লেখক/কবি
প্রকৃতিবিদ চার্লস রবার্ট ডারউইনের জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ প্রজাতির উৎপত্তি (THE ORIGIN OF SPECIES BY MEANS OF NATURAL SELECTION)। বইটি ১৮৪৯ সালের ২৪ নভেম্বর প্রকাশিত হয়। এ যাবত প্রকাশিত বিজ্ঞানের কোনো বই যদি মানুষের চিন্তার জগতে বিপ্লব ও পুরো মানব ইতিহাসে যুগান্তর ঘটাতে পারে, তাহলে সেটি হচ্ছে এই অরিজিন অফ স্পিশিজ। মানবজ্ঞানের এমন কোনো শাখা নেই যাকে এ বইতে সবিস্তারে ব্যাখ্যা করা, স্পর্শ করা বিবর্তন তত্ত্বের সাহায্যে তুলে ধরা বা তাকে বদলে দেয়নি।
এ তত্ত্ব নিয়ে বিখ্যাত মার্কিন বিবর্তনবাদী ও বংশগতিবিদ থিওডোসিয়াস ডবঝনস্কির (১৯৭৩) বক্তব্য হলো এরকম- বিবর্তনের আলোকে না দেখলে জীববিজ্ঞানের কোনো কিছুরই অর্থ হয় না।
এপ্রসঙ্গে বলেছেন, প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে বিধৃত তত্ত্ব হচ্ছে বিবর্তন তত্ত্ব আর সেক্ষেত্রে ডারউইনবাদই হচ্ছে বিবর্তনের সেই আলোকবর্তিকা। কিন্তু তার একথা বিশ্বাস করতে হলে আরো বিশ্বাস করতে হবে যে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন আধুনিক মানুষ হতে হলে, বিবর্তনবিদ্যা সম্পর্কে সম্যকধারণা থাকা একান্ত প্রয়োজন। এজন্য ডারউইন পাঠের কোনো বিকল্প নেই। বংশ গতিবিদ্যার জ্ঞানের অভাবে ডারউইনবাদের যে অসম্পূর্ণতা ছিল ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে বেশ কয়েক বিজ্ঞানির অক্লান্ত পরিশ্রমে পূরণ করা হয়েছে। তাদের অবদানে সমৃদ্ধ আকারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিবর্তনবাদের একটি আধুনিকতম ব্যাখ্যা- বিবর্তনের সংশ্লেষণী তত্ত্ব।
তবে ডারউইন তত্ত্বের ভুল ব্যাখ্যা ও পর্যালোচনার কারণে এরই মধ্যে আমাদের অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়েছে। এ তত্ত্বের উৎসাহী সমর্থকদের মাঝে ছিলেন প্রখ্যাত বৃটিশ দার্শনিক হারবার্ট স্পেনসার ও মার্কসবাদের প্রতিষ্ঠাতা জার্মান দার্শনিক অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্কস এবং আরো অনেক ইতিহাসবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, সাহিত্যিকসহ নানা পেশার ব্যক্তিরা। তারা তাদের মত প্রচারে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ফলে জন্ম নেয় এমন এক তত্ত্ব যাকে এখন আমরা বলি ডারউইনবাদ। বিজ্ঞানীরা কিন্তু এতে খুব কমই ভূমিকা পালন করেছেন।
ডারউইনবাদের জন্য এতে কিছু বিপদেরও সৃষ্টি হয়। সমর্থকরা নিজেদের জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে এমন সব কথাবার্তা চালু করলেন, যা ডারউইন নিজের জীবদ্দশায় কখনোই বলেননি বা বলতে চাননি। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস মানবসমাজের বিপ্লবের কথা বলতে গিয়ে বিশেষজ্ঞ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অনিবার্যতার কথা বলেছেন। মার্কস তার শ্রেণী সংগ্রাম (ক) জীবজগতের ডারউইনীয় প্রক্রিয়ার ‘জীবন সংগ্রাম’-এর সমর্থক বলে মনে করেছেন অথচ ডারউইন এ ধরনের বক্তব্যকে সমর্থন করেননি। অন্যদিকে স্পেনসার ছিলেন তথাকথিত ‘সামাজিক ডারউইনবাদ’-এর প্রধান বক্তা।
সমাজেও নির্মমভাবে ‘টিকে থাকার সংগ্রাম’ চলে এতে যোগ্যতমই উঁচু স্তরে থাকে- এ ছিল তার তত্ত্বের মূল কথা। ডারউইন নিজে কখনোই এমন কথা বলেননি। তাই এ তত্ত্বে ডারউইনের নাম ব্যবহার করাও ছিল নিতান্ত অন্যায়। সামাজিক ডারউইনবাদের মারাত্মক পরিণতি ফ্যাসিবাদ ও বর্ণবাদ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মূল্য দিয়ে মানুষ এ ভুল তত্ত্বের মর্ম উপলব্ধি করেছে। বিবর্তনের অর্থ আবশ্যকীয়ভাবে, অনিবার্যভাবে, নিম্নতর থেকে উচ্চতর স্তরের দিকে অগ্রসরমান, সরলতম থেকে জটিলতর স্তরে উত্তরণ জনপ্রিয় এ ধারণাটি মূলত স্পেনসারের অবদান হওয়া সত্ত্বেও তা ডারউইরের মত বলেই প্রচার লাভ করেছে অথচ বানর থেকে মানুষ- একথা ডারউইন কখনোই বলেননি।
