আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারীভাবে দেশীয় কৃষকের আমন ধান না কিনে বিদেশ থেকে আমদানী



বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ১৯৯৬-২০০১ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছিলো। এবারে ক্ষমতায় এসে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বার বার বলেছেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ চায়নি। কারণ, দেশে খাদ্য ঘাটতি থাকলে চাল-গম আমদানী করা যাবে। আর বিএনপি’র লোকেরা তা থেকে কমিশন মারতে পারবে। ’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কৃষি নিয়ে বিএনপিকে বেশ ব্যাঙ্গ করেছেন।

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বর্তমান সরকার নিজেই জরুরী ভিত্তেতে খাদ্য আমদানী করতে নেমেছে। আমনের ফলন আশানুরূপ হয়েছে দাবি করে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, এবার এক কোটি ৩৫ লাখ মেট্রিক টন আমন উৎপাদন হবে। তিনি জানান, আমন ধান উৎপাদনে প্রতি কেজিতে প্রায় ১৫ টাকা খরচ হয়েছে। সেটা যদি চালে রূপান্তর হয় তাহলে প্রতি কেজিতে খরচ পড়ে ২২ টাকা। বিদ্যমান আমন ধানের কেজি প্রতি মূল্য রয়েছে ২৮ টাকা।

এ দামে সরকার ধান ক্রয় করলে বাজারে চালের মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকবে। তাই সরকার বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে দেশের ৪০ শতাংশ দারিদ্রসীমার নিচে যারা রয়েছেন সবার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখতে বদ্ধ পরিকর। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, গত চল্লিশ বছরে দেশের প্রতিটি জিনিষের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ডালের দাম প্রতি কেজি ৩ টাকা থেকে ১০০ টাকা, পুটি মাছের দাম ১ টাকা থেকে ২০০ টাকা, বেগুনের দাম ৪ আনা থেকে ৩০ টাকা, কাঁচা মরিচের দাম ১ টাকা থেকে ৬০ টাকা, গরুর গোশতের দাম আড়াই টাকা থেকে ২৫০ টাকা হয়েছে। কিন্তু সেই অনুপাতে ধান বা চালের দাম বাড়েনি।

কৃষক ভায়েরা সার বীজ কিনে অতিরিক্ত অর্থ ও নিজের শ্রম বিনিয়োগ দিয়ে ধানের ফলন বৃদ্ধি করে টিকে আছে। এখন যদি বিদেশ থেকে চাল ও গম আমদানি অব্যাহত থাকে তাহলে তাদের অবস্থার পরিবর্তন হবে কি করে? দেশে বর্তমান সারা বছর ধরে ধানের আবাদ হয়। আমাদের দেশে আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ২ কোটি একর বা ৬ কোটি বিঘা (প্রতি বিঘা ৩৩ শতাংশ হিসেবে)। এই জমিতে মৌসুম, জাত, পরিচর্যা, ইত্যাদির ভিত্তিতে প্রতি বিঘায় গড়ে ৩০ মণ ধান ও ৯ মণ গম উৎপাদিত হয়। কৃষকদের সহযোগিতা করে দেশের মাটিতে সহজেই দেশের শ্রমিক দিয়েই শুধু কাঙ্খিত খাদ্য উৎপাদন নয়; বরং অঢেল রপ্তানি সম্ভব।

তারপরেও খাদ্য আমদানী নিখাদ আত্মঘাতি। বিদেশ থেকে চাল ও গম আমদানি হলে কৃষক ভায়েরা অতিরিক্ত উৎপাদনের সুযোগ পাবেন না। গ্রামে কৃষি শ্রমিকরা ধান উৎপাদনে ১৮ লক্ষ এবং গম উৎপাদনে ২০ লক্ষ কর্মদিবস সমান শ্রম নিয়োগের সুযোগ হারাবেন। অর্থাৎ এই চাল ও গম আমদানি না করে দেশে উৎপাদন করলে চলতি ধান উৎপাদন মৌসুমে ৬০,০০০ শ্রমিক ও আগামী গম উৎপাদন মৌসুমে ৬৫,০০০ শ্রমিক এক মাস ধরে শ্রম বিনিয়োগের সুযোগ পেতেন। বিদেশ থেকে চাল ও গম আমদানি করা হলে এই সুযোগটা অন্য দেশের শ্রমিকেরা পাবে।

