জীবন যেখানে থমকে দাঁড়ায় কবিতারা সেখানে উপছে পড়ে বাঁধ ভাঙা জোয়ারে....
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ইতি টানতে গিয়ে খায়েস জাগলো একটা পিকনিক করার। যদিও দীর্ঘ ৭ বছরে কুয়াকাটা ছাড়া আর কোথাও যাওয়া হয়নি। তার কারণ হিসাবে উল্লেখ করা যায় আমাদের টিম বা গ্রুপ কোনটায় মজবুত ছিল না। তো একটা বিশেষ গ্রুপ যখন এই ট্যুরের আয়োজন করতে যাচ্ছিল তখন বাধা দিতে হলো। আর বাধা দিতে গিয়ে দায়িত্বটা ঘুরে কিছুটা এলো আমাদের কাধে।
দায়িত্ব কাধে নিয়ে চেয়ারম্যান স্যারের সাথে কথা বলে মহান ¯^vaxbZv দিবসে সিলেট যাওয়ার জন্য সব আয়োজন সম্পূন্ন করলাম। কিন্তু বিধি বাম। এক অনাকাঙ্খিত শাসিত্ম আমাদের সে যাত্রা বন্ধ করে দিল। অবশেষে এপ্রিল মাসের ১ তারিখে যাওয়ার চিনত্মা করলাম। দুই দিনের ট্যুরের পরিকল্পনা করে সব আয়োজন শেষ করলাম।
ট্যুরের দিন যত কাছে আসতে লাগলো মাথায় চাপ তত বাড়তে লাগলো। একসময় কর্তৃপক্ষ জানালো ছুটির দিন ছাড়া গাড়ি দিতে পারবে না। বাধ্য হয়ে তারিখ পরিবর্তন করলাম এপ্রিলের ২ তারিখ। পরে জানালো ১ দিনের বেশি গাড়ি ইস্যু করতে পারবে না । পড়লাম আরেক বিপাকে।
আমরা জানি একদিনে সিলেট দেখা সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়ে পাবলিক গাড়ির দিকে ঝুঁকলাম। বলা বাহুল্য আমাদের বাজেট নাগালের বাইরে চলে যেতে চাইলো। তবুও টার্গেট করলাম ৩০ হাজারের মধ্যে বাস পাওয়া যাবে। আর পাওয়া গেলে ট্যুর হবে ২ দিনের।
তাহলে আবার ট্যুরকে ১ তারিখে নির্ধারণ করা হলো। কিন্তু পাবলিক গাড়ি নিয়ে খবর নির্বাহ করতে ব্যর্থ হওয়ায় একদিনে ট্যুর নির্ধারণ করা হলো।
অবশেষে বিশেষ ব্যবস্থায় গাড়ি ২ তারিখ দুপুর ১ টার সময় পেলাম। এদিনে আবার বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটাররের নাটক ‘মানুষ’ মঞ্চায়ন হলো। সকাল ৯ টার গাড়িতে গিয়ে ওদের দর্শক টিকেট পরীক্ষা করে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে সাড়ে ১২টার দিকে আমাদের অনুষদ ভবনের দিকে গেলাম।
তখনো কেউ আসেনি। ১টা বাজতে বাজতে সবাই এসে গেল। সোয়া ১টার দিকে আমাদের শ্রদ্ধেয় স্যার সাইফুল ইসলাম ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান হিসাবে বিদায় দিতে এলেন। আমরা দুপুর একটার দিকে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা। দুপুরে কুষ্টিয়া পৌছে আরেফিন স্যারের পরিবার ও অন্যান্য বন্ধুদের তুলে নিলাম।
অতপর দুপাশে সর্বনাশা তামাকের ক্ষেত, সোনালী গম, সবুজ ধান আর বসনেত্মর সবুজে সজ্জিত গাছগাছালি ঘেরা ছোট ছোট গ্রামগুলোর পাশ দিয়ে এগিয়ে চললো আমাদের বাস। আধা ঘন্টার মধ্যে আমরা লালন শাহ সেতু পার হয়ে সিরাজগঞ্জের দিকে রওনা হলাম। বিকালের দিকে পার হলাম বঙ্গবন্ধু সেতু। শুরু হলো ঝুমঝাম বৃষ্টি। গাজিপুর পৌছে সবাই নামাজ পড়তে গেল।
নামাজ শেষে আবার আমাদের বাস চলতে শুরু করলো। চারিদিকে মেঘের কারণে খুব দ্রুত অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। বাইরে আর তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। এদিকে পাহাড় সমান ঘুম নেমে আসলো চোখে। ঘুম ভাগলো হাইওয়ের রাজমনি হোটেলের কাছে এসে।
রাতের খাবার খেতে বসে বাধলো বিপত্তি। বেশ কিছু সময় অপেক্ষার পর খাবার দিল টেবিলে। খাবার খেয়ে বিল গুনতে গিয়ে বাধালো বিপত্তি। আমাদের ২১শ টাকার কণ্ট্রাক গিয়ে দাড়িয়েছে ৪ হাজার টাকায়। খাবারের মেনুতে ছিল ভাত, ডাল, অর্ধেক পরিমান মুরগী এই দিয়ে ৩৮ জনের বিল দাড়ালো ৪ হাজার টাকা।
অবশেষে দরকষাকসি করে তা পরিশোধ করা হলো ২৮শ টাকা। রাতের খাওয়া শেষ করে রওনা দিলাম।
প্রচন্ড ঝড়ে গাছপালা নুয়ে পড়েছে পিচ ঢালা রাসত্মায়। টিলা আর চা বাগান পেরিয়ে আকাবাকা পথ দিয়ে রাত ১১টার দিকে পৌছালাম কুলাউড়া সিআরপি রেস্ট হাউজে। সরু পথ দিয়ে পাহাড়ী ঢাল কেটে কেটে বাস এমন এক গহীণ অরণ্যে এসে পৌছালো যেখানে নিশ্চিত মারা পড়তে হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
