আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আব্বাস কিয়েরোস্তামি - ইরানী চলচ্চিত্রের রাষ্ট্রদূত

লেখালেখির জগতে এক ‘‘ক-অক্ষর গোমাংস’’। ইতিউতি চেয়ে, এখান-সেখান থেকে একটু আধটু নিয়ে একেবারে পড়ার অযোগ্য নয় এমন কিছু লেখার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাওয়া এ সময়কার এক নিধিরাম সর্দার।

আশির দশকে বিপ্লব পরবর্তী ইরান যখন সারাবিশ্বে পরিচিত একটি মানবাধিকার ও তথ্য রুদ্ধকারী দেশ হিসেবে, ঠিক সেই সময় মানুষের মানবিক ও শৈল্পিক প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে ইরানকে আবারো নতুন করে চেনালেন একজন সব্যসাচী চিত্রপরিচালক আব্বাস কিয়েরোস্তামি। পারস্য দেশীয় পরিচালক আব্বাস পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিত একজন বহুল আলোচিত ও বির্তকিত নির্মাতা হিসেবে। ১৯৭০ সালে তার প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘দ্যা ব্রেড অ্যান্ড এলাই’ দিয়েই নিজের জাত চিনিয়েছেন ইরানি চলচ্চিত্র-রেনেসাঁর এই চরিত্র।

সেই সময় তেহরান ইউনিভার্সিটিতে চারুকলার পাঠ চুকিয়ে ফটোগ্রাফির পাশাপাশি ভাবতে শুরু করলেন সিনেমা তৈরি করবেন। চারুকলায় শেখা স্থির চিত্রের নানান কৌশল এ বিষয়ে কাজে দিয়েছিল খুব। এখনো ছবি এঁকে কিংবা ছবি তুলে তার যে পয়সা রোজগার হয়, তা দিয়েই ছবি বানিয়ে ফেলেন কিয়েরোস্তামি। তার প্রথম ছবি নির্মিত হয়েছিল এভাবেই। মাত্র দশ মিনিটের চিত্রকল্পটি নির্মিত হয়েছিল এক টুকরো রুটিকে কেন্দ্র করে এবং যথারিতী তার নিজস্ব স্টাইলে গল্পের শুরুটা ছিল আবছা আবরণে ঢাকা।

ছবির মূল গল্পটি এগিয়েছে ক্ষুধার্থ কুকুরের হাত থেকে রুটি বাঁচিয়ে এক নাছোরবান্দা বালকের বাড়ি ফেরা নিয়ে। গল্পে সাহসী ছেলেটি একটি প্রতীক মাত্র, যে প্রতীক ক্ষুধার্ত কুকুরের হাত থেকে রুটি বাঁচিয়ে বাড়ি ফেরে এবং দর্শকের চোখের ঠুলি খুলে দেখিয়ে দেয় প্রতিবাদের নতুন মাত্রা। ষাটের দশকের ইরানী নিউ ওয়েভ এর সমসাময়িক নির্মাতা হয়েও, কিয়েরোস্তামি স্বকীয় তার নিউরিয়ালিস্টিক ধাঁচের ভিন্ন প্রকাশ ভঙ্গী ও চিত্রভাষার জন্য। তার চিত্রভাষা তথাকথিত বর্ণনামূলক না হলেও, মেলানো যায় না তথ্য কিংবা প্রামাণ্যচিত্রের সঙ্গেও। বরং দুটো বিষয়ই মিলেমিশে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় দর্শকের দিকে।

তার ছবি দেখে মনে হবে যেন কোন চিত্রনির্মাতা নন, একজন গল্পের যাদুকর বলছেন ‘ভেবে দেখতো পর্দার অন্তরালে কী আছে?’। ফলে তার এক একটা ছবি বিনোদনের গণ্ডি ভেঙ্গে দর্শককে মুখোমুখি করিয়ে দেয় রুঢ় বাস্তবতার এবং উদ্বুদ্ধ করে কারণ অনুসন্ধানে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ‘টেস্ট অফ চেরি’র কথা। ছবির শুরুতে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া ‘বাদী’র পরিচয় সম্পর্কে একজন দশর্ক শুধু এতটুকুই জানতে পারেন যে, লোকটি আত্মহত্যা করবে। এরই ধারাবাহিকতায় পরিচালক দর্শককে মুখোমুখি করিয়ে দেন জীবন সম্পর্কে নানান প্রশ্নের।

