munirshamim@gmail.com
পোখারা। হিমালয়ের দেশ নেপালের ছোট্র পর্যটন শহর। এখানে এবারের মতো আমাদের শেষ বিকেল আজ । পরের দিন খুব সকাল সকাল আবার কাঠমুন্ডুর উদ্দেশ্যে যাত্রা। পুরো টিমের মধ্যেই ছেড়ে যাওয়া ও গুছিয়ে নেয়ার তাড়া।
পোখারায় ভ্রমণের শেষ আনুষ্ঠানিক কর্মযজ্ঞ হিসেবে একটু আগেই সবাই মিলে এক পলক ঘুরে এসেছি ডেভিস ফলস। এটি একটি অপরূপ প্রাকৃতিক ঝর্ণা। যার আদী নাম ছিল প্যাটালী সাঙ্গো। ১৯৬১ সালের ৩১ জুলাই বিকেলের রোদে সুইস তরুনী ডেভিস তার স্বামীর সাথে গোসল করতে নামলে লেক থেকে হঠাৎ দ্রুত বেগে নেমে আসা পানির স্রোতে ভেসে যায় ডেভিস। অনেক দিন পর তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
তবে জীবত নয়, মৃত অবস্থায়। পরবর্তীতে তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এ ঝর্ণার নামকরণ করা হয় ডেভিস ফলস। ৫০০ মিটার দীর্ঘ এবং ১০০ মিটার গভীরের এ নয়নাভিরাম ঝর্ণাপ্রবাহটি বছরের প্রায় সব সময় চলমান থাকে। তবে জুন-সেপ্টম্বর এর দিকে এর গতি তারুন্যদীপ্ত হয়ে উঠে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা এসেছি ডিসেম্বর মাসে।
যখন এর ঘুমিয়ে থাকার সময়। তবুও ঘুমন্ত ঝর্ণাধারার ছলছল শব্দে আমাদের মন দোলে উঠে। আমাদের অনুভূতিকে নাড়া দিয়ে যায় ডেভিস দম্পতির অনিচ্ছাকৃত বিচ্ছেদের স্মৃতি। যেন প্রিয়জন হারানোর বেদনাগুলোই ঝর্ণা প্রবাহের গতিপথে বেজে উঠে বারবার। সে ভালবাসার টানেই হয়তো প্রতিদিন শত শত মানুষ ছুটে আসে।
( ডেভিস ফলস এর ছবি)
ডেভিস ফলস এর প্রবেশ পথের সামনেই অনেকগুলো সারি সারি ছোট ছোট দোকান। বেশির ভাগ দোকনের বিক্রেতা নারী। তার মধ্যে খুব কম সংখ্যক নেপালী। বাকীদের কেউ ভারতীয়, কেউ বা তিব্বতী। অথবা অন্য কোন দেশের।
কোন কোন দোকান নারী-পুরুষ এর যৌথ উদ্দেগে পরিচালিত। নেপালী স্বাদের নানা বাহারী পন্যে সাজানো দোকানগুলো। প্রধানত নারীদের ব্যবহার যোগ্য বর্ণীল পাথুরে অলংকার। স্থানীয় ঘরানার পোষাক-পরিচ্ছদ, শীতবস্ত্র। রাধাকৃষ্ণ, গৌতমবুদ্ধের মূর্তি, নেপালের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন আকার ও রঙের ছুরি।
