দেশের সর্বত্রই এখন নানা রকম ফলের সমাহার। আম, লিচু, কাঁঠাল, আনারস, জামসহ আরো কত সুস্বাদু ফল বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। এ ফল বাঙালির জন্য অনেকটা উৎসবের আনন্দ বয়ে আনে। আর এ ফলের উৎসবের রাজা হচ্ছে আম। আর আমের রাজা চাঁপাইয়ের আম।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট আমের বাজারকে বলা হয় 'আম রাজ্যের প্রাণ'। অনেকে একে আমের রাজধানীও বলে থাকেন। দেশের সবচেয়ে বড় আমের বাজার বসে এ কানসাটেই। নানা জাতের আম পাওয়া যাবে কানসাট বাজারে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ফজলি ছাড়া অন্য সব আম পাওয়া যাবে।
এরপর দেড় দু'মাসজুড়ে কেবল ফজলি আম পাওয়া যাবে।
আমের বাজারের জন্য এলাকাটি বিখ্যাত হলেও দেশবাসীর কাছে কানসাটের পরিচিতি এনে দেয় বিদ্যুতের দাবিতে জনবিক্ষোভ। বিএনপি সরকারের শেষদিকে এ বিক্ষোভের ফলে কানসাটের নিজস্ব পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আমের জন্য বিখ্যাত হলেও এখনো তা রাজশাহীর আম বলেই দেশবাসীর কাছে পরিচিত। এর কারণ চাঁপাইনবাবগঞ্জ একসময় রাহশাহীর অংশই ছিল।
আমকেই শিবগঞ্জের অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রধান চালিকাশক্তি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। অনেক সময় শিবগঞ্জের আমকে অর্থভা-ারও বলা হয়ে থাকে। আর এ কারণে প্রতি বছর শিবগঞ্জ উপজেলায় আমবাগানের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কমে যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ফসলি জমি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমচাষের গুরুত্ব আগের তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে।
জেলার ৫টি উপজেলায় আমবাগানের জমির পরিমাণ ২২ হাজার ৩০০ হেক্টরের মধ্যে শিবগঞ্জে প্রায় ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে আমচাষ হয়ে থাকে। তাই মৌসুমে আম-বাণিজ্য নিয়ে স্থানীয় ব্যাংকগুলোও থাকে তৎপর।
কানসাটের আমের বাজার ভোরে শুরু হয়ে চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এখানকার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আম আসে সারাদিন বিভিন্ন পথে। কেউ আবার সাইকেলের মাঝে এক টুকরো কাঠ দিয়ে দু'পাশে বড় বড় ঝুড়িভর্তি করে আম নিয়ে আসেন বাজারে।
কেউ রিকশা-ভ্যানে। বাজারে এনে আম বিক্রি করা হয় পাইকার ও আড়তদারদের কাছে। তারা সে আম সরবরাহ করেন দেশের বিভিন্ন স্থানে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমবাগান সারাবছর কেনা-বেচা হয়ে থাকে। কোনো বাগানের আম মুকুলের আগেই বিক্রি হয়ে যায়।
আবার কোনোটা বিক্রি হয় মুকুল আসার পর, কোনোটা আম হওয়ার পর। এ কারণে বছরজুড়েই চলে কেনা-বেচা।
আম মৌসুমকে ঘিরে শিবগঞ্জের কানসাট, শিবগঞ্জ পৌরসভা মার্কেট, রানীহাটি, ছত্রাজিতপুর, বিনোদপুর, খাসেরহাট, মনাকষা, মোবারকপুর, চককীর্ত্তিসহ বিভিন্ন হাটবাজারে প্রতি বছরই গড়ে ওঠে অসংখ্য আমের আড়ত। এছাড়া বিভিন্ন বাগানকেন্দ্রিকও আড়ত গড়ে ওঠে। প্রতিদিন এসব আমের আড়ত থেকে সহস্রাধিক ট্রাক আম ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়।
কানসাট ও শিবগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী বাসের ছাদেও গাছপাকা আম ব্যবসায়ীরা পাঠিয়ে থাকেন।