অর্থ্যাৎ এতটাই জনমাববহীন যে ভৌতিক সিনেমার মত মনে হলো। মনে মনে ভয় পেলাম বৈকি। বেশি ভয় পেলাম পাহাড়ী ডাকাতদের। এদিকে বৃষ্টিতে মাটি ভিজে গেছে। আমাদের গাড়ি যে রাসত্মা দিয়ে বাংলোতে আসার সময় প্রবেশ করেছে সেখানে গাড়ি তো দুরের কথা একটা শেয়ালকেও পাশ কাটানো সম্ভব নয়।
শুনশান নিরবতা ভেদ করে আমরা কয়েকটা প্রাণী গাড়ির পাশে দাড়িয়ে গাড়িটা ঘুরাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ড্রাইভার জানালো গাড়ি ঘুরানো যাবে যদিটা রাসত্মার পাশের পিলারটা তুলে ফেলা যায়। আমরা কয়েকজন মিলে পিলারটা তুলতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু পিলারটা যেন একটু লজ্জা পেয়ে নড়েচড়ে জেকে বসলো। এদিকে আমাদের কথাবার্তা শুনে পাহাড়ী ঢাল থেকে এক ভদ্রলোক নেমে এলেন।
মনে হলো ডাকাত-টাকাত নয় তো? না উনি জানালেন, উনার বাড়ি পাশেই। তার টর্চ লাইটটা চেয়ে নিলাম। অবশেষে ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি ঘুরাতে চেষ্টা করলাম। তাতে ফলাফলে সফল হলাম। কয়েক বন্ধুকে গাড়ি পাহারায় রেখে আমরা বাংলোতে ঘুমোতে গেলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ম্যানেজারের কাছে জানলাম, রাত্রে প্রচণ্ড ঝড় ও শিলাবৃষ্টি হয়েছে। খবরটা শুনে আৎকে উঠলাম। এতকিছু হয়েছে আর কিছুই জানিনা! মনে হলো পাহাড়ী ঢলে যদি চাপা পড়তাম তাহলেও হয়তো কিছু জানা হতো না আমাদের ।
সকাল বেলা টিলার উপরে দাড়িয়ে প্রভাতের সূর্য উঁকি দিতে দেখে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। পথের জার্নিটাকে যেন নিমেশেই ভুলে গেলাম।
সকাল বেলা ভাবির দল ঘুরতে বেরিয়ে বললেন জায়গাটা দেখে তারা ভীষণ খুশি। তবে রাত্রে যে কম ঝাড় দেয়নি তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সকাল বেলা নাসত্মা সেরে রওনা হলাম মাধবকুণ্ডু জলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে। দুপুরের দিকে আকাবাকা পথ পেরিয়ে পৌছালাম মাধবকুন্ডু। কেউ কেউ জলপ্রপাতের ঠান্ডা জলে নামলো স্নান করতে।
আমার ও ভীষণ ইচ্ছা করছিল জলে নামি। কিন্তু শখ পুরণ করতে গেলে যে, আমার পরনের কাপড় ভিজে যাবে। তারপরও একটু ঠান্ডা লাগার কারণে আর সে আশা পুরণ করতে পারিনি।
রওনা হলাম জাফলংএর উদ্দেশ্যে। পথে খেয়ে নিলাম দুপুরের খাবার।
বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে জাফলং পৌছালাম। ১৫-২০ কিলোমিটার দুর থেকেই দেখতে পেলাম পাহাড় শ্রেণী। যেন পৃথিবীর পথে তার অব্যর্থ অনশন। যত কাছে যেতে লাগলাম পাহাড় তত স্পষ্ট হতে লাগলো। মামার বাজার ছেড়ে পিকনিক স্পটে এসে থামলো আমাদের বাস।
আমরা নেমে জাফলং নদী পার হয়ে গেলাম মনিপুরী পল্লীর দিকে ও চা বাগান দেখতে। সেখান থেকে সোজা জিরো পয়েন্টের দিকে। কিন্তু বালি আর পাথর পেরিয়ে সময়ের ¯^íZvi কারণে আমার পহাড়ের পাদদেশে উঠা হয়নি। অতপর এক মুগ্ধ আবেশ আমার একাকীত্বকে বহুগুনে বাড়িয়ে দিল। দলবদ্ধ পাহাড়ের গা ঘেয়ে সূর্যাসত্ম দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল পৃথিবী অনেক সুন্দর।
এই সুন্দর পৃথিবীতে আমার জন্য কেউ কি তার সুন্দর মন নিয়ে অপেক্ষা করে আছে? সূর্য পাটে নামার সাথে ফিরতে হলো আমাদের। অসংখ্য পাহাড়কে পিছনে ফেলে আমাদের বাস ধাপিত হলো গনত্মব্যের দিকে। শুধু হৃদয়ে অনুভব হলো না, সব দেখা হলো না। যেন কেউ ক্ষুধার্ত শিশুর সামনে থেকে থরে থরে সাজানো খাবার সরিয়ে নিয়ে যাচেছ। খুব সামান্য সময়ের এই ভ্রমণে নিজের কাছে স্মরণী হয়ে থাকবে প্রতিটি মুহুর্ত।
সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকবে আমাদের সাথে ছিলেন আমাদের মহুয়া ও নাজমা ভাবি। যারা আমাদের এই ট্যুরটাকে এনে দিয়েছে এক অফুরনত্ম ভাললাগার ফুলের ডালি। যেখানে তারা সদ্য প্রস্ফুতিত শিশির ভেজা গোলাপ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।