নিশীথ রাতের বাদল ধারা
“তুই কে-ক্রাফটের শাড়িটা কিনলেই পারতি। তোকে দারুন মানাতো। “
নাসরিন বান্ধবীর উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে না হেসে পারল না।
“তোকে বলেছে ভাল দেখাতো! শাড়িটা ভাল ছিল ঠিকই, কিন্তু দামটা একটু বেশী মনে হয়নি তোর?”
কেয়া প্রবল বেগে মাথা নেড়ে প্রতিবাদ জানাল। “নাহ, একে এন্ডি সিল্ক আর তার উপর সারা জমিনে কাজ, আড়ং হলে ডাবল দাম হত।
“
“হু, ঠিকই বলেছিস, তবে আড়ং-এর ফিনিশিং আনপ্যারালাল। আর কালার কম্বিনেশন আমার দারুন—“ নাসরিন শেষ করার আগেই পিছনের রিক্সা ওদের রিক্সাকে হঠাৎ ধাক্কা দিলে কোনমতে সামলে নিয়ে বসল ওরা।
ওদের রিক্সাওয়ালা পিছনের জনকে চরম ধমকের সুরে বকাবকি শুরু করল, “এই হালার পুত হালা, দেইখ্যা চালাস না, চোঊখ ক্যান দিছে আল্লায়” ইত্যাদি ইত্যাদি। পিছনের চালকও কম যান না, গলা উচিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলে। “তুমি হালায় আচুমকা বেরেক মাইরলা ক্যান।
নিজে ঠিক কইরা চালাইবার পারো না, মাইনশ্যেরে কইতে আইছো“ এ গজগজ করে তো, ও ফোস ফোস।
মধ্যগগণে সূর্য যেন আগুন ঢালছে--লাভার মত গলছে পিচ। একে রাস্তায় ভীষন জ্যাম, রিকশা সব একের পিছনে এক লাইন দিয়ে দাঁড়ানো, তারমধ্যে অকারণ এই হুল ফোটানো, কথা চালাচালি সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ল।
নাসরিন বিরক্তি চেপে ঠান্ডা গলায় বলল, “রিক্সাওয়ালা ভাই, থামেন না। দেখেন না কেন এই জ্যাম লাগছে।
কিছু তো নড়ে চড়ে না। “
রিকশাওয়ালা বিরস বদনে গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে খানিক দূরে পাশের আইলের উপরে উঠে সামনের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। খবর আনতে গিয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে পড়ল, ফেরার নামটি নেই।
কেয়া আর থাকতে না পেরে তড়াক করে রিকশার উপর দাঁড়িয়ে জ্যামের কারণ দেখতে চাইল। নাসরিন তো হতবাক!
“কেয়া নাম নাম বলছি, কি করছিস।
তোর পাগলামী আর তো গেল না। “ হাত ধরে বন্ধুকে পাশে বসিয়ে দিল।
“জ্যাম ছুটতে দেরী আছে বন্ধু। সামনে মাঝরাস্তায় আস্তে আস্তে এক হুজুর হাটছে, তার পিছন পিছন হাঁটছে গোটা পঞ্চাশেক লোক। সব থেমে আছে।
ভীষন লম্বা লাইন। “
কেয়ার কথায় খানিক দমে গেল নাসরিন। বলে কি, এখন কি হবে! বাড়ি ফিরে রেডি হয়ে তার নেহাল ভাইকে ক্লিনিকে দেখতে যাবার কথা।
“কি বলিস? এইসব ফালতু লোক-ঠকানো ধান্দাবাজের জন্য এই গরমে বসে থাকতে হবে? দেশে কোন আইন কানুন নেই? এইসব ভন্ডদের জেলে পুরে দেয়া উচিত!”
নাসরিনের গলার ঝাঁঝ দেখে কেয়াও অবাক! শান্ত, অন্তর্মুখি, লক্ষী, কোমলমতি মেয়েটার কি হল!
নাসরিন নিজেই নিজের চরিত্র-বর্হিভূত আকস্মিক উস্মার বর্হিপ্রকাশে অপ্রস্তুত! কিন্তু আজকে যে নেহাল ভাইয়ের জন্মদিন! নুতন শাড়ি কিনতে গেছিল এই উপলক্ষেই। যদিও কোমায় থাকা নেহাল তার এই বিশেষ সাজ, তার চোখের তারায় ভালবাসার নিরব আকূতি কিছুই টের পাবে না।
টের পাবে না পৃথিবীর কেউ। কখনো, কোনদিন না। নাসরিন যে এটা কাউকে জানাতে পারবে না --প্রানের বান্ধবী কেয়াকেও না। এটা তার একেবারেই একান্ত—কেমন এক সিড়সিড়ে রঙিন সুখ, যা আবার একই সাথে বিষাক্ত সর্প-দংশনের মত যন্ত্রনাদায়ক! কি অদ্ভুত এক দোটানায় পড়েছে বেচারা– অবৈধ প্রেমের মত চুম্বকীয়, এড়াতে-না-পারা আকর্ষন আর সেই সাথে গোপন পাপের অপরাধ বোধ!
