আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নামে ঢাকা সেনানিবাসের বাড়িটি বরাদ্দ দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতি আবেগ দেখাতে গিয়ে সাড়ে চার শ' কোটি টাকার সরকারী সম্পত্তি নামমাত্র মূল্যে বরাদ্দ দেয়া হয়। তখন শুধু আবেগই কাজ করেনি, এর পিছনে ছিল রাজনৈতিক লাভ-লোকসানের সমীকরণও। তখনকার ক্ষমতাসীনরা নিজেদের মসনদ নির্বিঘ্ন করতে ক্ষমতা থেকে সদ্য বিদায়ী দলের প্রয়াত নেতার স্ত্রীকে সেনানিবাসের মতো স্পর্শকাতর এলাকায় বাড়িটি অবলীলায় লিজ দেয়। এর কিছুদিন পরই বেগম জিয়া রাজনীতিতে নামেন।
শুরু হয় সেনানিবাস থেকে রাজনৈতিক কর্মকা-। সেনাআইনে সেনানিবাস থেকে কোন ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যায় না। তারপরও বেগম জিয়া ২৯ বছর ৫ মাস ১ দিন সেনানিবাসের বাড়িতে থেকে রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করেছেন। শুধু কি তাই, তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী স্বামী হারার কারণে গুলশানে বেগম জিয়ার নামে আরও একটি বাড়ি সংসদে বিল তুলে লিজ দেয়। এটিও ছিল আইনের পরিপন্থী।
সরকারের আইন অনুযায়ী এক ব্যক্তির নামে দু'টি সরকারী সম্পত্তি লিজ দেয়ার বিধান নেই। কিন্তু বেগম জিয়ার বেলায় তখন আইনকে উপেক্ষা করা হয়েছে। তাঁর দুই ছেলের লেখাপড়া করার জন্য প্রতিমাসে সরকারী কোষাগার থেকে একটা বড় অঙ্কের টাকাও দেয়া হতো। রাষ্ট্রের সব ধরনের সুযোগসুবিধা ভোগ করেন তিনি। রাজনীতিতে নেমে তিনি দেশে তিন দফায় প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।
বাড়িটি যেভাবে বরাদ্দ পেলেন বেগম জিয়া ॥ ১৯৮১ সালের ৩০ মে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হন। একই বছরের ১২ জুন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার তাঁর স্ত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়াকে ২ দশমিক ৭২ একর (১৬৮ কাঠা) জমিসহ ঢাকা সেনানিবাসের মইনুল রোডের ৬ নং বাড়িটি বরাদ্দ দেয়া দেন। এত বড় বাড়ি বরাদ্দ দিয়েই শেষ করেননি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার। কিছুদিন পরে গুলশানেরও একটি বাড়ি বেগম জিয়ার নামে বরাদ্দ দেন তিনি। দু'টি বাড়ির জমির মূল্য বর্তমান বাজারে প্রায় সাড়ে ৪শ' কোটি টাকা।
আদালতের রায়ের পরে এত বিশাল অঙ্কের টাকার সরকারী সম্পত্তির দখল ছাড়তে এ কারণেই এত গড়িমসি করছিলেন বেগম জিয়া। শেষ দিন পর্যনত্ম তিনি বাড়িটি নিজের মনে করে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। শেষ রৰা হয়নি। ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড বাড়িটি বুঝে নিতে শনিবার সকাল থেকেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে অবস্থান নেয়। বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আগেই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়।
পওে বোর্ডের কর্মকর্তারা বেগম জিয়াকে বাড়ি ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। অবশেষে বিকেল সোয়া ৩টার দিকে বেগম জিয়া বাড়ি ছেড়ে চলে যান। ২৯ বছর ৫ মাস ১ দিনের বিলাসবহুল জীবনের অবসান ঘটে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার তৎকালীন সেনাপ্রধান লে. জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল আমজাদ আহমেদ চৌধুরীর সুপারিশের ভিত্তিতে বাড়িটি বরাদ্দ দিয়েছিলেন। সেনানিবাসের এ বাড়িটি বরাদ্দ দেয়ার কিছুদিন পরেই গুলশানে বেগম খালেদা জিয়ার নামে ১ দশমিক ৫ বিঘা জমিসহ একটি বাড়ি বরাদ্দ এবং প্রতিমাসে ১০ লাখ টাকার বিভিন্ন রকম সুযোগসুবিধা প্রদান করেছিলেন।
গুলশানের বাড়ির জমির দাম বর্তমান বাজারে দেড় শ' কোটি টাকা। একই ব্যক্তির নামে সরকারের দেয়া দু'টি পস্নট বরাদ্দ দেয়ার কোন বিধান না থাকলেও খালেদা জিয়াকে সরকার উদারহসত্মে একের পর এক মূল্যবান সম্পত্তি দান করে। সূত্র জানিয়েছে, খালেদা জিয়ার মইনুল রোডের বাড়িটি ক্যান্টনমেন্ট আইন অনুযায়ী এ-১ ক্যাটাগরির সামরিক সম্পত্তি। এই ক্যাটাগরির জমি লিজ দেয়া না। এ-১ ক্যাটাগরির সম্পত্তি সেনা প্রতিষ্ঠান, অফিসার্স মেস, সেনা কর্মকর্তাদের বাসা অথবা বাংলো হিসেবে ব্যবহারের বিধান রয়েছে।
ক্যাটাগরি পরিবর্তন করে সেনা সম্পত্তি লিজ দেয়া যায়। তবে এ-১ ক্যাটাগরির জমি হলে সেটা পরিবর্তন করা যায় না। লিজ দিতে হলে বি-৪ ক্যাটাগরি করতে হবে। এ-১ ক্যাটাগরির জমি পরিবর্তন না করেই বেগম জিয়ার নামে বাড়িটি বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রতিরৰা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনসাপেৰে ক্যাটাগরিও পরিবর্তন করা হয়নি।
