আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আগামী কি তাহলে অন্ধকারময়?

যুক্তিগ্রাহ্য সত্যকে তুলে ধরা এখন খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ এমনভাবে দুই মেরুতে বিভক্ত যে আপনার সত্য ভাষণ যদি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে আপনি বিএনপি আর যদি বিএনপির বিপক্ষে যায়, তাহলে নিশ্চিতভাবে আপনি আওয়ামী লীগের সমর্থক। আপনার ভিন্ন কোনো অবস্থান নেই, থাকতে পারে না এবং আপনি ইতিমধ্যে সাধারণের কাছে এভাবেই চিহ্নিত হয়ে গেছেন। সুতরাং, আপনি যত সত্যই উচ্চারণ করুন না কেন, তা যে ওই দুই দলের কোনো একটির সমর্থনে করছেন, এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষ প্রায় নিশ্চিত। আর নিশ্চিত বলেই আপনার কথায় তারা আস্থা স্থাপন করে না।

এভাবে পূর্বনির্ধারিত অনাস্থার চাপে পড়ে প্রতিনিয়ত আসল সত্য হারিয়ে যাচ্ছে।  যোগাযোগপ্রযুক্তির বিপ্লব ঘটায় বাংলাদেশের মতো গরিব দেশেও এখন সংবাদমাধ্যমের অবিশ্বাস্য বিস্তৃতি। বিপুল সংখ্যায় টেলিভিশন চ্যানেল, ছাপমাধ্যমে অসংখ্য সংবাদপত্র, অনলাইন পত্রিকা, এফএম রেডিও, কমিউনিটি রেডিও, সামাজিক যোগাযোগের ফেসবুক, টুইটার আর ব্যক্তিগত যোগাযোগের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের তাবৎ ঘটনাপ্রবাহ মুহূর্তে পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের কাছে। এসব মাধ্যমে বাঘা বাঘা মানুষের লেখায় ও বলায় ঘটনার বিশ্লেষণও উঠে আসছে। পক্ষ-বিপক্ষ ও সম্পাদকীয় নীতির ভিন্নতা সত্ত্বেও এত তথ্য এবং তাকে কেন্দ্র করে নানা মতামতের মধ্য দিয়ে সাধারণের কাছে তো সত্যটা বেরিয়ে আসার কথা।

মানুষের আরও বেশি শিক্ষিত, সচেতন, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না বলেই সাঈদীকে চাঁদে দেখার কথা বলে মানুষকে খেপিয়ে তোলা যায়, হেফাজতের সমাবেশে মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো যায়, তেঁতুল তত্ত্বের পরও সেভাবে নারীরা প্রতিবাদে এগিয়ে আসেন না, ভোটের রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার সম্ভব হয়।
আসলে এ দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের ওপর তাদের প্রভাব ক্রমেই হারিয়ে ফেলছে। সাধারণ মানুষ নিশ্চিত মধ্যবিত্ত বা এই শ্রেণীর নানা পেশায় যুক্ত ব্যক্তিদের এখন আর আগের মতো ভালো চোখে দেখে না, বিশ্বাস করে না, শ্রদ্ধা করে না। অথচ এ দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিম্নবিত্তের মানুষ সৎ উপদেশ বা দিকনির্দেশনার জন্য চিরকাল শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মুখ চেয়ে থাকত।

এলাকার শিক্ষক, চিকিৎসক, উকিল, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, ছাত্রনেতা, লেখক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মীর কথায় মানুষের অগাধ আস্থা ছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তাদের গড় চরিত্র আদর্শবাদী হওয়ায় ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সব বাঁকে তারাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু গত শতকের নব্বইয়ের দশকের পর থেকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের ওপর বা সাধারণের ওপর তাদের প্রভাব হারাতে শুরু করে।  এই যে প্রভাব হারানো, এর জন্য কিন্তু প্রধানত শিক্ষিত মধ্যবিত্তই দায়ী। আগে মাত্রাটা ছিল সহনীয় পর্যায়ে।

এখন সব লাজলজ্জা ভুলে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বড় অংশই দুই মেরুর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। দুই দলের দিকে নগ্ন এই যাত্রার পেছনে দলীয় আদর্শের প্রতি বিশ্বাস কাজ করলেও একটা কথা ছিল, কিন্তু এই উন্মাদ দলবাজির প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে ক্ষমতা আর ব্যক্তিগত লোভ-ভোগের স্বার্থ। এদিকে যাঁরা লোভ-ভোগ থেকে দূরে থাকতে চান, তাঁদেরও আর মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। চাকরি, পদোন্নতি, ঠিকাদারি, ব্যবসায় ইত্যাদি কোনো কিছুই এখন দলবাজি ছাড়া ন্যায্য প্রাপ্তি হিসেবে অর্জন করা সম্ভব নয়। ফলে, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একটি অংশ তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে দলবাজি করতে বাধ্য হচ্ছে।

