অদ্ভূত বিষয়গুলোতে বিস্ময়াভূত হওয়া একটি চমকপ্রদ ব্যাপার!! লেখক মশাই জেলখানায়!!
সকাল বেলা কোত্থেকে ফোন এলে হঠাত্-ই গায়ে একটা সাধামাটা শার্ট গড়িয়ে আমাকে না বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ল ও। আমি ভাবলাম একবার ডাকব কিন্তু গুরুজনদের কড়া নিষেধ পিছন থেকে ডাকতে হয় না। ভাবলাম একটা ফোন দিয়ে জেনে নিব না হয়। কিন্তু মুসিবত হল যেই না আমি ফোন দিলাম ওমনি ফোনটা আমার কানের কাছেই বেজে উঠল। ফোনটাও ফেলে রেখে গেছে।
কিসের এত তাড়াহুড়া? মনটায় খচখচানি শুরু হয়ে গেল। এখন আমি কিভাবে জানব ও কোথায় গেল? মা-কে কি একটা ফোন দিব? না, কার কাছ থেকে ও ফোন পেয়ে এভাবে বেড়িয়ে গেল সেটা আগে জেনে নেই।
ওর ফোনটা তুলে নিলাম। লাস্ট রিসিভ কলটা আননোন। টি এন্ড টি থেকে করা।
ফোনটায় কল দিলাম। প্রথমে বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল। দ্বিতীয়বার একটুখানি বেজে বন্ধ হয়ে গেল। তৃতীয়বার ফোনে একজন কানে নিয়ে বলল, ব্যাস্ত আছি পাঁচ মিনিট পর ফোন দিন। চারপাশে একটু যেন ভিরভাট্টার শব্দ শুনলাম।
কে এই ব্যাস্ত লোক? পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে পারলাম না দুমিনিট পরই ফোন দিলাম। ফোন উঠিয়ে বলল, "হ্যালো ধানমন্ডি থানা। " আমার ভিতরটা ধ্বক করে উঠল। কোনমতে বললাম, কিছুক্ষন আগে আপনি এ নাম্বারে ফোন দিয়েছিলেন। তিনি খুব বিরক্ত হলেন, আরে ভাই আমাদের কাজই হল ফোন দেয়া আর রিসিভ করা।
আপনি কাকে চান সেটা বলুন তো।
আমি কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। ওর নামটা বলে বললাম আমি তার ওয়াইফ। এরপর কিছুক্ষন নিরবতা। আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে লোকটা কোথায় যেন চলে গেল।
তার আর ফিরে আসার কোন আলামত পাওয়া গেল না। চারদিকে মানুষের ভীষণমাত্রায় কথা শুনে শুনে আমার ভয়টা আরো বহুগুণমাত্রায় বেড়ে গেল। এভাবে ফোন ধরে রেখে সময় নষ্ট না করে ফোন কেটে তৈরি হয়ে নিজেও বেড়িয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য থানা।
থানায় পৌঁছে দেখি লেখকমশাই ওসির সামনে বসে আছেন।
আমি ভিতরে ঢুকতেই ও বলল, "ও তুমি এসেছো? ভাল করেছো। আমি ভাবছিলাম তোমাকে ফোন দিব কিন্তু মোবাইল ফেলে এসেছি। আর নাম্বারও মনে নাই। " আমি খুব দ্রুত ওর পাশে বসে পড়ে বললাম, "তুমি তোমার নাম্বারে ফোন দিতে পারতে। " ও বলল "হ্যা সে নাম্বারটাই তো মনে নাই।
" আমি আশ্চার্যান্বিত হলাম না। এটাই স্বাভাবিক। নাম্বার যদি ওর মনে থাকত তাহলে ফোনটা সাথে নিয়ে আসার কথাও মনে থাকত। আমি বললাম, "কিন্তু তুমি এখানে কেন?" কিছু একটা মনে পড়ে গেল সেই ভঙ্গিতে ও বলল, "ও হ্যা তোমাকে বলা হয় নি আমি এখানে কিছুদিন থাকব। "
আমি আকাশ থেকে নাকি কোত্থেকে পড়ব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
বললাম, থাকবে মানে কি? ও বলল, "কাজলকে এখানে কিছুদিন থাকতে হবে তাই ভাবছি কাজলের সাথে আমিও থাকব। " আমার ভাই কাজল যে এখানে এটা ও এতক্ষন আমাকে বলে নি। আমার চোখ বের হয়ে যাবার উপক্রম হল। বললাম, "কাজল এখানে কি করে?" এতক্ষন ওসি সাহেব চুপচাপ কাজ করছিলেন এবার আমার দিকে চেয়ে বললেন, "দেখুন আপনারা ঘরোয়া আলাপ ঘরে গিয়ে করুন। অযথা এখানে ভীর বাড়াবেন না।
