চন্দ্রবিন্দুকে আমি চিনি চন্দ্রবিন্দুর প্রায় শুরু থেকে। কলকাতায় বেশ অনেক বছর আগে ওদের একটা গানের অনুষ্ঠান দেখেছিলাম। তখন সবে ওদের প্রথম সিডি বেরিয়েছে। চন্দ্রবিন্দুর সবাইকে আমার মনে হতো যেন কলকাতার বিটলস। এক গোছা উজ্জ্বল তরুণ।
অসম্ভব প্রতিভাবান। লেখেও অসাধারণ, সুরও করে অসাধারণ। একবিংশ শতাব্দির উপল, অনিন্দ্য আর চন্দ্রিলের মধ্যে দেখেছি ষাট দশকের জন লেনন আর পল ম্যাককার্টনির প্রতিভা। জন লেননের যেমন উল্টে পাল্টে ফেলার ক্ষমতা ছিল, সেই ক্ষমতা লক্ষ্য করেছি চন্দ্রিলের মধ্যে। গানের চিরাচরিত ভাষার বাইরে একটা নতুন ভাষা শুরু থেকেই ব্যবহার করছে চন্দ্রিল।
প্রথা ভেঙে বেরিয়ে গিয়েছে ও। প্রথা ভেঙেছিল জন লেননও। নিজের জীবনটাও প্রচলিত নিয়মের বাইরে যাপন করেছে। পৃথিবীর সব সাদা সোনালি সুন্দরীরা যখন জন লেননের জন্য উন্মাদ, তখন সে বিয়ে করে বসলো তার চেয়ে আট বছরের বড় এক ডিভোর্সী, বাচ্চাকাচ্চার মা, অসুন্দরী জাপানি মহিলাকে। পৃথিবী ভীষণ হতাশ।
জনের ওতে কিচ্ছু যায় আসেনি। গানের ছেলে হয়ে ভিয়েতনামের যুদ্ধের বিরুদ্ধে সে নেমে পড়লো, ন্যাংটো হয়ে ছবি তুললো প্রতিবাদে, বলে বেড়ালো গিভ পিস এ চান্স, নো ওয়ার মেইক লাভ। সমাজকে শব্দে আর সুরে শুধু নয়, তার প্রতি পদক্ষেপ দিয়েও ধাক্কা দিয়েছে। গানের জগতে আর কেউ ছিল না জনের মতো প্রখর বুদ্ধির সচেতন ছেলে। আই লাভ ইউ আর আই মিস ইউ বেবির জমানায় ইমাজিন নো রিলিজন এর মতো গান লেখা কজন গানের ছেলের পক্ষে সম্ভব তখন? কজন এমন বলতে পারতো, কল্পনা করো পৃথিবীতে কোনও যুদ্ধ নেই, দেশে দেশে কোনও ভাগ নেই, কোনও স্বর্গ নেই, নরক নেই, কোনও ধর্ম নেই! বব ডিলানের গানের কথা মানুষকে মুগ্ধ করেছে।
বব ডিলানও সমতার কথা বলেছে, কিন্তু তার ঈশ্বর-বিশ্বাসের কারণেই সে এক জায়গায় স্থির ছিলো। জন লেনন তা থাকেনি। জন লেনন তার প্রেম বিরহের জগত থেকে, এমন কী সমতার আন্দোলন থেকেও বেরিয়ে গেছে আরও বড় আলোকিত জগতে, চেতনার আরও উঁচু স্তরে পৌঁচেছে, তার মানবতন্ত্র তার গানের ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে, অন্য সবার গানের থেকে আলাদা করেছে, এমন কী তাকে বিটলস থেকেও আলাদা করেছে। নিজের ঘরে নিজের সুখ-শান্তির বৃত্তে আবর্তিত হয়নি, সবার সুখ-শান্তির কথা ভেবেছে। সবাইকে চিন্তার দারিদ্র থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছে।
নিজের বিশ্বাসের কথা অকপটে বলেছে, সে বিশ্বাস জনপ্রিয় গায়কের জন্য মানানসই না হলেও বলেছে। চন্দ্রিল তার সমসাময়িক লেখকদের ভাষার চেয়ে সম্পূর্ণ অন্যরকম একটা নতুন ভাষা নিয়ে লেখালেখি শুরু করেছে। শুধু ভাষাই তার আধুনিক নয়, তার মত-ও আধুনিক। আনন্দবাজারে তার উত্তম মাধ্যম গুলো একসময় পড়তাম আর মুগ্ধ হতাম। তার লেখা আমাকে সবসময়ই চমকিত করে, আনন্দ দেয়, ভাবায়।
