প্রিয় খালেদা জিয়া,
আপনাকে এভাবে চিঠি লিখতে হবে ভাবিনি কোন দিন। জিয়া যখন নিহত হলেন আমি তখন একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। সে হিসাবে বলা যায় আমি অপনার ছেলের বয়সী। আর সেই দাবী থেকেই এই চিঠি লেখার প্রচেষ্টা। আমাদের বেড়ে ওঠার সময় এদেশের মানুষের উপর জিয়াউর রহমানের একটি বিশাল প্রভাব ছিল।
তখন দেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী ইতিহাস অর্ন্তহিত হয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে বীর মুক্তি যোদ্ধা জিয়ার ছবি। তাঁর নামে অনেক গল্প গাঁথা চালু হয়েছে। তার কতটুকু সত্যি আর কত টুকু মিথ সে সব বিবেচনার বয়স সেটি নয়। জিয়া ছাড়া আমাদের সামনে অন্য কোন আদর্শ তখন ছিলোনা।
জিয়ার সাথে কৃতি ছাত্রদের গভীর সমৃদ্র ভ্রমণের পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। রাজকীয় আতিথ্য শেষে মেধাবী ছাত্রদের অনেকেই হয়ে ওঠেন দলীয় মুখ পাত্র। যারা ছাত্র নেতা হন গোলাম ফারুক অভি তাদের অন্যতম।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অনেক সমালোচনা সত্বেও ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা নিয়ে মৃত্যু বরণ করেন জিয়া। তাঁর অমন নিষ্ঠুর মৃত্যুতে আমাদের হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছে।
সেই সময়ের দর্শকপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান যদি কিছু মনে না করেনে জিয়ার সাদামাটা জীবন যাত্রার কথা জেনে, তাঁর পরিবারের ভবিষ্যতের কথা ভেবে চোখ ভিজে এসেছে প্রায় সকলেরই। নিয়মের ব্যাত্যয় ঘটিয়ে মন্ত্রী সভায় রাষ্ট্রপতি সাত্তার যখন সেই জিয়া পরিবারকে দু'টি সরকারী বাড়ি বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেন, আপনার অসহায়ত্বের কথা ভেবে সরকারী সম্পত্তির নজির বিহীন অপবন্টনের ঔচিত্য নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। যতদূর মনে পড়ে আপনি প্রথমে সেনানিবাসের বাড়িটি নিতে চাননি। জিয়ার স্মৃতি বিজড়িত এ বাড়িটিতে আপনি জিয়া স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছিলেন।
তবে তখন আর আপনি একজন শহীদ প্রেসিডেন্টের বিধবা পত্নী মাত্র নন।
একাধারে দু'টি পিতৃহীন নাবালক সন্তানের মা ও অভিভাবক। তাই হয়তো ব্যক্তিগত আবেগ কে প্রাধান্য না দিয়ে সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তব সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন। ১৯৮১ সালের ১৩ই জুন ২৭২ শতাংশ জমির উপর নির্মিত বাড়িটি মাত্র ১ টাকায় আপনি লিজ নেন। একই সাথে গুলশানে প্রায় দেড় বিঘা জমি সহ একটি বাড়ি এবং দশ লক্ষ টাকা দেওয়া হয় আপনাকে। ছেলেদের লেখা পড়ার খরচও রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নির্বাহের ব্যবস্থা করা হয়।
একজন মুক্তি যোদ্ধা রাষ্ট্রপতির করুন মৃত্যুর পর তার সহায়হীন পরিবারের জন্যে কিছু একটু করতে পেরে আবেগাক্রান্ত জাতি সে সময় হয়তো স্বস্তি পেয়েছিল।
কিন্তু বাস্তবে ফিরে আসতে বেশি সময় লাগেনি। শোকের পহর কেটে যেত্ই রাজনীতি মনস্কদের মনে কিছু প্রশ্ন উঁকিঝুকি দিতে থাকে। তার মধ্যে সবচে' বিব্রতকর প্রশ্নটি হলো রাষ্ট্রপতি সাত্তার আপনার প্রতি যে দাক্ষিণ্য দেখিয়েছিলেন তা কি শুধুই জিয়া পরিবারকে রক্ষার জন্যে না কি দলের কাছে নিজের গ্রহন যোগ্যতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা সেখানে ছিল। এই অমীমাংসিত প্রশ্নের জবাব দেবার জন্যে তিনি আর ইহজগতে না থাকলেও এই প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ এবং আমজাদ হোসেন চৌধুরী কিন্তু এখনও জীবিত আছেন।