কাজল কয়েকজন লোকের সাথে রাস্তায় একটা পকেট মারকে ধরে মারধর করছিল। তাই আমরা তাঁকে ধরে নিয়ে এসেছি। " আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। ওর দিকে ভালভাবে তাকালাম। বললাম, "কাজলকে থানায় ধরে নিয়ে এসেছে আর তুমি এখানে তামাশা করতেছো? এখনি কাজলকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করো।
" ও-ও সোজা আমার দিকে ফিরল। বলল, "দেখো কাজলের সাথে আমার সমস্ত কথা ফাইনাল হয়ে গেছে। ও বলেছে আমি যদি থাকি তাহলে ও-ও থাকতে পারবে। " আমি বললাম, "মানে কি? তুমি এখানে থাকতে চাচ্ছ কেন?" ও কি যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল। একবার ওসির দিকে তাকালো তারপর হাত ধরে টেনে আমাকে বাইরে নিয়ে এল।
বলল, "শোন এরকম একটা সুযোগ আমি হাতছাড়া করতে চাই না। " আমি চিত্কামর করে উঠলাম, "সুযোগ মানে কি বলতে চাইছো তুমি?" ও গলাটা একটু নিচু করে এনে বলল, "আমার অনেকদিনের শখ জেলে থাকব। নতুন একটা পান্ডুলিপি লিখছি। গল্পটা
মোর নিয়েছে। হাজতবাসের কিছু ব্যাপার আছে এখানে।
তাই নিজে হাজতবাস করে সম্পূর্ণ নিজের উপলব্ধি থেকে গল্পটা লিখব। " আমার মাথা ঘুরে উঠল। ও কি বুঝতে পারছে না ও কি করতে চাইছে? এমনসময় সটাং করে ও আমার হাত চেপে ধরল। বলল,"তোমাকে একটা উপকার করতে হবে। তুমি আগামী তিনদিন আমাদেরকে ছাড়াতে আসবে না।
আর তোমাদের বাসায়ও কাউকে কিছু জানাবে না। " আমি ওর পাগলামী দেখে ক্রমাগত অবাক হচ্ছি। আমি বুঝতে পারছিলাম না ও কি আমার সাথে মজা করছে নাকি সিরিয়াস। একপর্যায়ে আমার রাগ চেপে গেল। বললাম, "তুমি যেখানে খুশি সেখানে থাকো।
পারলে জাহান্নামে যাও। আমার ভাইকে আমি ছাড়িয়ে নিয়ে যাব। " ও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, "রেগে যাচ্ছো কেন? আমি তো কাজলকে ছাড়াতেই এসেছিলাম। কিন্তু এখানে এসে আমার ধারণা পরিবর্তন হয়ে যায়। আমি এখন হাজতবাসী হতে চাই।
" হাজতবাসী যেন চাইলেই হওয়া যায়। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। বললাম, "অহেতুক ওরা তোমাকে এখানে তিনদিন পুষবে কেন?" "দাড়াও দেখাচ্ছি। " বলেই ও হেটে ভিতরে চলে গেল। আমি দরজায় দাড়িয়ে যা দেখলাম ওর এমন চরিত্র আমি আগে কখনই দেখি নাই।
ও গিয়ে ওসির দিকে আঙ্গুল তুলে মোটামুটি চিত্কাওর করে বলল, "এই শালা আপনি আমার শালাকে ছেড়ে দিবেন কিনা বলেন। " একথা বলায় ওসি দাড়িয়ে পড়ল আর ও গিয়ে ওসির কলার চেপে ধরি ধরি করতেই পিছন থেকে দুজন সেন্ট্রি এসে ওকে লকাপের ভিতর ঢুকিয়ে ফেলল।
আমি আর দাড়ালাম না। এমন একটি দৃশ্য দেখে ওখানে দাড়িয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। সোজা বাড়ি চলে এলাম এবং আগামী তিনদিন পর কেন ওকে ছাড়াতে আমি কখনই যাব না।
এত শখ যার হাজতে থাকা তাকে ছাড়াবো কেন? বাবা মা কাউকে কিছু বলিনি। বাবা এরমাঝে খোঁজ করেছে কাজল আমার বাসায় কিনা। বললাম দুলাভাইয়ের সাথে ট্যুরে গেছে।
আমি ওকে ছাড়াতে গেলাম না। সেদিন খুব অস্থির লাগছিল তবুও ওর কাছে গেলাম না।
তারপরদিন ও নিজেই এসে হাজির। উদ্ভ্রান্তের মত চেহাড়া হয়েছে। চোখের নিচে গভীর কালশিটে একটা দাগ। বললাম কি হয়েছে। ও হাত দিয়ে আমাকে সরিয়ে দিল।
