই সকাল ৮টায়। কি যে এক ভার্সিটিতে পড়ি! সারাদিনে কোন ক্লাস থাক আর না থাক কিন্তু সকাল ৮টার ক্লাসের কোন মিস্ নাই। কি আর করা। প্রতিদিনই সকাল ৬টায় উঠি। না, না, ভুল বললাম।

আমি উঠি না। আসলে ৬টায় উঠে আমার আম্মু। আর এরপর আমাকে নানা কায়দায় উঠানো হয়। সকালে ঘুম থেকে ওঠা যতই বিরক্তিকর হোক না কেনো, মায়ের ডাক শুনে প্রতিদিন আমার ঘুম ভাঙ্গে- এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। আমি নিশ্চিত শুধুমাত্র এই কারণেই সারাটাদিন আমার খুব ফূর্তিতে কাটে।

ক্লাসে বাঘা বাঘা সব প্রফেসর সলিড স্টেট আর ফ্লুইড মেকানিক্সের মত আবেগবিহীন কঠিন সব সাবজেক্ট ভেঙ্গেচুরে তরলে পরিণত করার যত চেষ্টাই করুক না কেনো আমি শুধু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কাউন্টডাউন করতে থাকি। আমার কলমের অগ্রভাগের খাতায় ক্লাসনোট তোলার যত না আগ্রহ তারচেয়ে পাশে বসা সুমন আর ফয়সালের পেটে গুঁতো মারাতে পশ্চাৎভাগের আগ্রহ বেশি। ব্রেকটাইমে ক্লাস থেকে বের হতে হতে দেখি আমারি কিছু সহপাঠী আগের লেকচারের সাথে সদ্য তোলা লেকচারের সিংক্রোনাইজেশন খোঁজায় ব্যস্ত। কিছু সহপাঠী স্যারের দিকে ভয়ংকরভাবে দৌড়াচ্ছে তাদের মাথায় আসা কিছু ডাউট সলভ করার জন্য। মনে মনে ভাবি- ‘জ্ঞানবিহীন আমার এ জীবন অজ্ঞান আর অতিষ্ট, জ্ঞানের চাকায় না হয় যেন তোদের জীবন পিষ্ট’ আমারি মত কিছু ফাউল পোলাপানের সাথে ক্যাফেতে যেতে যেতে দেখি নাহিদ প্রাণপনে দৌড়াচ্ছে।

আমাদের দেখতেই এক নিঃশাসে বলে- “আজ মেশিন ল্যাবের থিউরী ক্লাস এডমিন বিল্ডিং এ হবে। ” মনে মনে নাহিদকে একশ একটা গালি আর এ খবরটা জানানোর জন্য হাসিমুখে বলি- ‘থ্যাংকস’ তিক্ত মনে আমরা ক’জন পা বাড়াই আরেকটা বোরিং ক্লাসের দিকে। ইনফ্যাক্ট সব ক্লাসই আমার কাছে বোরিং। কিছু টিচারের মাঝে আমি দেখতে পাই শেখ মুজিবের ছায়া, কারো মাঝে দেখি তারেক জিয়ার অবয়ব, কাউকে দেখে চোখের সামনে ভেসে ওঠে মডেল শারিকা। প্রতিটা লেকচারই আমার কাছে ৫০ মিনিটের গজলের সমতুল্য- যেটা শুধু শোনার সময়ই তার অন্তনিহিত ভাব বোঝা যায় আর বন্ধ হলে সব হাওয়াতে মিলায়।

আমার কাছে স্যারদের বোর্ডের লেখার সাথে হাশেম খানের ক্যানভাসে রংতুলির বিক্ষিপ্ত আঁচড়ের কোন পার্থক্য নাই। পানসে ক্লাসে মাঝে মাঝে লবণের স্বাদ আনে স্যারদের কাছে দেয়া মজার কিছু ডাউট। কিন্তু যখন ডাউট আসে- “স্যার, pdf file এর সাথে probability density function এর কোন মিল আছে কি?” তখন সেই পানসে ক্লাস আতেলমার্কা ছাত্রের দেয়া অতিরিক্ত লবণের ফলে তেঁতো ধরণের বিশ্রী স্বাদের যোগান দেয়। আমি অপলক চেয়ে থাকি আমার ঘড়ির দিকে। মাঝে মাঝে মনে হয়- “ঘড়িটার ব্যাটারী বুঝি বা শেষ, তা’নাহলে তো কাটা নড়ার কথা” ভাবতে ভাবতেই এক সময় ঘড়ির কাটা আমার আতি আকাক্ষিত জায়গাটায় স্থান নেয়।

আমি অস্থির চোখে আশেপাশে তাকাই। ‘ওরে বাবা’- সবাই দেখি খাতায় বিরামহীনভাবে কলম টেনেই যাচ্ছে। চমকে গিয়ে সামনে তাকাতেই দেখি স্যারের জ্জানদান এখনো শেষ হয়নি। “স্যার শ্যাষ, স্যার শ্যাষ” বলে আমারি মতন কিছু পোলাপান পেছন দিক থেকে মাতম তোলে। সেই মাতম জ্ঞানপিপাসু কিছু সহপাঠীর বিরক্তির কারণ হলেও অধিকাংশই সারাদিনের জ্ঞানভারে কাহিল হয়ে আমাদের সাথে সুর ধরে- “স্যার শ্যাষ, স্যার শ্যাষ।

” স্যার এতোক্ষণে বুঝতে পারে যে তার ক্লাসটাইম দশ মিনিট আগেই শেষ। “আজকে অর্ধেক লেকচারও শেষ করতে পারলাম না। ”- বলতে বলতে স্যার বোর্ড মুছতে থাকে। স্যারের এই বেদনায় আমি মুখ টিপে হাসি। মনে মনে ভাবি- ‘স্যারদেরও তাহলে দুঃখ আছে।

