যুগ যুগ ধরে সয়ে যাওয়া লাঞ্ছনা, বঞ্ছনা, যন্ত্রণার বিরুদ্ধে মানুষের ােভের প্রকাশ বিস্ফোরণের রূপ ধারণ করে। খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্য গড়ে প্রবল প্রতিবাদ জানায় শোষকের রক্তচুকে - আর পরিণামে চলে দুঃসহ, নির্যাতন, দমন, নিপীড়ন - এমন ঘটনার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ইতিহাসের পাতায় পাতায়। এই দৃষ্টান্তসমূহের মধ্যে নতুন সংযোজন কানসাট।
কানসাটের পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন পরিষদ দাবী করেছে ‘বিদ্যুৎ সরবরাহের’, কারণ কৃষি উৎপাদনে জলসেচের জন্য বিদ্যুৎ প্রয়োজন - এই চাহিদা পূরণ করতে। অর্থাৎ ‘উৎপাদনের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ’ই হচ্ছে এই দাবীর মূলকথা।
যে কোন সভ্য, সুশীল, আধুনিক, উন্নয়নকাঙ্খী রাষ্ট্রের সরকারের কাছে ‘উৎপাদনের জন্য অবকাঠামো সহায়তার’ বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। আবার বলছি, কানসাটের মানুষ বিদ্যুৎ দাবী করেছে ‘কৃষি উৎপাদনের’ জন্য; অতিষ্ঠ গরমে এসি, ফ্যান চালানো বা নির্বিঘেœ টিভিতে খেলা দেখার জন্য নয়।
অথচ এই দাবীকে কেবল অগ্রাহ্যই করা হল না - গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করা হল, রাতে বাড়িতে বাড়িতে লুট চলল (এবং নারী ধর্ষণের খবরও পত্রিকায় এসেছে)। আর কানসাটের মানুষ প্রত্য করল এই হত্যা-লুট-ধর্ষণ করেছে রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত পুলিশ এবং মতাসীন দলের কর্মীরা।
কৃষি প্রধান একটি দেশের ‘কৃষি উৎপাদন’ মতাসীন সরকারের কাছে কোন অগ্রাধিকার পেল না।
রাষ্ট্র পরিচালনার েেত্র দারিদ্র্যবিমুখ, উন্নয়ন পরিপন্থী অবস্থান সুস্পষ্ট করল বর্তমান সরকার। আর সেইসাথে ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবীকে রাষ্ট্রের আইন শৃংখলার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ বাহিনী এবং সেইসাথে নিজ দলীয় কর্মীদের দিয়ে কিশোর আনোয়ারসহ আরও অনেককে (২৪ জনের বেশি) হত্যা করে - মানুষের অধিকার আদায়ের দাবীকে দমন-নিপীড়ন-নির্যাতন করে স্তিমিত করার যে কৌশল রয়েছে তার আরেকটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করল সরকার।
শোষকের নিপীড়নমূলক নীতি-কৌশলের জন্য বাস্তুচ্যুত হয়েছে অনেক পরিবার, কিশোর আনোয়ারের লাশ দেখে নিশ্চুপ হয়ে গেছেন তার বাবা। কিন্তু সম্মিলিত মানুষের প্রতিবাদের ঢল আর বজ্রনাদ থামেনি। মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, নানা বয়সের নারী-পুরুষ লাঠি, দা নিয়ে মিছিল করে প্রতিবাদ জানিয়েছে, আন্দোলন গড়ে তুলেছে।
এত মানুষকে কোন রাজনৈতিক দল একত্রিত করেনি - দুর্যোগই মানুষকে একত্রিত করেছে। হ্যাঁ, এদের লাঠি, দা এর শক্তিকে পুলিশ আর সরকারের দলীয় বাহিনীর টিয়ার শেল, বন্দুক, গুলি দিয়ে দাবানোও যেতে পারে। হয়ত দেখা যেতে পারে অসহনীয়, অকথ্য, ভয়ংকর শক্তি ব্যবহার করে কানসাটের গ্রামবাসীকে স্তিমিত করে দেয়া হয়েছে। অথবা নিতান্ত বাধ্য হয়ে পরিস্থিতি শান্ত করতে সমঝোতা আলোচনার উদ্যোগ নেয়া হবে। আবার, আজকে যে-ই খবরের কাগজ, মিডিয়ার ফোকাস হচ্ছে কানসাটে, অন্য কোন ঘটনার তোড়ে এই ফোকাস স্থানান্তর হয়ে যাবে।
(কয়েক মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আর্ট কলেজে ছাত্রীদের উপর দলীয় শিক ও ছাত্রদল কর্মীদের আক্রমণের ঘটনা সমগ্র পত্রিকা, মিডিয়া আর মানুষ মনোযোগ দিয়ে পর্যবেণ করছিল। তার ক’দিনের মধ্যেই এরশাদ-বিদিশার পারিবারিক সম্পর্কের মতো এত ুদ্র, তুচ্ছ একটি বিষয়ের দিকে মনোযোগ স্থানান্তর হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি শিা প্রতিষ্ঠানের এতবড় কলংকজনক ঘটনার কোন প্রতিকার হল না। শিার্থীদের ফুটওভার নির্মাণের দাবী ছিল, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। )
তারপরও, কানসাটের মানুষ এই একবিংশ শতাব্দীতে গণবিমুখ, নিপীড়ক শোষকের বিরুদ্ধে পুরোপুরিই সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্ত, সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করল।
ীণ আশা করা যায়, এই সম্মিলিত প্রয়াস, তাজা প্রাণের বিসর্জন শুধু বাংলাদেশের নিপীড়ত মানুষের জন্যই নয় - সারাবিশ্বের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের অসভ্য, বর্বর শোষক চক্রের বিপে ঝাঁপিয়ে পড়ে গগণবিদারী হুংকার তুলতে উত্তাপ ও আলো দেবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।