আর এই দুই ধারার ধাক্কা সামলে হাতে গোনা যে কজন মানুষ সত্য আঁকড়ে টিকে থাকতে চায়, যারা মনে করে দল করা আর দলবাজি করা এক নয়, যারা বিশ্বাস করে দলের মধ্যে থেকেও দলকে টিকিয়ে রাখতে হলে সত্য উচ্চারণ জরুরি, তাদের চিৎকার ওই দুই ধারার স্রোতের তোড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। সত্যের এই টিমটিমে আলো সাধারণের চোখেই পড়ছে না। আর চোখে পড়লেও দলবাজেরা নিজেদের ঝোলার বিড়াল বেরিয়ে পড়ার ভয়ে সেদিকে হামলে পড়ছে। নাজেহাল করছে সত্য উচ্চারণকারীদের, সামাজিকভাবে হেয় করার চেষ্টা করছে তাদের। আর তাতেও সফল না হলে নানা রকম নেতিবাচক তকমা এঁটে দিচ্ছে সত্য উচ্চারণকারীদের গায়ে।

এভাবে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নিজেরাই নিজেদের প্রভাব কমিয়ে ফেলছে। ঠিক যেভাবে রাজনৈতিক দল স্বার্থবাদী দলবাজদের দলে ভিড়িয়ে দলের বারোটা বাজাচ্ছে। সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত যা ঘটছে, তা হলো সাধারণ থেকে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বিচ্ছিন্নতা। যে বিচ্ছিন্নতার ফাঁক গলে প্রবেশ করছে পেছনমুখী চিন্তা-চেতনার অন্ধকার।  সাধারণ মানুষের ওপর শিক্ষিত মধ্যবিত্তের প্রভাব হারানোর পেছনে রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও রয়েছে আর্থ-সামাজিক ও প্রযুক্তিগত কারণসহ নানা কারণ।

এখন থেকে ২০-২৫ বছর আগেও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের জীবনাচরণে খুব পার্থক্য চোখে পড়ত না। ধর্মীয় বা সামাজিক যেকোনো অনুষ্ঠানে উভয় শ্রেণীর মেলামেশা ও সম্পর্ক ছিল প্রায় সমমর্যাদার। এখন ধনবৈষম্যের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক বৈষম্যও প্রকট আকার ধারণ করেছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে এখন নিম্নবিত্তের প্রবেশাধিকার প্রায় নেই-ই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উভয় শ্রেণীর মেলামেশার সুযোগ ঘটলেও সম্পর্কটা সমমর্যাদার বা বন্ধুত্বপূর্ণ না হয়ে তা হয়েছে অনেকটা ঊর্ধ্বতন-অধস্তনের সম্পর্কের মতো।

ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পারস্পরিক কোলাকুলিও হয়ে পড়েছে মেকি। উভয় শ্রেণীর পোশাক-আশাক, খাওয়াদাওয়া, বাসস্থান, চিকিৎসাব্যবস্থাও এখন আলাদা। আগে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের সাদাসিধে জীবনযাপন। এখন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বড় অংশই ভোগবাদী। জীবনযাপনে তাদের নানা আড়ম্বরের ছড়াছড়ি।

বৈষয়িক এই ঠাটবাট বজায় রেখে নিম্নবিত্তের কাছ থেকে আস্থা প্রত্যাশা করা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।  সমাজের মেরুকরণ কেবল আওয়ামী লীগ বিএনপিকে কেন্দ্র করে নয়, আসল মেরুকরণ ওপর আর নিচের। এক দল ওপরের দিকে ধাবমান; অন্য দল নিচের প্রান্তে গিয়ে ঠেকছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এই পার্থক্য দৃষ্টিকটুভাবে চোখে পড়ে। আগে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সন্তান আর দিনমজুরের সন্তান একই বিদ্যালয়ে পড়ত।

এতে উভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে একধরনের বিনিময়ের সুযোগ ঘটত। গরিবের সন্তান সচ্ছল বন্ধুর গল্পের বইটা ধার করে হলেও পড়ার সুযোগ পেত। সচ্ছল পরিবারের সন্তানটিও গরিবের কষ্টটা অনুভব করার ক্ষমতা অর্জন করত। বাল্যকালের পাঠ ও খেলার সাথির বন্ধুত্বটাও চিরদিন থাকত অটুট। আজ শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সন্তানদের স্কুল আলাদা।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিম্নবিত্ত আর বিত্তহীনের সন্তান ছাড়া কেউ পড়ে না। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য (নিম্নবিত্ত আর বিত্তহীনদের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা তো আছেই)। ফলে, একে অন্যকে বোঝার বা পারস্পরিক সুখ-দুঃখকে ভাগ করে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গরিবের বিদ্যালয়গুলোর পাঠদানের ব্যবস্থাও এমন যে তা থেকে প্রকৃত উদার বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা গ্রহণ সম্ভব নয়; বরং এসব শিক্ষালয়ের বিদ্যার্থীরা শুরু থেকেই নিজের সম্পর্কে একধরনের হীনতাবোধ নিয়ে বড় হতে থাকে। আর এই হীনতাবোধ থেকেই মধ্যবিত্তের প্রতি জন্ম নেয় তাদের ঘৃণাবোধ।