সরকারী সম্পত্তি লিজ দেয়া হলে লিজের সমসত্ম শর্ত মানতে হয়। এৰেত্রে বেগম জিয়া কোন শর্ত মানেননি। সেনানিবাসের বাড়িটির জমি তিনি তেজগাঁও সার্কেল থেকে বেআইনীভাবে মিউটেশন করিয়েছেন। জমিটি সামরিক সম্পত্তি হওয়ার পরও সামরিক ভূমি অধিদফতরে না গিয়ে তেজগাঁও সার্কেলের সহকারী ভূমি অফিস থেকে মিউটেশন করিয়ে নিয়েছেন।
জানা গেছে, জমিটি যখন বেগম জিয়ার নামে বরাদ্দ দেয়া হয় তখন লিজের শর্ত ছিল_ সম্পত্তির কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা যাবে না।
কিন্তু এ শর্তের কোন কিছুই তোয়াক্কা করেননি তিনি। শর্ত উপেৰা করে ওই জমিতে বেগম জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান তিনতলা বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ করেন। এছাড়া গণপূর্ত বিভাগ বাড়িটি সংস্কারের জন্য কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করেছে। শর্তে বলা হয়েছে, লিজের জমিতে কোন সংস্কার কাজও করা যাবে না। বর্তমানে ঢাকা সেনানিবাস এলাকায় এক কাঠা জমির দাম দেড় কোটি টাকা।
এ হিসেবে ১৬৮ কাঠা জমির দাম দাঁড়ায় দু'শ' ৪৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। একইভাবে গুলশানের জমির দাম ধরা হলে তার দাম দাঁড়ায় দেড় শ' কোটি টাকা। এত বিশাল অঙ্কের টাকার সরকারী সম্পত্তি ভোগ করার বিষয়টি এখন প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, সেনানিবাস এলাকায় অফিসারদের আবাসিক সঙ্কট রয়েছে। অনেক অফিসার বাসা বরাদ্দ পাচ্ছেন না।
আবাসিক সঙ্কটের মধ্যে সেনা কর্মকর্তারা বসবাস করলেও সাবেক সেনাপ্রধানের স্ত্রী হিসেবে কিভাবে বেগম জিয়া বাড়িটি দখল রেখেছেন! সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেনাসদস্যদের সুবিধার কথা চিনত্মা করে বাড়িটি ছেড়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তাও করেননি। বিষয়টি নিয়ে সেনা অফিসারসহ নানা মহলে বিরূপ সমালোচনা হলেও বিএনপি চেয়ারপার্সন ও বিরোধীদলীয় নেতা কানের এসব সমালোচনা পেঁৗছেনি। বাড়িটি ছেড়ে দিয়ে উদারতার পরিচয় দিতে পারতেন তিনি। উল্টো তিনি সেনানিবাসের বাড়িতে বসে রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও রাতদিন রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করেছেন।
সেনানিবাসের ভেতরে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের আগমন এবং রাজনৈতিক আলোচনা করার আগে ছাড়পত্র নেয়ার বিধান থাকলেও বেশিরভাগ সময় বেগম জিয়া এ ধরনের কোন ছাড়পত্র নেননি। বিভিন্ন রাজনৈতিক বক্তব্য ও প্রকাশনা উৎসব, জন্ম, মৃতু্যবার্ষিকীসহ দলীয় নানা কর্মসূচী পালন করা হতো মইনুল রোডের বাড়িতে। এ বাড়িতে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ অবাধে যাতায়াত করেছে। সাংবাদিক, বিতর্কিত ব্যক্তি, বিদেশী কূটনীতিক, বাংলাদেশে সফরকালে বিদেশী রাজনৈতিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ বেগম জিয়ার বাসায় আসছেন। সংরৰিত এলাকা হিসেবে সেনানিবাসের নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে ছিল।
প্রতিরৰা বাহিনী জাতির ঐক্য এবং সংহতির প্রতীক। একজন রাজনৈতিক নেতার বাড়ি সেনানিবাসের ভেতরে থাকার কারণে এ ঐক্য হুমকির মধ্যে পড়েছিল।
মইনুল রোডের বাড়িতে বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত প্রায় ১৫ জন বেসামরিক কর্মচারী সপরিবারে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করেছেন। বিভিন্ন সময় এসব কর্মচারীর আত্মীয়স্বজনও তাদের সঙ্গে অবস্থান করতেন। সেনানিবাসে বসবাসরত বেসামরিক ব্যক্তিবর্গের নিরাপত্তা ছাড়পত্র বা পরিচয়পত্র নেয়ার বিধান রয়েছে।
বেগম জিয়ার বাড়িতে তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ৬১ জন। এছাড়া দলীয় আরও কয়েক নেতাকর্মী সর্বৰণিক ওই বাড়িতে থাকতেন। কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নেতাকর্মীদের কারও কোন ছাড়পত্র ও পরিচয়পত্র ছিল না। সেনানিবাসের মতো স্পর্শকাতর স্থানে এসব বেসামরিক লোকজন হুমকির কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। সেনানিবাসের জায়গা সেনা কর্মকর্তাদের জন্যই ব্যবহার করার সিদ্ধানত্ম নেয় ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড।
বোর্ডের সিদ্ধানত্মের বিরম্নদ্ধে বেগম জিয়া আদালতে গেলে আদালত ১২ নবেম্বরের মধ্যে বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দেয়। নির্দেশ অনুযায়ী বাড়িটি ক্যান্টনমেন্ট ১৩ নবেম্বর তাদের দখলে নেয়। বাড়িটি এখন ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
View this link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।