কেন বাবা তুমিই তো বলেছিলে না ছাড়াতে তবে এখন কেন অভিমান। ও বাথরুমে ঢুকে গোছল করে নিল। আমি ফার্স্ট এইডের বক্স নিয়ে বাইরে দাড়িয়ে আছি। বের হলে ওকে একটু সেবা করতে যাব অমনি সে বক্সটা কেড়ে নিয়ে নিজেই নিজের সেবায় লেগে গেল। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ওরা তোমাকে মারধর করল কেন? এতক্ষনে ওর মুখ দিয়ে কথা বেরুলো, ওরা আমাকে মার
ওরা আমাকে মারধর করেনি।
আমি আর কাজল যেই সেলে ছিলাম ঐ সেলেই পরে সেই পকেটমারকে ঢোকানো হয়। উত্তেজনায় কাজল আমাকে জোরে জোরে বলে দিল যে এই সেই পকেটমার। সাথে সাথে পকেটমার উঠে এসে আমাকে....।
ওর এত দুঃখ স্বত্বেও আমার পেট ফেটে হাসি পেল। কোনমতে হাসি চেপে রেখে বললাম, "ভালই তো হল।
তুমি পরিপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন করলা। হাজতবাসের অভিজ্ঞতা চাইছিলে না?" সাথে সাথে দেখি ওর মুখ উজ্জল হয়ে উঠল পরক্ষণেই আবার কালো হয়ে গেল। বলল, কিন্তু তুমি তো আমাকে ছাড়াতে গেলে না। তুমি যদি জোর করতে তাহলে নিশ্চই আমিও জেলে থাকতে চাইতাম না। তুমিই তো আমাকে এভাবে জেলে যেতে দিলে।
আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম। নাহ বলেই দেই। বললাম, লোকটা একটু বেশি জোরেই মেরেছে। আমি বলেছিলাম হালকা একটু দিতে।
সাথে সাথে ওর চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
"আচ্ছা তুমি রীতাপাকে চিনো?" ও মাথা নাড়ল। আমি বলে চললাম, রীতাপার জামাই ধানমন্ডি থানার ওসি। সেদিন দুলাভাইয়ের সাথে আমার কাজলের কথা হয়। তুমি নাকি একদিন কাজলের কাছে জেলে থাকার ইচ্ছার কথা অভিব্যাক্ত করেছিলে? ও মাথা ওপর নিচ করল।
কাজল আমাকে ফোন দিয়ে সাবধান করল। বলল, "আপা দেখিস দুলাভাই কিন্তু যা তা কিছু একটা করে শেষমেষ জেলে যাইতে চাইবে। তুই তাঁকে দেখে রাখিস। " আমি প্রথমে বিশ্বাস না করলেও তোমার পান্ডুলিপির পাতা উল্টালে সবটা বুঝতে পারি। গল্পের নায়ককে তুমি জেলে পাঠিয়েছো।
ওই জায়গাটায় কেবল কাটাকাটি কাটাকাটি। তারমানে তুমি কিছু লিখতেই পারছো না। আর স্বাভাবিক এরপর তুমি নিজেই জেলে যাইতে চাবে। কখন কি অঘটন ঘটে বসাও তাই আমি আর কাজল মিলে এই ব্যবস্থা করি। তাতে তোমার হাজতবাসও হবে আর বেশি ভোগান্তি পোহাতেও হবে না।
ওর চোখ একটু একটু করে শেষমেষ কপালে উঠল। আমি ওর কালশিটে জায়গাটায় মৃদু স্পর্শ করে বললাম, "কিন্তু সত্যি বলছি আমি ছেলেটাকে এতটা জোরে মারতে বলিনি। বলেছিলাম বড়জোর একটু খামচে দিতে। "
ওর দেখি আরো বেশি অভিমান হয়ে গেল। আমার কাছ থেকে মুখ সরিয়ে অন্য দিকে চেয়ে রইল।
আমি মৃদু হাসার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হলাম। বাবুমশাইয়ের রাগ হয়েছে ভারি। কথাটিও আর বলছে না। ওর সামনে গিয়ে কানে ধরলাম। ও আরো অন্যদিকে ফিরে গেল।
আমিও সেদিকে গেলাম। এভাবে চক্রাকৃতি করে ওর চারপাশে ঘুরতে লাগলাম তবু আমার অভিমানি লেখক মশাইয়ের রাগ ভাঙে না। তবে একটু যেন ঠোঁটের কোণায় হাসি দেখতে পেলাম। আর তারপর থেকে ওর চারপাশে এমনি করে ঘুরতেই বেশ লাগছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।