ভাবায় কজনের লেখা? এখনও মনে পড়ে বাক স্বাধীনতা নিয়ে তার চমৎকার একটা কলামের কথা। বাংলা ভাষায় ওই বিষয়ের ওপর, সত্যি বলতে কী, ওর চেয়ে ভালো লেখা আমি আজও পড়িনি। জন লেনন একবার বলেছিল, আমরা যেসাসের চেয়ে জনপ্রিয়, এ নিয়ে কী নিন্দা কী নিন্দা! জন কিন্তু বারবার বোঝাতে চেয়েছে তার মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা। বারবারই বলেছে সে, যে কোনও বিষয় নিয়ে তার কথা বলার, গান লেখার, গান গাওয়ার, তার সঙ্গী নির্বাচনের, পৃথিবীর যেখানে খুশি সেখানে বসবাসের, তার মাদক সেবনের, নিজের পছন্দ মতো নিজের জীবনটা যাপন করার স্বাধীনতার কথা। মহাঋষি নিয়ে আবেগটাও একসময় ঝেড়ে ফেলেছিল জন, বুঝতে পেরেছিল ঋষি টিষি সব ভণ্ড লোক।
জর্জ বুঝতে পারেনি, তা না পারুক। জর্জের চেয়ে জনের মাথা সবসময়ই ভালো কাজ করেছে। গতকাল আমি একটা গানের সিডির দোকানে ঢুকেছিলাম গাড়িতে বসে নতুন কিছু গান শুনবো বলে। বাউল রবীন্দ্রসঙ্গীত এরকম কিছু। নতুন কেউ গেয়েছে কিনা খুঁজছি তখনই চন্দ্রবিন্দুর নতুন সিডি দেখি।
গত বছর পুজোয় বেরিয়েছে। এটি আমার শোনা হয়নি। কিনে নিয়ে গাড়িতে চালিয়েছি। কিন্তু সিডিটা গাড়িতে না রেখে দিয়ে ঘরে নিয়েছি আবার শোনার জন্য। গাড়িতে বসেই লিরিক পড়ে ফেলেছিলাম।
নতুন ভাষা চন্দ্রিলের। এই ভাষা গানের ভাষা নয়। ঘরে এসে আবারও মন দিয়ে শুনলাম গানগুলো। না, এ কিছুতেই বাংলা গানের ভাষা নয়। কোনওদিন কোনও বাংলা গানে এমন শব্দ, এমন চিত্রকল্প ব্যবহার হয়না।
মানে এতকাল হয়নি। তাহলে কি চন্দ্রিল অসম্ভবকে সম্ভব করেছে!
গানের সংজ্ঞা, ব্যাকরণ, নীতি, রীতি, সবকিছুর খোলনলচে উল্টে ফেলার দাপট দেখিয়েছে! প্রথাআক্রান্ত ঘরকুনো মানুষদের চোখে এ রীতিমত অনাকাংক্ষিত বিপ্লব। না, লোকে কী বলবে চন্দ্রিল ভাবেনি। সিডি আদৌ বিক্রি হবে কি না, সে নিয়েও ভেবেছে বলেও মনে হয় না। উপলের ম্যাজিক সুর চন্দ্রিলের সঙ্গে।
আর কী প্রয়োজন দুশ্চিন্তা করার!এতকালের ন্যাকা ন্যাকা তোমাকে ভালোবাসি; গো তোমার বিরহে আমি কাতর গোর ধারা তবে কি শেষ অবধি মোড় নিল আধুনিকতার দিকে, যে আধুনিকতার কাছে ইংরেজি ভাষার গান সেই ষাট দশকেই পৌঁছে গেছে? সুমন, নচিকেতা ওরা মাঝখানে কিছুটা পরিবর্তন এনেছিল বটে, তবে ওই কিছুটাই, জীবনমুখী অনেকদিন মৃত্যুমুখী। বাংলা কবিতার ভাষা যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, বাংলা গানের ভাষা সেভাবে হয়নি, এ কথা অস্বীকার কে করবে! এখনও রবীন্দ্রসঙ্গীতই বাংলা গানের সবচেয়ে আধুনিকতম গান। এখনও রবীন্দ্র-ভাষা থেকে বেশির ভাগ গীতিকার বেরোতে পারেনি। যুগের পর যুগ আটকে আছে আমার মাথা নত করে দাওহের তলায়। এসময় চন্দ্রিলের গানের ভাষা আমার মনে হচ্ছে এক লাফে মর্ত্য থেকে মঙ্গলগ্রহ নয়, যেন ছায়াপথটাই পার হয়ে গেছে।
লাফটা বড় বড়। বাঙালির বদ্ধ জলাশয়ে আটকে থাকাও বহু পুরোনো। ঠেলে ধাক্কিয়ে সমুদ্রে নেওয়ার জন্য, বড় জোর কোনও বড় সড় নদীতে, হয়তো এরকম বড় একটা মার, আর বড় একটা লাফেরই দরকার ছিল। দুটো গান না হয় শোনা যাক। আলো আর হৃদয়-এ ক্লিক করলেই গান দুটো শোনা যাবে।
ভাবছিলাম তলতলে হৃদয় এর কথা। আমার কিন্তু যথেষ্ট জড়তা হৃদয়ের আগে তলতলে শব্দটি ব্যবহার করতে। তা, তোমাদের কী মত?
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।