আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভিক্ষাবৃত্তির মুখোশ



ড. মোহীত উল আলম গাবতলী হাটে কোরবানির গরু কিনতে গেলাম। গরু কেনার পর হাসিল দিতে নির্দিষ্ট জায়গায় টাকা যখন দিলাম, যে সিস্নপ কাটছিল সে একটু ধূর্ত হাসি হেসে বলল, স্যার, চা-পানি খাওয়ার জন্য কিছু দিয়েন। তার কথা শুনে আমার ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠল রাগে। বললাম. কেন, টাকা দেব কেন? আপনাকে কি এখানে বখশিস খোঁজার জন্য রেখেছে নাকি। তারপর বললাম, এই হচ্ছে অবস্থা।

যাকে যে কাজ দিয়েছে, সে সে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে হাত পাতার মনোভাব দেখাচ্ছে। পুরো জাতিটা এ ভিক্ষা করার প্রবণতার জন্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ওরা, হাসিলের সিস্নপ কাটিয়েরা অনেকে পাশাপাশি বসেছিল। আবার কিছু যুবক ছেলে হেঁটে হেঁটে সবকিছুর তদারকি করছিল। আমার রাগ দেখে মাথায় টুপি পরা ২৫-২৬ বছরের একটি ছেলে যেন পরিস্থিতি সামলে নেবার জন্য আমার সাথে বাক্যালাপ শুরু করল।

গরু কত দিয়ে কিনেছি, গরুর বাজার কেমন মনে হল, এ ধরনের প্রশ্ন। বুঝলাম, ছেলেটি হচ্ছে নেতাগোছের কেউ। এবং আমার বয়স এবং রাগের প্রজ্বলন্ত ভাব দেখে আমাকে প্রশমিত করতে অমন খেইহারা প্রশ্নগুলো করা। আমি তাকেই বললাম, এটা কেন হবে যে, যারা সিস্নপ কাটছে তাদের মধ্যে কেন গরুর ক্রেতাদের কাছে চা-পানি খাওয়ার পয়সা চাইবার ইচ্ছা হবে। ছেলেটি আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে ভিতর থেকে ভাংতি টাকা ফেরত নিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিল।

একটু সেয়ানা হাসি দিল। বুঝলাম যে, টাকা খোঁজার ব্যাপারটাই হচ্ছে এখানে রীতি, আর আমার মেজাজ দেখানোটা হচ্ছে ব্যতিক্রম। কিন্তু, আমার মনে ঐ টাকা খোঁজা থেকে জাতির ভিক্ষাবৃত্তির মানসিকতার কথা এত চট করে মনে এল কেন? নিশ্চয় এ ব্যাপারটা একটা নিশ্চিত বোধ হিসেবে আমার মনে প্রোথিত হয়ে আছে। অর্থাৎ, আমার ধারণা হচ্ছে সবাই সব জায়গায় শুধু হাত পাতছে। কেন(?)র ব্যাখ্যায় নামতে হল।

হতে পারে, এক নম্বর কারণ যে, হাসিলওয়ালাদের ধারণা যে, যারা কোরবানির পশু কেনে তারা হাসিল ফাঁকি দেবার জন্য ঠিক দামটি বলে না। কাজেই কর ফাঁকি দেওয়া টাকা থেকে কিছু টাকা তাদের জন্য খরচ করতেই পারেন পশুক্রেতা। সম্ভবত এ কারণেই হাসিল আদায়কারী যুবক ছেলেটি এভাবে লাজলজ্জাহীন হয়ে আমার কাছে টাকা চাইল। সে হয়ত ভাবছে, ধারণা করছি যে, আপনি ঠিক দামটি বলেন নি। সরকারের করকে ফাঁকি দিচ্ছেন।

আমি সে কর ফাঁকি দেবার ব্যবস্থা করে দিয়েছি আপনাকে। কাজেই আপনিও আমাকে কিছু দেন। এখন কোরবানি হল ধর্মীয় অর্থে আলস্নাহ্্র নামে ত্যাগ। সাধারণত বলা হয়, ধর্মীয় ত্যাগপ্রক্রিয়ার মধ্যে কোনরকম আপোষ চলে না। অর্থাৎ গরু কিনে কোরবানি দিলাম অথচ হাসিলের টাকা ঠিকমতো দিলাম না, তা হলে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সেটি কোরবানি হিসেবে গৃহীত হবে না।

