পাকিদের মতোই কামান দেগে ভাঙল জাতির স্মৃতির মিনার, এও দেখতে হলো বাঙালীকে?
এবার প্রশ্ন উঠতেই পারে- আর কী তবে বাকি থাকল? সত্যিই বাকি নেই কিছু। সবই করে দেখিয়েছে জামায়াত-শিবির এবং যা করছে সবাই বাংলাদেশের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে করছে। সর্বশেষ শুক্রবার চাঁদপুরে জাতীয় পতাকা টুকরো টুকরো করেছে তারা। অথচ এই পতাকা যে ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া! জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। গীতিকবির ভাষায়- এই পতাকা ঐক্যের/ মৈত্রী ও সখ্যের/সূর্য রাঙা বিপ্লবের দীপ্ত পতাকা...।
এই পতাকা মায়ের মুখ। এই পতাকা বাংলাদেশ। কবির ভাষায়- ওই পতাকা আমার মায়ের মুখের মতো/ কারুকার্যময়/ ওই পতাকা আমার বাবার চোখের মতো/ দূরদৃষ্টিময়/ ওই পতাকা আমার প্রতিটি দিনের মতো চিরবিস্ময়...। এর পরও কী করে পতাকা পুড়িয়ে দেয়া হয়? এর মানে তো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে অস্বীকার করা।
একইভাবে ভাষার মাসে শহীদ মিনার আক্রমণ করেছে জামায়াত-শিবির। এমন ঘটনায় যেন বিলাপ করে কাঁদছে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। যে দেশের শিশুটি নিজ হাতে শহীদ মিনার গড়ে তাতে ফুল দিয়ে গাইতে জানে ‘আমার ভাইয়র রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি’ সে দেশে কী করে আক্রান্ত হয় শহীদ মিনার? স্বাধীনতার ৪২ বছর পর এ দৃশ্য কেউ কল্পনাও করতে পারছেন না। তবে ঘটেছে। একদিন আগে যে শহীদ বেদী ফুলে ফুলে ভরে উঠেছিল, সেটিকে তারা পায়ে মাড়িয়েছে।
ফুলের ডালা আছড়ে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করেছে। এদিক ওদিক ছুড়ে মেরেছে। ফুলে আগুন দেয়া যায়! তাও করে দেখিয়েছে জঙ্গীরা। এরা সীমানা প্রাচীর উপড়ে ফেলেছে। সিলেট, ফেনীসহ বিভিন্ন স্থানে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
সব দেখে মনে হয়েছে, এটি ১৯৫২ সাল। এটি ১৯৭১। ১৯৫২ সালে পাকিস্তানীরা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল স্মৃতির মিনার। একবার নয়। বার বার।
একই ঘটনা তারা ঘটিয়েছে একাত্তরে। এ কাজ করে পাকিরা যেমন আনন্দ পেয়েছিল, ঠিক সে আনন্দের রেখা দেখা গেছে ২০১৩ সালের আক্রমণকারীদের চোখেমুখে! নজিরবিহীন এ ঘটনা ঘটনানোর সময় স্পষ্টতই মনে হয়েছে, এরা যা করছে জেনেবুঝে করছে। খুব সতর্ক জামায়াত-শিবির বুঝে গেছে, জেগেছে বাঙালী। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে চলমান আন্দোলন ছড়িয়ে গেছে সারা দেশে। এভাবে চলতে থাকলে দলের নেতা যুদ্ধাপরাধী গো. আযম, নিজামীদের কেউ বাঁচাতে পারবে না।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ শস্তি মৃত্যুদ- অপেক্ষা করছে ঘাতকদের জন্য। এ কারণেই মরিয়া তারা। অনেক দিন ধরেই এরা নানা ব্যানারে গাড়ি ভাংছে, আগুন দিচ্ছে। মানুষ মারছে। কিন্তু বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ এমন জেগে ওঠবে- ভাবেনি হয়ত।
তাই উন্মাদের মতো আচরণ করছে। পতাকা পোড়ানো এবং শহীদ মিনার আক্রমণের পাশাপাশি সম্প্রতি দেশব্যাপী গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চগুলো ভেঙ্গেছে এরা। অপরাধ- এসব মঞ্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গান কবিতা হয়েছে। সেøাগানমুখর তরুণ প্রজন্ম জানিয়ে দিয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি ছাড়া ঘরে ফিরবে না তারা। এমন ঘোষণায় ভীত রাজাকাররা যুদ্ধাপরাধ ইস্যু পাশ কাটিয়ে নতুন জিকির তুলেছে।
এরা বলছে, ইসলাম ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আর এ অপকর্মটি করছে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা! এরপর এরা হামলে পড়েছে মঞ্চগুলোর ওপর। শাহবাগ আন্দোলন নস্যাত করতে মাঠে নেমেছে তারা। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে চলা আন্দোলনকে বলছে নাস্তিকতা। ইতোমধ্যে আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন ব্লগারকে তারা একাত্তরের স্টাইলে খুন করেছে।