দেশে যখন মঙ্গা নিয়ে হৈচৈ হয় এবং কৃষি শ্রমিকের কর্ম সংস্থান নিয়ে সকলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তখন এই চাল আর গম আমদানির অনুমোদন নিঃসন্দেহে দ্বিধার সৃষ্টি করে। বলাবাহুল্য, সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়ে হঠাত্‌ করেই অস্বাভাবিকভাবে খাদ্য আমদানি বেড়ে গেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দু’মাসে (জুলাই-আগস্ট) এ আমদানি বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। এ দুই মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় আমদানি বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। চলতি অর্থবছরে দুই মাসে প্রায় ১৬৪ কোটি টাকার খাদ্য আমদানি করা হয়েছে, আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৩ কোটি টাকা।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, খাদ্যের চাহিদা কতটা সরকারের জানা নেই। কেউ বলছেন ২ কোটি ৮০ লাখ টন, কেউবা বলছেন ৩ কোটি টন। এই নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি) বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল এর মধ্যে রয়েছে দ্বি-মত ও বিভ্রান্তি। মনিটরিং সেল জানিয়েছে, তারা প্রতিবছর অতিরিক্ত তিন লাখ টন ধরে বার্ষিক চাহিদা নির্ধারণ করেন। সরকারের দায়িত্বশীলরা বলছেন, বাস্তবতার সাথে তার মিল নেই।

গত ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে বিবিএস খাদ্যের উৎপাদন দেখায় ৩ কোটি ২৮ লাখ ৯৬ হাজার টন। তার ঐ অর্থ বছরে খাদ্যের চাহিদা দেখানো হয়। ২ কোটি ৭৭ লাখ টন। উৎপাদিত খাদ্য থেকে বীজ, পশু খাদ্য এবং অপচয় বাবদ ১০ শতাংশ হারে (সরকার নির্ধারিত) বাদ দিলে উল্লেখিত বছরে নীট উৎপাদন ছিল ২ কোটি ৯৯ লাখ টন, যার বিপরীতে চাহিদা ২ কোটি ৭৭ লাখ টন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো যে- সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রায় সাড়ে ২৭ লাখ টন খাদ্য আমদানি করতে হয়েছে।

গেলো ২০০৯-১০ অর্থ বছরে ৩ কোটি ৬৭ লাখ ৩৬ হাজার টন খাদ্য উৎপাদন হয়েছে বলে জানায় বিবিএস। ১০ শতাংশ হারে (বীজ, পশু খাদ্য ও অপচয়) বাদ দিলেও নীট উৎপাদন থাকে প্রায় ৩ কোটি ৩৭ লাখ টন। অপর দিকে বার্ষিক চাহিদার কথা বলা হচ্ছে ২ কোটি ৮০ লাখ টন। চাহিদা যদি ৩ কোটি টনও হয় তবুও চাহিদা মিটিয়ে বেশি থাকে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, খাদ্যের সংকট।

২০০৯-১০ অর্থ বছরে সরকারি-বেসরকারিভাবে (সরকারিভাবে সাড়ে ২৭ লাখ টন) ৩০ লাখ আমদানি হয়েছে। প্রশ্ন হলো এতো খাদ্য গেলো কোথায়? মূলতঃ খাদ্যের চাহিদা এবং উৎপাদন সম্পর্কে সরকারের কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সরকারিভাবে ২০০৯-১০ অর্থ বছরে দেশের জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি, অথচ সরকারের দায়িত্বশীলরাই বিভিন্ন সভা, সমাবেশ, সেমিনারে বলছেন দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি। আবার বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান বলছে, জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি। সরকারি হিসাবের বাইরে দেড় বা দুই কোটি লোকের খাদ্য আসবে কোথা থেকে? আবার খাদ্যমন্ত্রী ইতোপূর্বে যা বলছেন ‘এবার ২০০৯-১০ অর্থ বছরে খাদ্যের বাম্পার ফলন হয়েছে।