আম মৌসুমে রিকশা-ভ্যান, ভটিভটি, নছিমন, করিমন, ট্রলি পরিবহন শিল্পে পরিণত হয়ে থাকে। আম মৌসুমে পরিবহন ক্ষেত্রে যোগ হয় কুরিয়ার সার্ভিস। কুরিয়ার সার্ভিসগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে আম পৌঁছে দিয়ে থাকে। অপরদিকে গাছ থেকে আম পাড়া, আড়তে টুকরি করা, লোড-আনলোড, আমবাগানে জোগানদারি ইত্যাদি কাজেও কর্মরত থাকেন হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ।
জেলার বাইরে আম পাঠানোর জন্য তৈরি হয়ে থাকে বাঁশের ঝুড়ি।
জানা গেছে, অন্যান্য ফসল আবাদে যে পরিমাণ খরচ বাড়ে, আমগাছ এবং এর পরিচর্যাসহ রোগবালাই দমনে খরচ তেমন হয় না। আর আগাম বিক্রি করলে ক্রেতাই সবকিছু দেখভাল করে থাকেন। অনেক বাগান কয়েক বছরের চুক্রিতেও বিক্রি হয়ে থাকে। এছাড়া আমের দামও আগের চেয়ে অনেক বেশি এবং জমিতে আমগাছ লাগিয়ে সাথী ফসল হিসেবে অন্যান্য ফসল উৎপাদন করেও চাষীরা লাভবান হয়ে থাকেন।
চুক্তিতে বিক্রি হওয়া জমিতে সম্প্রতি ক্রেতারা বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করছেন। এসব রাসায়নিক ফলন বাড়িয়ে দেয়, যা গাছের ক্ষতি করে। বর্তমানে বাজারে এমন এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া যায়, যা ব্যবহারে তিন-চার বছর ফলন বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এ রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারে গাছে পাতা না থাকলেও ফলন হয়, যা ভারত থেকে চোরাইপথে আমদানি করা হয়ে থাকে।
এক আম ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারত থেকে চোরাইপথে আমদানি করা রাসায়নিক পদার্থ প্রতি লিটার ২ হাজার টাকা।
এ রাসায়নিক গাছের এক ফুট দূরে চারদিক দিয়ে সামান্য গর্ত করে দিয়ে তার ওপর মাটি দিতে হয়। একবার এ রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করলে ৩-৪ বছর একটানা আম হবে। কিন্তু এর পরের বছর আর আম হবে না। অনেক ক্ষেত্রে গাছও মারা যেতে পারে। আমের দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার বেড়ে গেছে বলেও ব্যবসায়ীরা জানান।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের জাত রয়েছে প্রায় ৩০০টি। মাঘ-ফাল্গুন মাসে একই সময়ে এই ৩০০ জাতের আমগাছে মুকুল এলেও আগাম, মধ্যম ও নাবিথ এ ৩ ভাগে আম পাকতে শুরু করে। আম পাকার ওপর বাজারজাতকরণ নির্ভর হয়ে থাকে। উন্নত জাত এবং গুটিআম বাছাইয়ে আমচাষীকে নতুন নতুনভাবে নার্সারিতে চারা উৎপাদন করতে হয়। আঁটি আমের চারায় উন্নতজাতের আমের মাতৃগুণ থাকে না।
তাই প্রতি বছর প্রতিটি আমের চারার সঙ্গে উন্নতজাতের আমগাছের কচিডাল বেঁধে আধুনিক পদ্ধতিতে উন্নতজাতের আমে রূপান্তরিত করা হয়। গ্রাফটিং এবং কলমজাতথ এ দুই পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বর্তমানে শিবগঞ্জে গুটিজাত আমের বেশ কদর।
স্থানীয় লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকায় পাঠানোর সময় ব্যবসায়ীরা আমের মধ্যে এক ধরনের স্প্রে করে থাকেন, যা ব্যবহারে আমের পচন রোধ করা হয়। এছাড়া ভারতের আমকেও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বলে বিক্রি করা হয়।
আর ভারতের আমে রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকে। বর্তমানে স্থানীয় বাজারেও ভারতের আমকে চাঁপাইর আম বলে বিক্রি করা হচ্ছে। এসব আম চাঁপাইলাগোয়া ভারতের আশপাশের জেলা থেকে আনা হয়।
কিছু ছবি চলন্ত গাড়ি এবং মটর সাইকেল থেকে তোলা হয়েছে
আর সব ছবিই মোবাইলে তোলা ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।