সেই প্রশ্নগুলো একজন দর্শককে শুধু সচকিত করে না, ভাবনার গৎবাঁধা বৃত্ত ভেঙ্গে জীবন সম্পর্কে করে তোলে চিন্তিত। কিয়েরোস্তামির ছবির প্রতিটি ফ্রেম, দৃশ্য ও শব্দকল্প কথা বলে মানুষের একাকিত্ব, গল্প-অগল্প এবং মৃত্যু ও কবিতার। এইদিক থেকে বলা যায়, তার চিন্তা জগত অন্য যে কারোর চাইতেই আলাদা। নিজের সেই চিন্তা জগত তিনি উন্মোচন করেন তার নিজস্ব প্রকাশভঙ্গী এবং চিত্রভাষার প্রকরণে। সুইডিস চিত্র নির্মাতা ইঙ্গমার বার্গম্যান মানুষের একাকিত্ব চিত্রিত করতেন ক্লোজআপ শটে।

ফলে অভিনেতা অভিনেত্রীর সমস্ত আবেগ কিংবা চিন্তার বলিরেখো চোখ এড়াতো না একজন দর্শকের। কিয়েরোস্তামির সমস্ত ছবিতে হয়তো বার্গম্যানের মতন বিগ ক্লোজআপ শটের বহুল ব্যবহার নেই। কিন্তু ‘টেন’ ছবিতে ক্লোজআপ শটের ব্যবহারে তিনি যেন হাজির হন ভিন্ন চেহারায়। কৌশলের দিক থেকে ছবিটির একটি বিশেষ ব্যাপার হল, ছবিটি নির্মাণের সময় সেটের চৌহদ্দিতে ছিলেন না পরিচালক। আর অবিশ্বাস্যভাবে ছবিটির সেট ছিল একটা ছোট্ট গাড়ির ইনডোর।

তাতে ক্যামেরা বসিয়ে দিয়ে কিয়েরোস্তামি ছবির পাত্র-পাত্রীদের বলে দিলেন কে কী বিষয়ে কথা বলবে। এভাবেই পুরো ছবি জুরে মানুষের জীবনের দৈন্দিন দিকটিকে তুলে ধরতে গিয়ে তিনি ব্যবহার করলেন বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলের ক্লোজআপ শট। যার মধ্য দিয়ে উঠে এল মানুষের একাকিত্বের নানান বিষয়। ছবিটি শুধু গল্পের বৃত্তে আবদ্ধ নয় বলে সেটা হয়ে উঠেছে অনেকটা প্রামাণ্যচিত্রের মত। তার প্রায় প্রতিটি ছবিতেই তিনি ভেঙ্গেছেন চলচ্চিত্রে সাহিত্য অথবা গল্পের বৃত্ত।

কিয়েরোস্তামির অনবদ্য সৃষ্টি ‘দ্যা উইন্ড উইল ক্যারি আস’ ছবির একটি বিখ্যাত লং শট যেখানে সোনালী শষ্যের মাঝখান দিয়ে স্কুটারে এঁকে বেঁকে যাওয়া পথ পাড়ি দেন একজন ডাক্তার, সঙ্গে পরিচালক। পথে যেতে যেতে ডাক্তার ওমর খৈয়ামের কবিতা শোনান, ‘কিন্তু আমি তো বলব শারাব-ই ভালো বর্তমানকে সে ধাবিত করে অতীত কিংবা ভবিষ্যত ছিঁড়ে যদিও মাঝে মাঝে বহুদূর থেকে শোনা যায় ড্রামের ছন্দিত শব্দ আর তখন শুনে মনে হয় শারাব-এর চেয়ে ড্রাম অনেক চমৎকার’ কবিতা লেখা হয় শোনার জন্য আর চলচ্চিত্র নির্মাণের লক্ষ্য দর্শন ও শ্রবণ উভয়ই। ফলে কবিতা ও চলচ্চিত্র-দুটো ক্ষেত্রেই একটা বিষয় সাধারণ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে আর তা হল লিরিক। কিয়েরোস্তামির প্রতিটি সিকোয়েন্সে শব্দ আর ফ্রেমের লিরিক্যাল অভিব্যক্তি একটা চমৎকার চেতনা তৈরি করে দর্শকের মনে। যেমন করেছে ‘দ্যা উইন্ড উইল ক্যারি আস’ এর কবিতাটি যার অর্থ বিশ্লেষণে বেরিয়ে আসে ভালোর জন্য, সুন্দরের জন্য মানুষের শতাব্দী প্রাচীন হাহাকার ও অন্তঃসার শূন্যতা।

