আমাকে কি খাওয়াইলো। কিছু জানি না। রাতে কিছু বলতে পারিনি। সকালে কিছুটা বুঝতে পারি। সংজ্ঞা ফিরে আসার পর দেখি আমার মেয়ে বেঁচে নেই।
আপনারাই বলুন, কোন মা কি তার মেয়েকে খুন করতে পারে?’
এই বলে বিলাপ করছিলেন সিলেটের সাপ্লাই এলাকার হাজী ভিলার ভাড়াটে বাসিন্দা। মেয়ে মারুফা রিপাত চৌধুরী (১৮)-র মরদেহের পাশে বসে তিনি অঝোরে বিলাপ করছিলেন। মাঝে মাঝে মূর্ছা যাচ্ছিলেন। জিনের আছরে বৃহস্পতিবার রাতে তাদের পরিবারের ওপর ঝড় বয়ে গেছে বলে তারা মনে করছেন। ভণ্ড পীরানী তহুরা বেগমের দেয়া পানি খেয়ে তালমাতাল হয়ে রাতভর তারা এ কাণ্ড ঘটায়।
সিলেটে গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাদেশ্বর ফকিরটুল গ্রামের মৃত সৈয়দ মুহিবুর রহমানে স্ত্রী রিপা চৌধুরী- তার কলেজপড়ুয়া মেয়ে রিপাত চৌধুরী, ছেলে মাহের ও মাজহারকে নিয়ে সিলেট নগরীর সাপ্লাই এলাকার ভাড়া বাসায় বসবাস করছিলেন। কয়েক বছর ধরে বসবাস করছেন। শিক্ষিত পরিবার হলেও তাদের মধ্যে জিন-পরীর ভয় ছিল বেশি। সব সময় তারা জিনের আতঙ্কে থাকতেন। মনে স্বস্তি ছিল না।
গত ২৭শে নভেম্বর রিপা চৌধুরীর ছোট ভাই দুবাই প্রবাসী ইশতিয়াক দেশে আসেন। তিনি বড় বোনের এই অবস্থা দেখে তার বাসায় মাঝে মাঝে অবস্থান করেন। এক সপ্তাহ আগে বাসার কাজের মেয়ে রোকেয়া বেগম জানায়, তার পরিচিত এক পীর আছে। এই পীর সব কিছু সারাতে পারেন। জিনের আছর থাকলেও তা ভাল করে দিতে পারেন।
এই পীরের আস্তানায় নগরীর রায়নগর বসুন্ধরা ১২৪-২ নম্বর বাসায়। তার কথা শুনে জিন তাড়ানোর আশায় রোকেয়াকে নিয়ে রিপা বেগম কথিত পীরানী তহুরা বেগমের দ্বারস্থ হন। তহুরা বেগম অনেক ধ্যান করেন রিপাকে নিয়ে। তাকে বলেন, তোমার ওপর জিনের আছর আছে। জিন তাড়াতে হলে এক তোলা স্বর্ণ আর একটি গরু দিতে হবে।
তার কথায় রাজি হন রিপা চৌধুরী। তিনি ভাই ইশতিয়াককে এ কথা জানালে ইশতিয়াক তাকে টাকা দিয়ে সহায়তা করেন। রিপা চৌধুরী জানান, কাজের মেয়ে রোকেয়ার কথায় বৃহস্পতিবার রাতে আমি আমার ভাইসহ পরিবারের ৫ সদস্যকে নিয়ে তহুরার বাসায় যাই। বাসায় গিয়ে কথামতো তার হাতে একাত্তর হাজার টাকা তুলে দিই। এই টাকা নিয়ে সে আমাদের পানি খেতে দেয়।
আমরা পানি খাই। আরও কি কি দিয়েছে আমরা সেগুলো খেয়ে ফেলি। এরপর পীরানী জানায়, রাতে তোমার বাসায় জিন যাবে। ওই সময় তোমরা আমাকে জানাইও কি হয়। রাত ১১টায় বাসায় এসে রিপা বেগম পরিবারের সবাইকে নিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।
তিনি ঘুমান মাঝখানের কক্ষে। তার ভাই ইশতিয়াক ঘুমান সামনের কক্ষে। ছেলে-মেয়েরা ঘুমায় পেছনের কক্ষে। রাত ২টার দিকে ঘুম থেকে ওঠেন রিপা চৌধুরী। পরিবারের সবাইকে ডেকে তুলে বলেন, জিন এসেছে।
তোমরা সবাই এক কক্ষে আসো। এই বলে তিনি পেছনের কক্ষে নিয়ে যান সবাইকে। ডেকে আনেন সামনের কক্ষে ঘুমিয়ে থাকা তার প্রবাস ফেরত ভাই ইশতিয়াককে। এ সময় রিপা চৌধুরী ঘরের মধ্যে ছোটাছুটি শুরু করেন। তিনি মোবাইল ফোনে তহুরা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