কেয়া বক বক করে চলেছে। “এই হুজুরের অনেক নাম শুনেছি।
উনি নাকি খালি হাঁটেন আর হাঁটেন। আর উনার পিছন পিছন সারাদিন হাঁটলে, কারো কারো মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। বুজরকি না সত্যি কে জানে বাবা। তবে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। “
অন্যমনস্ক নাসরিন কে ধাক্কা দিয়ে বলল, “কিরে, তুই আবার ভাবের জগতে চলে গেলি ক্যান? ইদানিং তোর প্রায়ই এমন হচ্ছে।
প্রেমে ট্রেমে পড়েছিস নাকি?”
নাসরিন কেয়ার খিল খিল হাসিতে তাল না মেলালেও এক ম্রিয়মান হাসির ছোঁয়া ওর ঠোঁটের কোনায় ফুটে উঠল। হায় প্রেম!
সত্যি কেন তার এমন হল। ছয় মাস আগে কার এক্সিডেন্টে বড়পি মারা গেল, নেহালভাই কোনক্রমে বেঁচে গেলেন, কিন্তু রইলেন জীবনমৃত হয়ে। বড়পি ছিল ওর জান। আর নেহাল ভাই, দুলাভাইয়ের থেকে বেশী ছিলেন বন্ধু।
অনেক পছন্দ করত ওনাকে, অবশ্যই এখনকার মত করে নয়! কত বড়পির সাথে ঠাট্টা করেছে ও। বড়পি সারা জীবন তার সেরা জামাটা, গয়না, কসমেটিক্স—সব ভাল ভাল জিনিষগুলো ওকে দিয়ে দিয়েছে, অথচ ছেলেদের বেলায় নিজেই সবচেয়ে ভালটা নিয়ে নিয়েছে! নেহাল ভাই সারাদিন দুষ্টুমি করে বলত, “আহা ছোট গিন্নি, মন খারাপ করো না, তুমি আমার সুদ, সুদই তো সব, আসলের থেকে সুদের মজা হাজার গুন বেশী ডারলিং!” বলেই ওর মাথার চুল এলোমেলো করে দিত। আর ওর গৎ বাঁধা উত্তর ছিল, “বয়েই গেছে আমার সুদ হতে, তুমি তোমার আসল নিয়েই থাক!”
বড়পির অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারে না এখনো। বুকের মধ্যে দম আটকানো এক কষ্ট! কিভাবে যে বাবা, মা আর ও একে অন্যকে আঁকড়ে এত বড় শোক সামলেছে, তা উপরওয়ালাই জানেন। তখনই একদিন বড়পির ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে ওর ডাইরী পেয়েছিল।
পড়া উচিত না জেনেও, কৌতুহলের কাছে হেরে গিয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করে ফেলেছিল নাসরিন।
ডাইরীর পাতায় পাতায় ছিল বড়পি আর নেহাল ভাইয়ের প্রেমের ইতিহাস। ওরা দুজন দুজনকে প্রাণাধিক ভালবাসত। নেহালভাই কি দারুন যে রোমান্টিক, কি আলতো করে বড়পিকে আদর করত, যেন ও পাতলা নরম কাঁচের তৈরী, ওকে ডাকত, আমার জান রাজকন্যা, আমার প্রিন্সেস বলে! অনেক যত্নে, অনেক স্নেহে বড়পির চোখের উপর হঠাৎ চলে আসা চুল সরিয়ে দিত, আলতো করে চোখের পাতায় চুমু খেত, বড়পির চুলে হাত বুলিয়ে দিত, হাতের আঙুল নিয়ে খেলতো, গুন গুন করে গান শুনাতো। বড়পি মুগ্ধ হয়ে তার ভাল লাগার কথা পাতায় পাতায় ছবির মত এঁকে রেখেছে।
কি যে নেশার মতন হয়ে গেল এই ডাইরী পড়া। দিন রাত পার করত পাতা উলটে উলটে! তার কল্পনার জগতটাকে কবে যে কেমন করে নেহালভাই দখল করে নিল সে জানতেও পারল না। কেমন করে তার স্বপ্নের রাজকুমার নেহালভাইয়ের রূপ নিল, কবে নিজের অগোচরেই ওর প্রেমে পড়ে গেল ও! বড়পির পরে ওর দায়িত্ব তারই যে নেবার কথা! আসল যে নেই, সুদকে সব বিলিয়ে সব দায়িত্ব নিতে হবে। সে যে ছোটগিন্নি! সেদিন হাসপাতালে কোমায় থাকা নিষ্পন্দ নেহাল ভাইয়ের হাত ধরে বসে ছিল, হঠাৎ মনে হল ও-ও তার হাত আকঁড়ে ধরেছে। কি বুক ধুক-ধুক করা কয়েক মুহুর্ত!