ইংরেজ লেখক ফ্রান্সিস বেকনের "অব টু্রথ" বা "সত্য" নামক যে ক্ষুদ্র কিন্তু এ্যাটম বোমার মতো শক্তিশালী রচনাটি আছে তা'তে তিনি সততা ও মানবচরিত্রের মধ্যে মিথ্যাপ্রিয়তার সম্পর্ক বোঝাতে ফরাসী মনীষী মতেঁর একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন। মতেঁ বলেছেন, সাধারণ মানুষ পুলিশকে মিথ্যা বলতে ভয় পায়, কিন্তু ঈশ্বরের সঙ্গে মিথ্যা আচরণ করতে ভয় পায় না। যদিও ঈশ্বরপ্রদত্ত শাস্তি হচ্ছে অভ্রান্তভাবে কার্যকর। অর্থাৎ, ধর্মীয় দিক থেকে বললে, মানুষ মানবপ্রদত্ত শাস্তিকে ভয় পায়, কিন্তু ঈশ্বরপ্রদত্ত শাস্তিকে ভয় পায় না। হাসিলের টাকা ফাঁকি দিয়ে যারা কোরবানি করছেন, তারা ধর্মীয় অর্থে আলস্নাহ্্তা'লার সঙ্গে বেইমানি করছেন, কিন্তু হাসিলওয়ালা ছেলেটিকে হয়ত অর্জিত ফাঁকির পয়সা থেকে বখশিস দিতে কোশিষ করছেন না।

আবার এটাও মনে হলো। কোরবানির সময় হাট বসানোর ডাক দেয় সাধারণত সরকারি দলের নীচের স্তরের নেতা-কর্মীরা। রাজনৈতিক সরকারের ব্যবহারবিধির মধ্যে সমর্থকগোষ্ঠী ঠিক রাখার জন্য পুরস্কার-রীতি সচল রাখা একটা চালু ব্যবস্থা। টোল তোলা, বাজার তোলা, হাট তোলা ইত্যাকার নানা মৌসুমী কাজ আছে যা সাধারণত সরকারি দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীর মধ্যে বন্টনকৃত হয়ে থাকে। এ পুরস্কার-ব্যবস্থা থাকে বলে সরকারি দলসহ বিরোধী দলের রাজনৈতিক দলগুলোর পান্ডাবৃত্তি সচল থাকে।

একটা ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিলাম এবং একটা রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দিলাম। কিন্তু আমার লাগল কোথায়? কেন আমি এত চটে উঠলাম? কেনইবা হাসিল আদায়কারী যুবকের চা-পানি খাওয়ার আবদার থেকে জাতির ভিক্ষাবৃত্তির মানসিকতার কথা আমার মনে আসল? এটা আসলে আমি দেখলাম, আমার বা আমাদের অনেকের চেতনার গভীরে যুগ যুগ ধরে একটা বেদনা পুঞ্জীভূত হয়ে উঠছে, এবং সে বেদনাই হঠাৎ করে প্রতিবাদের মতো আমাদের মনে ফুঁসে উঠেছিল। যদিও উপলক্ষটি ছিল সামান্য। ঐ লোকটি যে টাকা চাইল, আর আমার যে খারাপ লাগল, তার কারণ হচ্ছে আমি বা আমরা অনেকে চাই না যে, আমরা ঐভাবে ভিক্ষুকের মতো আচরণ করি। আমি চাই না আমি শুনি এ কথা যে, আমাদের দেশ গরিব, আমাদের কিচ্ছু হবে না, আমরা চিরকাল এরকম থাকব।

এ দাস্য আচরণ করার মনোভাব আমাদের মধ্যে আসে কোত্থেকে? দীর্ঘদিন রাজনৈতিকভাবে আমরা দাসত্বের মধ্যে ছিলাম বলে? তাই নতজানু হয়ে হাত পাতার অভ্যাস গড়ে তুলেছি? যে কোন বেদনা ক্ষোভ হয়ে ফুঁসে ওঠার একটি উপলক্ষ থাকে। আমারটাও বলি। সেবছর (সন মনে নেই) চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলার একটি ঐতিহাসিক আলোকচিত্র ও চিত্রের প্রদর্শনী খুব জমেছিল। একটা তৈলচিত্র দেখলাম: মহিশুরের বীর টিপু সুলতানের দুই পুত্রকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারা হচ্ছে দেশদ্রোহী হিসেবে। কারা মারছে? ইংরেজ সরকার।