এ সময় মোবাইল ফোনে তহুরাও তাদের সতর্ক থাকতে বলে। রিপা চৌধুরীর ছোট ছেলে ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মাজহার মানবজমিনকে জানায়, রাত ৩টায় আম্মা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক হয়ে যান। তার সঙ্গে সঙ্গে মামার অবস্থাও একই হয়। তারা দু’জন ঘরের মধ্যে বসে, হেঁটে, দৌড়ে জিকির- আজকার শুরু করেন। তাদের সঙ্গে আমাদের পরিবারের সবাই জিকির-আজকার শুরু করেন।
রাত সাড়ে ৩টার দিকে জিকির-আজকার অবস্থায় আমাদের সবাইকে বাথরুমে নিয়ে বন্দি করে দেন মামা ও মা। এ সময় তারা বাইরে ছিলেন। এ সময় তারা দু’জন জিকির-আজকার করেন এবং অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো আচরণ করেন। সে জানায়, তারা পরিবারের সবার ওপর কিছুটা অত্যাচার করেন। তবে তা বেশি নয়।
আমার আপুকেও তারা মারধর করে। এক পর্যায়ে আপুকে দুধ খেতে দেন আম্মা। আপু দুধ খেয়ে ছটফট শুরু করেন। এতে কান্নাকাটি শুরু করেন মা। মামা আপুর পেটে হালকা চাপ দেন।
এতে আপা বমি করে। বমি করেই নিজে নিজের হাত দিয়ে চুল ও মুখ খামচে ধরে। এভাবে কয়েক মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর আপু ঢলে পড়ে। এই অবস্থায় আপুকে রেখে মা জিকির-আজকারে মত্ত থাকেন। তার সঙ্গে মামা ও আমাদের পরিবারের সবাই জিকির-আজকার করি।
সকালে স্থানীয় লোকজন আমাদের দরজায় ধাক্কা দেন। অনেক ধাক্কাধাক্কির পর দরজা খুলে দেয়া হয়। সিলেট সিটি করপোরেশনের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রেজওয়ান আহমদ জানান, ভোরে এলাকার লোকজন আমাকে খবর দেন। খবর পেয়েই আমি পুলিশ ও র্যাবকে ফোন করি। আমিও আসি।
পুলিশ এসে দরজা খুলে সংজ্ঞাহীন মারুফা রিপাত চৌধুরীকে উদ্ধার করে প্রথমে একটি ক্লিনিকে এবং পরে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় পুলিশ রিপা চৌধুরীর বাসার কাজের মেয়ে রোকেয়াকে আটক করেছে। আটকের পর রোকেয়া সাংবাদিকদের জানায়, রিপাতকে তার মা ও মামা খুন করেছে। তারা এমন আচরণ করেছে তাতে আমরা ভড়কে যাই।
আমাদের বাথরুমে আটকে রেখে তারা হত্যা করে। তবে রিপা চৌধুরী বলেছেন, রোকেয়া আমার পরিবারে কাজের মেয়ে হয়ে আসার পর থেকে জিন ও ভুতের ভয় পাই আমরা। রোকেয়া পীরানীর কাছে নিয়ে আমাদের কি খাওয়ালো। আমরা বলতে পারিনি। এরপর রাতে কি হলো তা-ও বলতে পারছি না।
এদিকে, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ আটক রোকেয়া বেগমকে নিয়ে অভিযান চালায় তহুরা বেগমের আস্তানায়। নগরীর রায়নগর এলাকায় আস্তানা বসিয়ে সে পীরানী করছে বলে স্থানীয় লোকজন জানান। তার কক্ষেই রয়েছে আসন। ওই আসনে বসে সে জিনের সাধনা করে। পুলিশ আস্তানায় অভিযান চালানোর আগেই পালিয়ে যায় তহুরা।
তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে পুলিশ কথা বললে সে জানায়, ছাতকের গোবিন্দ এলাকায় গেছে। আসতে দেরি হবে। এর বেশি সে কিছুই জানায়নি। পরে র্যাব তহুরার আস্তানা থেকে তার ছেলে, ছেলের বউসহ ৮ জনকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। বেলা দেড়টার দিকে কোতোয়ালি মডেল থানার এসআই অঞ্জন ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেন।
এ সময় তিনি বলেন, ময়না তদন্ত ছাড়া কিছুই বলা যাবে না। তিনি জানান, পুলিশ ভণ্ড পীরানীকে আটকের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
COLLECT FROM..MANOB JOMIN PATRIKA
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।