ইন-হাউস জুনিয়র ডাক্তার মনে করেছিল ওরা স্বামী-স্ত্রী।
তাই বোধহয় ওকে সাহস দিতে বলেছিল, “কোমায় থাকা পেশেন্টরা সব বুঝতে পারে, ফিল করতে পারে এবং মাঝে মাঝে রিয়েক্ট করে। আপনার ভালবাসার টান উনি টের পেয়েছেন, তাই আপনার হাত ধরেছেন আস্বস্ত করতে, হোক না ক্ষনিকের জন্য। খুব ভাল সাইন এটা। দেখবেন, আপনার হাসবেন্ড আপনার জন্য ঠিক জীবনে ফিরে আসবেন!”
ছোকরা ডাক্তারের উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে, তার ভুলটা ভাঙাতে ইচ্ছা করেনি, তার অস্থিরতায় সেই আস্বস্তি শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দিয়েছিল। নেহাল তার জন্য ফিরবে, তারা দুজনে দুজনায় হারাবে, যেন রূপকথার শেষের “হ্যাপিলি এভার আফটার”।
“ও রিক্সাওয়ালা ভাই, তাড়াতাড়ি আসেন” কেয়ার ত্রস্ত আহবান সম্বিতে নিয়ে এল ওকে। কিছু কিছু রিক্সা ফুটপাথ দিয়ে যাচ্ছে। কেয়া ওদের রিক্সাওয়ালাকে বলল, “চলেন না ভাই, যাচ্ছে তো সবাই। একটু আগাতে পারব। আর কতক্ষন বসে থাকব!“
মাথা নাড়তে নাড়তে তার উত্তর, “না আফা, যাওন যাইত না।
হুজুরের পাশ দিয়া আগাইয়া গেলে তেনার অপমান হইব। ইতা করা ঠিক হইত না আফামনি। “ সে আইলে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল।
“ঊফফ! হুজুরের খ্যাতা পুরি!” মনে মনে গজরাতে গজরাতে নাসরিন এবার উঠে দাঁড়িয়ে হুজুর দেখার চেষ্টা করল। সৌম্যদর্শন সাদা পাঞ্জাবি পড়া এক বৃদ্ধ নুয়ে পরে, অতি ধীর লয়ে পা টেনে টেনে হেঁটে চলেছেন, তার পিছে সমীহের সাথে হাঁটছে নানান বয়সের, নানান স্তরের অনেক মানুষ—আবাল বৃদ্ধ বণিতা! এক প্রত্যাশার মিছিল—পথের শেষে অমরাবতীকে পাবার বাঞ্ছা সবার বুকে!
ওইক্ষনে কি যে হল ওর।
“কেয়া আমি যাচ্ছি, তুই সব নিয়ে বাড়ি যা। আমি আসছি। “ হাতের সব ব্যাগ হতবিহবল কেয়ার হাতে গছিয়ে দিয়ে তড়িঘড়ি নেমে গেল ও। রিকশা, গাড়ি, টেম্পু, বাসের জঙ্গল পেরিয়ে নাসরিন যোগ দিল সেই প্রত্যাশার মিছিলে—কিয়ৎকাল আগের অবজ্ঞা, তিরঃষ্কার ভুলে রাজপথে মধ্যাহ্নে তার আরাধ্যের আরোগ্য কামনায়।
--------------------------------
ব্লগে আমার এক বছর হয়ে গেল।
যারা আমার অখাদ্য সব লেখা পড়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন, তাদের শুভেচ্ছা—কৃতঘ্নের মত আরো কিছু অখাদ্য পরিবেশন এই গল্পে! সবাইকে ইংরেজী নববর্ষের শুভেচ্ছা। ভাল থাকুন!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।