আমি পরাধীনতার ইতিহাসের ওপর অন্য অনেকের মতো বহু বই পড়েছি, বহু ছবি দেখেছি, কিন্তু ঐ ছবিটিই একটি স্থায়ী চিত্রকল্পের মতো আমার মনে গাঁথা হয়ে আছে। পরাধীনতার এ নির্মমতার প্রতিবাদে আমার মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এবং তারই ধারাবাহিকতায় কোথাও দাস্য মনোভাবের প্রকাশ দেখলে ক্ষেপে উঠি। ঠিক সেদিন কোন একটা পত্রিকায় দেখলাম আফগানিস্তানের কাবুলের একটি নিরালা রাস্তায় প্রহরা দিচ্ছে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ন্যাটোর এক জার্মান সৈন্য। চিন্তা করলাম, ইউরোপিয়ান কোন দেশের কোন রাস্তায় তো আফগানিস্তানের কোন সৈন্য প্রহরা দেবে না? এখানেও যেন দাস্যবৃত্তির নবায়ন হচ্ছে। আমার আলোচনাটা ঔপনিবেশিক রাজনীতির সামরিক বা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব নিয়ে নয়, আমার আলোচনাটা হচ্ছে, এ যে আমরা দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে পরমুখাপেক্ষী হয়ে রইলাম, হাত পাততে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম, বখশিসমুখি একটি জাতিতে পরিণত হয়ে রইলাম-এর থেকে মুক্তির উপায় কি? আমার একজন দীর্ঘদিনের বন্ধু আছেন, অসম্ভব মেধাবী প্রকৌশলী।

নিজে বড় চাকরিতে থেকে অবসর নিয়েছেন। ছেলেমেয়ে সবাই যথারীতি বাইরে। কিন্তু সারাজীবন দেখলাম তিনি শুধু দেশের সমালোচনাই করে গেলেন। এটা হচ্ছে না, ওটা হচ্ছে না, বিদেশেতো ্এরকম না। একদিন তাঁকে আহত না করে ভদ্রভাবে বললাম, আরেকজন করবে সেটা আশা করছেন কেন, আপনি নিজেইতো অনেক দায়িত্বশীল পদে ছিলেন, কী করেছেন দেশের জন্য।

তিনি বললেন, তিনি নাকি দেশের জন্য যা করেছেন, দেশ কখনো তা শোধ করতে পারবে না। বললাম, ব্যাপারটি কি এরকম যে, দেশের জন্য শুধু একবার একটি কাজ করে থেমে যেতে হবে? আমার এ বন্ধু চাকরি থেকে অবসর নেবার পর নিজে এখন একটি গাড়ি কিনেছেন। কথায় কথায় বললাম, চট্টগ্রাম গেছিলাম গাড়ি নিয়ে ফিটনেস নবায়ন করাতে। তিনি সবিস্ময়ে বললেন, কেন, গাড়ির আবার ফিটনেস করাতে হয় নাকি? তিনি চাকরির শুরু থেকে কোম্পানির গাড়ি ব্যবহার করতে করতে জানতেই পারেন নি যে, ফিটনেস পরীক্ষা এবং তার নবায়ন বলে একটি কথা আছে। এ অজ্ঞানতা অবশ্যই নিজের প্রতি আশকারাযুক্ত।

কিন্তু এটিও খুব সূক্ষ্ম অর্থে ঐ হাত পাতার মানসিকতার সঙ্গে যুক্ত। আজকেই সকালে ঘর থেকে বের হবার সময় জুতা-মোজা পরছিলাম। হঠাৎ একটা দৃশ্য ভেসে উঠল। নব্বই দশকের শুরুতে একবার শ্রীমঙ্গল চা-বাগানে এক বন্ধু-ম্যানেজারের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলাম। সকালে যখন আমার বন্ধু অফিসে যাবে, তখন দেখি সে পা দু'টো মেলে ধরেছে আর বাংলোয় কর্মরত একজন ভৃত্য তাঁকেঙ্মা যেভাবে শিশুকে স্কুলে যাবার সময়ঙ্প্রথমে মোজা পরিয়ে দিল, তারপর পরাল জুতোটুকু, জুতো পরিয়ে আবার ফিতা মেরে দিল।

ওখানে নাকি ঐটাই রীতি। এ না হলে নাকি বাগানের শৃঙ্খলা ঠিক থাকে না। যদি ভাবি, তা হলে দেখব যে, ওপরের হাসিল আদায়কারী যুবকের সঙ্গে আমার বন্ধুর ফিটনেস সম্পর্কে জ্ঞাত না থাকা এবং অন্য বন্ধুর ভৃত্যের কাছ থেকে জুতো বাঁধায় সেবাগ্রহণ সবই একই দাস্য মনোভাব থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এ দাস্য-মানসিকতা যে শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে ক্রমাগত জ্বালানি পাচ্ছে তার ব্যাখ্যা আগামী লেখায় করা যাবে। [লেখক: সাবেক অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও অধ্যাপক, ইউল্যাব, ঢাকা]


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।