সুজিত, আসো আমরা বন্ধু হই। সাদা কলেজ ড্রেস আবৃত সুরভীর সাদা বন্ধুত্বের সাবলীল আহ্বান। বাজারে প্রথম গলি শুরুর প্রান্তে আমার ছোট্ট দোকান আর অন্য প্রান্তে ওদের বাড়ি। দোকান চালাই, পড়ালেখাও করি। সুরভীকে আসতে যেতে অনেক দেখেছি।
কথা হয়নি কখনো। এবারই ও এসএসসি দিয়ে আমাদের কলেজে ভর্তি হয়েছে। আমি অনার্স থার্ডইয়ার। দু’একদিনের চোখাচোখি, ছেঁড়াখোঁড়া কথার পর আজ সুরভীর এ আহ্বান। আমি সুরভীরকে দেখি।
এতো কাছ থেকে এই প্রথম। জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধতা মাখা গোলগাল মুখটা আমার ভালো লাগে। সুরভীর আবেদন মঞ্জুর করা যায়। তবু কি এক বোধ বুকটা খামচে ধরে। আমি তো হিন্দু।
ভাড়া থাকি। বাড়ি নেই। কিন্তু সুরভী তো সব জানে তাছাড়া হাতটা ও আগে বাড়িয়েছে। তখনও সুরভী জিজ্ঞাসা চোখে তাকিয়ে আছে। আমি ফেরাতে পারি না ওকে।
হ্যাঁ, সূচক আলতো ঘাড় নাড়ি। ওর চোখের তারায় খুশির ফুল ফোটে।
তারপর থেকে আমরা বন্ধু। কিন্তু ক্ষণে দৃশ্য-অদৃশ্য বুকের বোধটা স্বাভাবিক হতে দেয় না আমাকে। তাইতো সুরভীর অভিযোগ মাখামাখি হয়ে আমাদের বন্ধুত্বের জল গড়ায়।
খানিক পথে হাঁটতে কখনো ক্যাম্পাসে অল্প কথা হয়। কিন্তু এ স্বল্পতার রেশে দীর্ঘতার আকুতি থাকে। তবু নিস্পৃহতায় দুজন দুপথে হেঁটে যাই। আমরা বন্ধু। সুরভী বলে, আমি নাকি সরল।
বোকাও। আরো কতো কি! সে আমার একটা প্রেমও দেখতে চায়। বললো মেয়ে জুটিয়ে দেবে। আমি মন দিয়ে ওর কথা শুনি। খলবলিয়ে উঠতে পারি না।
কি বলব! মেয়ে বন্ধুকে কি বলতে হয় বুঝে উঠতে পারি না। সুরভী আমার প্রথম প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ। মাঝে মাঝে বুকে একটা গান গুনগুনিয়ে ওঠে।
মুহূর্তে দৃঢ় শাসনে তা থেমেও যায়। আমার মনে পড়ে আমার ধর্ম ভিন্ন।
বাড়ির কাছে পরিচিত জনদের সামনে সচেতনতায় দাঁড়িয়ে আমি কিংবা সুরভী কখনো কথা বলিনি। সুরভী কখনো আমার দোকানে আড় চোখে তাকিয়ে চলে যায়। কিংবা জানালার ওপাশে চলে যায়। কিংবা জানালার ওপাশে একটু দাঁড়াও। আমি বুঝি।
মনোযোগ দেই না। আমার অসুস্থ বাবার বড়ো ছেলে আমি। ভাইটা ছোট। বাবা-মায়ের চোখে স্বপ্ন কাজল তা আমি মুছে দেই কীভাবে। তাই এ প্রাচুর্যহীন বাস্তবতায় অন্যদিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় কোথায় আমার।
সুরভী ঠিক করে আমরা ঘুরতে যাবো দূরে কোথাও। আমি না করি না। একটুবা বেঁচে থাকার রঙ খুঁজি। বাসে পাশাপাশি আমি, সুরভী। ও বারবার আমার মুখে তাকায়।
বলে কিছু বলো। কিন্তু সুরভীর উষ্ণতা ছুঁয়ে মনের গভীরে কাঁপন লাগে। অনুভব ছাড়া আমার কিছু বলার নেই। কি চমৎকার জায়গা! অসংখ্য গাছ ছাওয়া ঘন সবুজ চারপাশ। কাছে শান্ত লেক।
কতোদিন পর সবুজ দেখলাম। আনন্দে সুরভীর হাতটা ধরতে ইচ্ছা করে। আমরা বসি। অন্যদের মতো ঘন হয়ে না। খানিক দূরে দূরে।
কতো কথা! তারপর হাঁটি। পাশাপাশি সমান্তরাল। হাতে হাত নেই। আমরা যে বন্ধু। আচমকা নীলাকাশ কালো হয়।
তবু সুরভীর চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ে না। আজ আমরা ভিজবো। কি বলে মেয়ে! তাকিয়ে দেখি ঘনায়মান আকাশের রহস্য ওর চোখেমুখেও। প্রথমে ফোঁটায় ফোঁটায় ব্যথা ভাঙে আকাশ। তারপর ঝরঝর।
আমরা ভিজি না। ঘন পাতা ছাওয়া গাছের তলায় দাঁড়াই। খানিক দূরে সুরভী। তুমুল বৃষ্টি পাতা চুইয়ে হুড়হুড় ঝরে আমাদের চুলে, গায়ে। খোলা পথ, গাছতলা ভিজে একাকার।
তবু দাঁড়িয়ে থাকি দুজন, বৃষ্টির শব্দ বুকে। সুরভী শীতে কাঁপে। ও বৃষ্টি থেকে লুকোতে কিংবা উষ্ণতার আকুতিতে আমার বুকে আশ্রয় খোঁজে না। আমরা যে বন্ধু। প্রেমিক-প্রেমিকা নই।
- রানা মুহম্মদ মাসুদ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।