’ কিন্তু তাদের দুঃখটা তো পরীক্ষা ভালো দিয়েও রেজাল্ট খারাপ হবার মত এতটা বড় না। ক্লাস শেষ হতেই হাফ ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে আসি আমি। রিকশায় চড়ে বড় বড় করে শ্বাস নেই, যেন অনেকক্ষন পানির নিচে আটকে ছিলাম। অবশেষে অক্সিজেন পেয়েছি। বাসের জন্য লাইনে দাঁড়াই।

কখনো প্রখর রোদে পুড়ে আবার কখনো বা মুষল বৃষ্টিতে ভিজে আবার আমি ফিরে আসি আমার নীড়ে। বাসায় এসে দেখি মা এখনো আমার জন্য ভাত বেড়ে বসে আছে। গোসল শেষে দুপুরের ভাত খেতে বসি বিকেল ৪টায়। ডাইনিংয়ে বসেই ফোনে কথা হয় রবি, দিয়াব, ইকবাল আর নুরের সাথে। বিকেলের আড্ডার স্থান ঠিক হয়ে যায় তিন মিনিটের মাঝেই।

পেপার নিয়ে টিভির সামনে বসতে বসতেই সময় হয়ে যায় বাইরে বেরোনোর। এখন আর আমার ঘড়ি থেমে থাকে না। কাটা এক ঘর থেকে আরেক ঘরে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। এখন ঘড়ি দেখলেই বিরক্তি লাগে। হাত থেকে ঘড়ি খুলে গেট খোলা রেখেই ছুটে বেরিয়ে যাই আমার আড্ডাবাজী দোস্তোদের প্রতিদিনের মিলনমেলায়।

এই মেলায় কোন নিয়ম নেই কিন্তু জীবনের আনন্দ আছে। এই আড্ডায় কোন ডিসিপ্লিন নেই কিন্তু বাঁধভাঙ্গা উচ্ছাস আছে। এ আসরের স্পেসিফিক কোন টপিকস নেই কিন্তু জীবনের গূঢ় রহস্যোন্মচনের ফর্মূলা আছে। এই আড্ডাতেই আমি আমাকে ফিরে পাই। এই আসরেই বুঝতে পারি- ‘আমি রোবোট না, আমি একটি প্রাণ’ এই প্রাণমেলা থেকে ফিরতে ফিরতে প্রায়ই দেরি করে ফেলি।

আম্মু রাগদেখানো ভারী গলায় জিজ্জাসা করে- “কি’রে এত দেরি কেনো?” আমি প্রতিদিনের মত একই এক্সিউজ দিয়ে বলি- “আম্মু ঘড়িটা তো ফেলে গেসিলাম, টাইম দেখতে পারিনি” এরপর শুরু হয় লোডশেডিংয়ের সাথে আমার লুকোচুরি খেলা। যতক্ষণ কারেন্ট থাকে ততক্ষণ আমি পিসির সামনে আর যখন ডিজিটাল আঁধার নামে তখন আমি চার্জলাইট আর ডায়েরী নিয়ে চলে আসি বারান্দায়। রাত দশটায় সবাই মিলে খেতে বসি ডাইনিং টেবিলে। খবর পাই, কাল কে কে বাসায় বেড়াতে আসবে, ছোটখালার হবু বর কি করছে, সোনিয়া আপু ইটালি থেকে কবে আসছে আরো কক্তো কি। এভাবেই বেজে যায় রাত ১২টা।

আমি মোবাইল হাতে নেই, রুটিনমাফিক ফোন করি আকাশকে। জেনে নেই কাল কোন ক্লাসটেস্ট আছে কিনা। না থাকলে দেখতে বসি কোন নতুন ম্যুভি আর থাকলে আমার আধো আধো তোলা লেকচারের খাতাটা চোখের সামনে মেলে ধরে জটিল সব ইকুয়েশনের দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকি আর মাথায় হাত দিয়ে ভাবি- ‘আহা, অন্তত এই ক্লাসটা যদি ভালো মতো করতাম কতই না ভালো হত’ এভাবেই বেজে যায় রাত রাত ২টা। ঘড়ির কাটা দৌড়েই চলছে। আবার সকাল ৬টায় আম্মুর ডাক শোনার আপেক্ষা নিয়ে চলে যাই বিছানায়।

লাইট অফ করে দেই। ঘুম আসে না। চোখ বন্ধ হতেই সারাটা দিন মনের আয়নায় ভেসে ওঠে। কি নিরস রোবোটিক জীবন আমার। সবকিছু রুটিনের কঠিন ইস্পাতে বাধা।

কিন্তু পরক্ষণেই ভাবী- ‘না, আমি এখনো রোবোট হয়ে যাইনি’ রুটিন আমার জীবনে থাকলেও সেই রুটিন আমাকে চালাতে পারে না। আমিই রুটিন কন্ট্রোল করি। ইচ্ছে হলেই ভেঙ্গে ফেলি। বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরতে চলে যাই সম্পূর্ণ অচেনা সব জায়গায়, কাজিনদের সাথে অ্যাটেন্ড করি যে কোন পার্টিতে, ইচ্ছে হলেই ফ্যামিলির সবাই মিলে চলে যাই স্টার কাবাবে বা হাজীর বিরিয়ানীতে। এইসব কাজ তো কোন রোবোটের করা সম্ভব না।

রোবোটের ডিভোশন আছে ইমোশন নাই। আর আমার ইমোশন আছে কিন্তু ডিভোশন নাই। পড়ালেখায় ডিভোশনবিহীন এই আমি যে লাইফ লীড করছি তা খুব একটা খারাপ না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.