চাহিদা মিটিয়ে রফতানি করা যাবে’। পরে আবার বললেন, ‘আমরা এবার খাদ্য রফতানি করতে পারবো না’। তারপর বললেন, ‘‘প্রতিবেশী দেশগুলোতে খাদ্যের উৎপাদন কম হয়েছে, তবে মিয়ানমারে কিছুটা বেশি হয়েছে’। আবার বললেন ‘ভারত-পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশ খাদ্য রফতানি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, এসব দেশ থেকে খাদ্য আমদানি করা যাবে না’। বলাবাহুল্য, সরকারের এসব দায়িত্বহীনতার খেসারত দিচ্ছে ভোক্তা সাধারণ।

জোট সরকার যেখানে খোলা বাজারে প্রতি কেজি চাল দরিদ্র জনগণের মধ্যে ১২ টাকায় বিক্রি করতো, সেই চাল এখন ২৮ টাকা কেজি। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১২ টাকার চাল ১৬ টাকা, আর বর্তমান সরকার দু'দফা দাম বাড়িয়ে ২৮ টাকা করেছে। অর্থাৎ সরকার নিজেই দফায় দফায় চালের দাম বাড়িয়ে চলছে। দেশে মূলতঃ খাদ্যশস্যের কোন ঘাটতি নেই। বাজারে কিংবা চাতালগুলোতে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুদ আছে।

তা সত্ত্বেও বাজারে খাদ্যশস্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। খাদ্য ব্যবস্থাপনার সমস্যার কারণেই দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। সরকার খাদ্য অব্যবস্থাপনা নির্মূল না করে উল্টো পথে সমাধানের পথ খুঁজছে। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে বোরো ধান থাকে আর্দ্র এবং আসন্ন বর্ষা থাকায় কৃষক এ ধান মজুদ করতে পারে না। তাই কৃষককে তড়িঘড়ি করেই সে ধান বিক্রি করতে হয়।

অথচ বোরো ধানের সময় সরকার মূল্য নির্ধারণ করলো ১৭ টাকা। এদিকে সরকারী কর্মচারীরা কৃষককে অনেক শর্ত-শারায়েতের কথা শোনায়। কারণ, কৃষকের থেকে তারা ঘুষ পায় না। কিন্তু ফরিয়াদের থেকে ঘুষ পাওয়ায় তারা ধান কেনে ফরিয়াদের থেকে। এদিক থেকেও কৃষকরা বঞ্চিত হয়।

এবারে কৃষকরা যখন লস দিয়ে ধান বিক্রি করছে, ধান গিয়েছে ফরিয়াদের হাতে তখনই সরকার কেজি প্রতি ৩ টাকা দাম বাড়িয়েছে। আমন ধানের ক্ষেত্রে সরকার আমন ক্রয় না করলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে কী না এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, কৃষক ক্ষতির সম্মুখীন হলে সরকার তখন বিষয়টি দেখবে। বলাবাহুল্য, সরকার যদি এভাবে কৃষকের বাঁচা-মরার বিষয়কে নিয়ে গিনিপিগ পরীখা করে তাহলে তা চরম শ্লাঘার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কৃষকের কাছ থেকে আমন কিনলে দাম বেড়ে যাবে- এর পিছনে সরকারী ব্যাখ্যা হলো, তাহলে ফরিয়া, আড়তদার, মিল-মালিক সুযোগ নিবে। আমাদের প্রশ্ন হলো, অসৎ ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিতে পারে।

সরকার সে সুযোগ দিবে কেন? অসৎ ব্যবসায়ীদের অসদাচরণের অবাধ সুযোগ থাকবে কেন? সরকার তাহলে কীসের সরকার? কীসের তাহলে তার প্রশাসন? কীসের তাহলে তার আমলা? কীসের তাহলে তার জনগণ? স্পষ্ট প্রতিভাত হয় যে, সরকার তার মন্ত্রণালয়, প্রশাসন, আমলা, জনগণ কারো মাঝেই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যেমন করতে ব্যর্থ হয়েছে; তেমনি নৈতিকতার স্ফুরণ ঘটাতেও অক্ষম হয়েছে। সেক্ষেত্রে সরকারকে সম্যক উপলব্ধি করতে হবে যে, এক্ষেত্রে অনিবার্য হলো- ৯৭ ভাগ জনগোষ্ঠীর মাঝে ইসলামী আদর্শের উজ্জীবন। তাহলে গড়ে উঠবে না কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে অথবা সুযোগ পেয়ে দাম বৃদ্ধির প্রবণতা। সেখানে বিরাজ করবে অব্যক্ত সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও মানবতা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।