ধুমপায়ীদের জন্য কাঠের তৈরি ছাইদানীও রয়েছে। ছাইদানীগুলোর ভেতরে রয়েছে যৌনাবেদনের বিশেষ ভঙ্গিমায় বসা নারীর খোদাই করা নগ্নমূর্তি। পুরুষ ধুমপান করবে। তার উচ্চিষ্ট ফেলবে নগ্ন নারীমূর্তির গায়ে। যখন যেখানে খুশি ইচ্ছেমতো।
পুরুষতান্ত্রিক শিল্পচর্চায় নারী শরীরকে এজমালী হিসেবে ভোগ্য করে তোলার বৈশ্বিক শিশ্নবাদী ইতিহাসে একটি আদর্শ নমুনা হতে পারে এ নেপালী ছাইদানী।
ইতোমধ্যে আমাদের ২১ জনের টিম খন্ডে খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। পুরো দমে ঝাপিয়ে পড়েছে কেনাকাটায়। আমরা মানে আমার প্রতি দিনের চব্বিশঘন্টা জীবনের গতি-দুর্গিতির সার্বক্ষণিক মনিটরিং অফিসার আমার জীবনসঙ্গী ফারহানা, এ সব কর্মকান্ডে সার্বক্ষণিক খবরদারীর উদীয়মান সমন্বয়কারী আমাদের একমাত্র কন্যা অরিত্রী মিলে তিনজনের একটি টিম। এ দোকান ও দোকান ঘুরতে ঘুরতে একেবারে শেষ মাথায় এসে থমকে দাঁড়াই।
ক্লান্তি রোধে চা এর খোঁজে। চোখের সামনে ঝুলে থাকা বিভিন্ন রঙের ব্যতিক্রম মাফলারগুলো দেখে আগ্রহী হয়ে উঠি। আমরা তিনজনেই। মাফলারগুলো এক কথায় ফ্যাশন্যাবল, ব্যতিক্রম। এ রকম ডিজাইনের মেয়েদের মাফলার আমাদের দেশে নেই।
অন্তত আমাদের চোখে পড়েনি। সুতরাং দু’একটি কেনা চাই চাই-ই। বাছাই আর দরকষাকষি করতেই করতেই আমাদের খাতির জমে উঠে বিক্রেতা দু’টি মেয়ের সাথে। ওরা দ্’ুজনই বয়সে তরুন। উচ্ছল এবং আলাপী।
ভাল ইংরেজি বলে। সম্ভবত হিন্দী ও নেপালী ভাষায়ও পারঙ্গম। জানা গেল ওদের দোকানে চা-কফি ও পাওয়া যায়। আমরা মূলত: চা খুজছিলাম। দেরি না করেই আমরা চায়ের অর্ডার দেই।
চায়ের কাপে চুমুক দিতেই দিতেই চলতে থাকে আলাপচারিতা।
তোমাদের দেশ কোথায়?
-বাংলাদেশ
তোমারা নেপালী?
-না?
তাহলে?
-আমাদের কোন দেশ নেই
মানে কি?
-আসলেই আমরা দেশহীন। গৃহহীন। আমাদের কোন দেশ নেই। আমরা তিব্বতী।
কিন্তু তিব্বত এখন আমাদের দেশ নয়। ওটা অন্যের দখলে। চীনের করতলে। ওখানে আমাদের যাবার সুযোগ নেই।
তোমরা যেতে চাও?
-অবশ্যই।
ওটা আমাদের মাতৃভূমি। মাতৃভূমিতে কে না যেতে চায়? আমরাও ফিরতে চাই। থাকতে চাই ওখানে। প্রিয় স্বদেশে।
তোমরা কতদিন ধরে নেপালে আছ?