কিয়েরোস্তামি তার প্রায় ছবিতেই শুধু খৈয়াম নন, তুলে এনেছেন সোহরাব সেফারী এবং ফরুখজাদ এর মতো পার্সিয়ান কবিদের কবিতা। সেসব কবিতার দার্শনিক ভাবাদর্শ তার এক-একটা ছবিকে একই সঙ্গে করে তুলেছে ধ্রুপদী ও আধুনিক। ছবিতে ব্যবহৃত কবিতার শব্দগুলোর কোন আক্ষরিক বাস্তব অস্তিত্ব না থাকলেও, ছবির স্থান কাল চেতনা ভেদ করে কবিতা আর ইমেজের সংযোগে সৃষ্টি হয়েছে এক অনন্য স্বপ্নময়তা। কবিতা, একাকিত্ব ও মৃত্যু- ছবির এই তিনটি ভিন্ন প্লটের সঙ্গে কিয়েরোস্তামির আরও একটি উল্লেখযোগ্য ফর্ম হলো প্যানোরমিক লং শট। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ‘টেস্ট অফ চেরি’, ‘লাইফ অ্যান্ড নাথিং মোর’ এবং ‘থ্রু দ্যা অলিভ ট্রি’ ছবিগুলোর কথা।

ছবিগুলোতে তিনি লং শটের মধ্য দিয়ে এক প্রকার শারীরিক দূরত্ব তৈরি করলেও, মন ও মননের জায়গা থেকে দর্শক ও ছবির ইমেজকে এক করে দিয়েছেন। বিশেষ করে ছবিগুলো যখন গল্প বলে মানুষের ভাগ্য ও তার শেষ পরিণতি বিষয়ে। ‘টেস্ট অফ চেরি’ ছবিতে আত্মহত্যা করতে যাওয়া বাদীর স্থির ক্লোজ-আপ শটের পর দেখানো হয়েছে বিস্তীর্ন ধু-ধু পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে চলেছে তার গাড়ি। ফ্রেমে ছবির বিশালত্বের মতন দর্শকের ভেতর এই ইমেজ তৈরি করে এক অদ্ভুত বেদনা ও নিঃসঙ্গতা। পুরো ছবিটা জুরেই আছে এমন সব কাব্যিক শট।

মজার ব্যাপার হল, এই দূরত্ব বাস্তবিক দূরত্বের বৃত্ত ভেঙে দর্শকের খুব কাছাকাছি চলে আসে তখনই, যখন পরিচালক মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতিকে মিলিয়ে দেন সামগ্রীক পরিবেশের সঙ্গে। মিলেমিশে যাওয়ার এই প্রক্রিয়ায় চমৎকার দ্যোতনা দেয় শব্দ। ‘টেস্ট অফ চেরি’র শেষ দৃশ্যের লং শটে যখন ছবির অন্ধকার পর্দা আলোকিত করে বিজলী চমকে ওঠে এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে, তখন দর্শক ক্রমশ কৌতুহলী হয়ে ওঠেন এবং তাদের ঐ কৌতুহলী চোখ ধরে নেয় এটাই বাদীর শেষ পরিণতি। দর্শকের ভেতর এমন ভাবনা তৈরিতে সাহায্য করে ফ্রেমের বিশালত্ব এবং বজ্রপাতের শব্দ। পরিচালক এভাবেই মানুষের ভেতরের বোধকে অনেকটা ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তোলেন।

ফলে নিজের কবরে শুয়ে থাকা বাদীকে দেখে দর্শক কল্পনায় এঁকে নেয় গল্পের শেষটা কী হতে পারে। পারস্য উপসাগরের কূলে কিয়েরোস্তামি একজন পার্সিয়ান সুলতান। তার রাজত্ব শুধু চলচ্চিত্রের ফ্রেমে নয়, বরং সেটা বিস্তৃত তার দার্শনিক ভাবনায়, চিত্রকল্পে ও কবিতায়। কিয়েরোস্তামির একটা বিশেষ সুবিধা আছে, আর সেটা হল চিত্রনাট্যের ভাবনাকে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা। আর কবিতার কথা বলতে গেলে ‘টেস্ট অফ চেরী’র সেই বিখ্যাত উক্তিটি বলতেই হয়, ‘সত্যের খুব কাছাকাছি যাওয়ার সহজ পথ মিথ্যা।

[সংগ্রীহিত]


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.