 প্রযুক্তির উন্নয়ন যেমন যোগাযোগের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করেছে, তেমনই নতুন ধরনের প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি করেছে। আধুনিক যোগাযোগমাধ্যম পরোক্ষ যোগাযোগকে যে মাত্রায় বাড়িয়ে চলেছে, ঠিক সেই মাত্রাতেই প্রত্যক্ষ যোগাযোগকে সংকুচিত করছে। প্রেক্ষাগৃহ এখন বেডরুমে। নাটক বলতে বোঝায় টেলিভিশন নাটক, খেলা দেখার জন্য আর মাঠে যেতে হয় না। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বললেই চলে।

বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার দেখা-সাক্ষাৎও বন্ধ হওয়ার পথে। ঘরে বসে অনলাইনে বাজার করার সুযোগ ক্রমেই বাড়ছে। শিশুরাও বন্ধুদের সঙ্গে খেলার মাঠে একসঙ্গে যাওয়ার পরিবর্তে ঘরে বসে ল্যাপটপে গেম খেলায় ব্যস্ত থাকছে বা থাকতে বাধ্য হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের যোগাযোগও প্রত্যক্ষ নয়। উপরন্তু, এই যোগাযোগ আবার হচ্ছে একই শ্রেণীর মধ্যে।

কাজেই আধুনিক যোগাযোগমাধ্যম মানুষের সঙ্গে মানুষের সরাসরি দেখা-সাক্ষাতের সুযোগকে সংকুচিত করছে। এই ব্যবস্থায় মধ্যবিত্তের সঙ্গে নিম্নবিত্তের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ কমে আসছে। আসলে পুরোপুরি পৃথক হয়ে গেছে মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের সমাজ। এই আলাদা সমাজের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এখন সন্দেহ আর অবিশ্বাসের।  শিক্ষিত মধ্যবিত্তের দুই রাজনৈতিক মেরুতে অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়া এবং তাদের সঙ্গে নিম্নবিত্তের বিচ্ছিন্নতার মধ্যে যে বিশাল ফাটল, তাতে কেবল সন্দেহ-অবিশ্বাসই ঢুকে পড়েনি, পাশাপাশি ঢুকেছে বিকৃতি, মিথ্যা, গুজব, বিভ্রান্তি, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ইত্যাদি প্রগতিবিরোধী উপাদান।

ফলে, যারা এসব নেতিবাচক উপাদান কাজে লাগিয়ে ফায়দা হাসিল করতে চায়, তাদের এখন পোয়াবারো। রাজনীতি, বিশেষ করে নির্বাচনী মাঠে এসব উপাদান অতিমাত্রায় সক্রিয়।  মিথ্যাচার, গুজব, অপপ্রচার ইত্যাদি একটি সমাজে তত দিন টিকে থাকে, যত দিন এসব প্রয়োগ করে স্বার্থ উদ্ধার সম্ভব হয়। সংবাদপত্রের কলাম বা টেলিভিশনের টক শোর মতো পরোক্ষ মাধ্যমে এসবের বিরুদ্ধে কথা বলে অথবা নির্বাচনী মাঠে হঠাৎ করে উপস্থিত হয়ে এর বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়ে ফল পাওয়ার আশা খুবই কম।  সমাজের এত গুরুত্বপূর্ণ দুটি স্তরের মধ্যে সৃষ্ট সন্দেহ-অবিশ্বাসের এই ফাটল জোড়া লাগানো খুবই দুরূহ এবং সময়সাপেক্ষ।

প্রচলিত রাজনৈতিক দর্শন ও সংস্কৃতিতেও এটা মেরামতের দাওয়াই নেই; বরং ভোগসর্বস্ব রাজনীতি দিয়ে আমরা এই ফাটলকে হয়তো ক্রমাগত বাড়িয়েই চলব। আর ফাটলের সেই অন্ধকারে হারিয়ে যেতে থাকবে মানবজীবনের সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণ। আমাদের আগামী কি তাহলে অন্ধকারময়? হয়তো সময়ই বলে দেবে এ প্রশ্নের উত্তর। আপাতত ভরসার কথা এই যে বিভ্রান্তি, অপব্যাখ্যা, গুজব, অসত্য, অন্যায় কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সাধারণ মানুষ তাদের কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই একসময় মিথ্যার ফানুসের গায়ে সুচ ফুটিয়ে দেবে।

সাধারণ মানুষের কাণ্ডজ্ঞানের ওপর আস্থাই হয়তো আমাদের শেষ ভরসা।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।