-অনেক অনেক দিন।
দিনক্ষণ মনে নেই। তবে আমাদের বাবা-মারও জন্ম হয়েছে এ নেপালে। আমাদেরও জন্ম এখানে। তবু আমরা নেপালী নই। আমাদের নাগরিকত্বও নেই।
এখানে আমাদের একমাত্র পরিচয় শরনার্থী। থাকি শরনার্থী ক্যাম্পে। জন্ম শরনার্থী ক্যাম্পে। আমাদের বেড়ে উঠা এ শরনার্থী ক্যাম্পে।
জানা যায় নেপালের বিভিন্ন জায়গায় এ রকম বারটি শরনার্থী ক্যাম্প রয়েছে।
যেখানে বিশ হাজারেরও বেশি তিব্বতী শরনার্থী রয়েছে। কোন কোন সূত্র মতে শুধু কাঠমুন্ডতেই ৩০,০০০ শরনার্থী রয়েছে। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে এ সব তিব্বতী শরনার্থীদের আগমন শুরু হয়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সীমান্ত পাড়ি দেয়া তিব্বতীর সংখ্যা। এ শরনার্থীদের নিয়ে ভূরাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত দূর্বল রাষ্ট্র নেপালেরও রয়েছে দ্বিমুখী সংকট।
এক দিকে শরনার্থীদের জন্য কোন প্রকার পুনর্বাসন ব্যবস্থা না করার বিষয়ে প্রতিবেশী চীনের চাপ, অন্যদিকে শরনার্থীদের জন্য কিছু করার বিষয়ে ইউরোপ-আমেরিকা সহ আন্তর্জাতিক কমিউনিটির চাপ। দুই চাপের নেতিবাচক তাপপ্রবাহ শেষ পর্যন্ত গায়ে এসে লাগে দরিদ্র শরনার্থীদের গায়ে। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এ এক দাসত্বের শৃঙ্খল। মুক্ত থেকেও মুক্ত নয়। অদৃশ্য শেকলে সব বন্দী হয়ে থাকে।
জন্ম নিয়ে নাগরিকত্ব লাভের বিধান দেশে দেশে চালু থাকলেও এ নিয়ম ওদের বেলায় প্রযোজ্য নয়। চিরচারিত দাস ব্যবস্থায় যেমন দাসের সন্তান দাস হিসেবেই বেড়ে উঠে ঠিক আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার শরনার্থী শিবিরেও শরনার্থীর নবজাতক আর নাগরিক হয়ে উঠে না। থেকে যায় শরনার্থী হিসেবে। তবু সৌভাগ্য যে, নেপালের মাটিতে ছোটখাট ব্যবসা-বাণিজ্য করে ওরা ওদের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। পড়া-লেখার করার সুযোগ রয়েছে।
অন্তত আয়-ক্যালেরী গ্রহণের হিসেবে ওদের দরিদ্র বলা যাবে না। কিন্তু দারিদ্র্যের মানবকি সূচকে ওদের অবস্থান দারিদ্র্য রেখার অনেক অনেক নিচে। ভিটে-মাটি ছাড়া এ সব মানুষ এর সংখ্যা প্রতিদিনই বেড়ে চলছে।
দেশ হারাবার গল্প আর স্বদেশের আকুতি মাখা মেয়ে দু’টির চোখে আমরা যেন দেখতে শুরু করি বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানবেতর জীবনযাপনকারী অগনিত শরনার্থীর মুখ। রাষ্ট্র শাসনের নামে কখনো রাষ্ট, কখনো ব্যক্তি ক্ষমতাবানের দাপটে যারা হারিয়েছে আপন জন্মভূমি।
মা, মাটি, আপনজন। মেয়ে দু’টির সাথে আমাদের মেয়ে অরিত্রীর ভাব জমে উঠে। একজন ওর সাথে ছবি তোলে। কোলে নিয়ে গল্প করে। ওকে চুড়ি উপহার দেয়।
ততক্ষণে শহরের চারপাশে ঘিরে থাকা উঁচু উঁচু পাহাড় বেয়ে নেমে আসে অন্ধকার। ঘন কুয়াশা। তার থেকেও উচু হিমালয়। ঘন কুয়াশা আর সন্ধ্যার অন্ধকারের কাছে হিমালয়ও হার মানে। আর দেখা যায় না।
মেয়ে দু’টিকে আমাদের বিদায় বলার সময় হয়। অন্ধকারে হিমালয়ের বিশালত্ব ঢাকা পড়লেও দেশহীন এ দু‘টির মেয়ের মুখ আর সামান্য আলাপনের স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে পড়ে থাকে আমাদের মনে। কোন ভাবেই ভোলা যায় না মেয়ে দু’টিকে। পৃথিবীর তাবৎ শরনার্থীর দেশে ফেরার আকুতি নিয়ে ওরা হিমালয়ের চেয়েও অনেক বেশি বিশালত্ব নিয়ে হাতছানি দেয় আমাদের মনে। অবসান হোক মানুষের শরনার্থী হওয়ার ইতিহাস।
আজই। এখনই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।