যারা এমন কথা বলেন, তারা সঠিক চিন্তাও করেন না। কারণ ডারউইনের মতে, বিবর্তনে অনিবার্যতা বলে কিছু নেই। আর জীবজগতে নিম্ন বা উচ্চতর স্তর বলে কিছু আছে তা তিনি আদৌ মনে করতেন না। তিনি জোর দিয়েছেন যোগ্যতা অযোগ্যতার ওপর। তবু তার জীবৎকালসহ শত বছর পরও নৃবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিদ্যা প্রভৃতি সামাজিকবিজ্ঞানে এটিই ডারউইনের মত বলে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আসছে।
এজন্য কাউকে যদি দায়ী করতেই হয়, তাহলে সেই ব্যক্তি নিঃসন্দেহে স্পেনসার, কারণ তার লেখার পরই অনেকের মধ্যে এ ধারণার সৃষ্টি হয়।
ডারউইন তত্ত্বের বিভিন্ন ভুল ব্যাখ্যার উপস্থাপনা, নতুন সব উদ্ভট তত্ত্বের রূপ দানসহ বিভিন্ন কারণে ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গেও জীববিজ্ঞানের দূরত্ব করতে থাকে। (প্রজাতির উৎপত্তি ভাষান্তর ম. আক্তারুজ্জামান- বাংলা একাডেমী)
উনিশ শতকের পুরোটা জুড়েই ডারুইনের তত্ত্ব নিয়ে বিতর্কের এমন আরো অনেক উন্মাদনা অব্যাহত ছিল আর এতে চার্চের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত শত্রুভাবাপন্ন। গতবছর ডারউনের দুই শততম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে। সেসঙ্গে পালিত হলো তার লেখা কালজয়ী বই অরিজিন অফ স্পিশিজের প্রকাশনার দেড় শততম বার্ষিকী।
এ উভয় ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে চার্চ অফ ইংল্যান্ডের গণসংযোগ বিভাগের প্রধান রেভারেন্ড ম্যালকম ব্রাউন এক বাণী প্রকাশ করেন। এতে তিনি বলেন, বিবর্তনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের প্রতিক্রিয়ায় উনিশ শতকের শত্রুভাবাপন্নতার জন্য চার্চ অব ইংল্যান্ডকে চার্লস ডারউইনের কাছে দুঃখ প্রকাশ করা উচিত। ব্রাউন বলেন, গবেষণা ফলাফল প্রকাশের সময় থেকে ভুল বুঝে আসার কারণে চার্চ অফ ইংল্যান্ডকে দুঃখ প্রকাশ করা উচিত। শুধু তাই নয়, চার্চের ভুল বোঝার কারণে অন্যরাও ডারউইনকে নানাভাবে ভুল বুঝেছে আর সে জন্যই চার্চকে ক্ষমাপ্রার্থী হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। তবে চার্চ অফ ইংল্যান্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ব্রাউনের বক্তব্যে ডারউইনের প্রতি তার আস্থাও অবস্থান পরিস্ফুট হয়েছে মাত্র।
কিন্তু আনুষ্ঠানিক কোনো ক্ষমা চাওয়ার আইনগত অধিকার তার নেই।
এই ইংল্যান্ডেই ডারউইনের জন্ম। এখানকার বোর্ডিং স্কুলে তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেন এবং একজন ইংরেজি ধর্মযাজক হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণগ্রহণ করেন। তারপরও সেই চার্চের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজাতিগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ক্রমে বিবর্তন ঘটছে বিবর্তনের এমন তত্ত্ব প্রকাশের কারণে।
চার্চ অফ ইংল্যান্ড ডারউইনের তত্ত্বের বিরুদ্ধে এ যাবত কোনো দাপ্তরিক অবস্থান ঘোষণা না করলেও বয়োজ্যেষ্ঠ অনেক ইংরেজ তার ধারণার সঙ্গে চরম বিরোধিতা প্রকাশ করে।
এদের কেউ কেউ আবার তাদের শত্রুতার বিষ উগরে দিতে জনসমক্ষে বিতর্কের আয়োজন করে। এ ধরনের একটি বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৬০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিতর্কের এক পর্যায়ে অক্সফোর্ডের বিশপ স্যামুয়েল উইলবার ফোর্স উপস্থিত বিজ্ঞানী টমাস হাক্সলোর প্রতি তার বিখ্যাত প্রশ্ন ছুড়ে দেন, যেহেতু সে বানরের বংশধর বলে দাবি করছে, তাই তার দাদা বা দাদির কেউ আদৌ বানর ছিলেন কি না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।