এবং অতঃপর নিজেদের মিডিয়া ব্যবহার করে জঙ্গীদের উস্কে দেয়ার চেষ্টা। সেই ধারাবাহিকতায় শুক্রবারের আক্রমণ। কিন্তু জাতীয় পতাকা ও শহীদ মিনারের প্রতি এদের এত ক্রোধ কেন? জানতে চাইলে ভাষা সংগ্রামী আহমেদ রফিক জনকণ্ঠকে বলেন, জাতীয় পতাকা আমাদের পরিচয় বহন করে। শহীদ মিনার আমাদের গর্ব। আমাদের অতীত গৌরবের কথা মনে করিয়ে দেয় শহীদ মিনার।
সাহস যোগায়। আমাদের জয়ী হতে শেখায়। অন্যদিকে জামায়াতীরা শহীদ মিনারের দিকে তাকালে দেখে পরাজয়ের ইতিহাস। এ কারণে তারা শহীদ দিবস মানেনি। মানে না।
একইভাবে স্বাধীন বাংলাদেশকে গ্রহণ করেনি। করে না। অর্জিত স্বদেশ মনে করে না বাংলাদেশকে। ফলে পতাকায় আগুন দিতে পারে। শহীদ মিনার ভাংচুর করতে এদের দুইবার ভাবতে হয় না।
একই প্রসঙ্গে ভাষা সংগ্রামী কামাল লোহানী বলেন, জামায়াত সবসময় ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করেছে। এখনও করছে। আর সব ব্যর্থ হলে এরা ধর্মকে সামনে নিয়ে আসে। এই এখনও এরা বলে, শহীদ মিনারে ফুল দিলে পুজো করা হয়। এটা গুনাহ।
এই যুক্তি দেখিয়ে শহীদ মিনারে আক্রমণ করা হয়েছে। শেষ বয়সে এসে জাতীয় পতাকা ও শহীদ মিনারের এমন অবমাননা দেখে যারপরনাই ব্যথিত বলে জানান এই ভাষা সংগ্রামী। এদিকে, বহুকাল ধরে শহীদ মিনারকে আশ্রয় করে কর্মকা- পরিচালনা করে আসছে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অভিভাবক সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। শুক্রবারের ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছে জোটের নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মীরা। এ প্রসঙ্গে জোটের সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ জনকণ্ঠকে বলেন, শহীদ মিনারের পাদদেশে এসে দাঁড়ালে আমাদের চোখে রফিক শফিক বরকতের মুখ ভেসে ওঠে।
ভাষার জন্য যে আত্মত্যাগ, সে আত্মত্যাগের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয় শহীদ মিনার। কালের ধারাবাহিকতায় আজ ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কিন্তু বাংলাদেশের কোন অর্জন মেনে নিতে পারে না জামায়াতীরা। তাই অর্জনগুলো নষ্ট করার চক্রান্ত করে। শুক্রবারও তাই করেছে।
তিনি বলেন, শহীদ মিনার আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির আমাদের মৃত্যুযন্ত্রণা দিয়েছে। এ দল একাত্তরে মানুষের বাড়িতে আগুন দিয়েছিল, মায়েদের মেয়েদের পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দিয়েছিল। লুট করেছিল। সে একই রূপে এখনও ধরা দিচ্ছে এরা। পতাকা পোড়ানোর ঘটনায় ক্ষুব্ধ এই মুক্তিযোদ্ধা আক্ষেপ করে বলেন, এ জন্য কী আমরা যুদ্ধ করেছিলাম! নাসির উদ্দীন ইউসুফ শাহবাগের আন্দোলনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত আছেন।
এ আন্দোলন সম্পর্কে জামায়াতীরা অপপ্রচার করছে জানিয়ে তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করলে কেউ নাস্তিক হয়ে যায় না। আর কে আস্তিক কে নাস্তিক সেটি জামায়াত নির্ধারণ করে দেয়ার কে? তিনি বলেন, কোন খুনী ধর্ষক লুটেরার মুখে ইসলামের কথা মানায় না। সাম্প্রতিক ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, এর পর জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে নানা অলোচনার সুযোগ নেই। একটিই আলোচনা- এই দলটিকে নিষিদ্ধ করতে হবে। সরকার চাইলে কয়েক দিনের মধ্যেই সেটি সম্ভব বলে জানান তিনি।
অন্যথায় সাংস্কৃতিক জোটের নেতৃত্বে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা দেন জোট নেতা।
অবশ্য, এমন একজন দুজন নয়। একটি দুটি সংগঠন নয়। বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল মানুষ পতাকা পোড়ানোর ঘটনায় ব্যথিত। শহীদ মিনারের অবমাননা সইতে পারছেন না তারা।
তাঁদের মতে, এভাবে চলতে থাকলে হুমকির মুখে পড়বে স্বাধীনতা। আর তাই সময় থাকতে নিষিদ্ধ করা হোক জামায়াত-শিবির। নিপাত যাক ইসলামের শত্রুরা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।