প্রিয় খালেদা জিয়া, সময়ের দীর্ঘ পরিক্রমায় আপনার জীবনের অনেক উত্থান পতনের আমরা সাক্ষী হয়ে আছি। পৃথিবীতে যে ক'জন মহিলা সাধারণ গৃহবধু থেকে ক্ষমতার শীর্ষে আসীন হয়েছেন তাদের অন্যতম আপনি। একসময় নিজেদের দলকে টিকিয়ে রাখার জন্যে যারা আপনাকে রাজনীতিতে টেনে এনেছিল তাদের অনেকই পরবর্তীতে অন্যান্য দলের লেজুড়বৃত্তি করেছে। আপনাকে ক্ষমতার শীর্ষে দেখার চেয়ে নিজেদের আসন পাকা করানোর দিকেই তাদের আগ্রহ বেশি থাকায় আপনার প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম দফায় আপনি তাদের দ্ধারা প্রতারিত হয়েছেন। আপনার দলের ভাষ্য অনুযায়ী আপনাকে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে দ্বীতিয়বার প্রধান মন্ত্রী হতে হয়েছিল শুধূ মাত্র তত্বাধায়ক সরকারের বিল পাশ করানোর জন্যে।
অনেক সুধীজনের ধারনা তত্বাবধায়ক সরাকারের ধারনাটি আত্মস্থ করার জন্যে এতো সংঘাতের পথে না গেলে আপনার দ্বীতিয়দফা প্রধানমন্ত্রীত্ব দীর্ঘতর হতো। তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসারপর দেশ শাসনে মগ্ন থাকার কারণে ছেলেদের দিকে নজর দেবার সময় হয়তো আপনি পাননি। তবে আপনার স্তাবকরা বুঝে গিয়েছিল তাদের স্বার্থ রক্ষায় আপনার চেয়ে আপনার ছেলেরাই অধিকতর পারঙ্গম। জিয়াউর রহমানের ইমেজ ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে আপনার সন্তানদের তারা দুর্নীতির জগতে ঠেলে দেয়। বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মত নিবেদিত প্রাণ রাজনীতিবিদকেও বিএনপির কাছে নিগৃহীত হতে হয় শুধু মাত্র নিরপেক্ষ ভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের চেষ্টার কারনে।
অলি আহমেদের মত পরীক্ষীত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কে বি এনপি ছাড়তে হয় আপনার পুত্রের স্বেচ্ছাচারের প্রতিবাদ করে। আপনার বুদ্ধিদাতাদের কারনে আপনার নিজের জন্মদিনটি পর্যন্ত হারিয়ে যায়। ম্যাডাম আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে পুরোনো দিন গুলির দিকে তাকালে আপনি নিজেকে চিনতে পারেন তো?
আপনার জীবনের দীর্ঘতম সময় আপনি যে বাড়িতে বসবাস করেছেন শুনেছি ৬ মঈনুল রোডের সে বাড়িটি এ ক্যাটাগরি ভুক্ত সামরিক সম্পত্তিতে নির্মিত। এধরণের সম্পত্তি লিজ দেবার বিধান না থাকলেও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আপনাকে লিজ দেওয়া হয়েছিল, লিজের সমম্পত্তি কিভাবে আপনার নামে মিউটিশন হয়ে যায় বুঝতি পারিনা। তবে জিয়ার আদর্শ আর নিরাভরণ জীবনের কথা ভেবে কষ্ট পাই।
এ কারনেই প্রশ্ন ওঠে বীর উত্তম জিয়ার পরিবারকে আবেগের বসে যে সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়েছে কোন বীর শ্রেষ্ঠের পরিবারকে তার এক শতাংশও দেয়া হয়েছে কি না।
প্রিয় খালেদা জিয়া, বিএনপি সেনাবাহিনী নির্ভর দল অথবা খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্টে বসে দল পরিচালনা করেন একথা শুনতে আর ভালো লাগেনা। সশস্ত্র বাহিনী আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। সশস্ত্রবাহিনীর সাথে দীর্ঘ সম্পৃক্ততার কারনে আপনার প্রতি তাদের সহানুভুতি থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে সেনানিবাসের ঘেরাটোপের কারনে আপনি ক্রমশঃ জন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন।
সেনানিবাসে থাকার কারনেই আপনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আপনার অপোষহীন ইমেজের অপব্যাখ্যা করার অবকাশ পাচ্ছে। জিয়ার আদর্শে গড়া বিএনপি কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষার রাজনীতি করবে এটি মেনে নেয়া জিয়া ভক্তদের পক্ষে মেনে নেয়া সহজ নয়। আজ যারা রাজনৈতিক ভাবে বাড়িটির ফয়সালা করতে চাচ্ছে, আপনার নিশ্চয় মনে আছে এক আগে বছর আপনার এসব মন্ত্রণাদাতারাই বাড়ির বিষয়টি আদালতে নিয়ে গিয়েছিল। আজ তারাই যখন বিষয়টিকে আন্দোলনের ইস্যু বানাতে চাচ্ছে তখন ভয় হচ্ছে পুরো বিষয়টিই শেষ পর্যন্ত বাগাড়ম্বরে না পরিণত হয় !
প্রিয় খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকের সাথেই কোন না কোন সেনাসদস্যের যোগাযোগ আছে। আমারও কয়েকজন মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তার সাথে পরিচয় আছে।
তাদের আবাসন সমস্যা প্রকট। ঢাকায় বদলী আসার পর একজন কর্মকর্তার সরকারী বাসা বরাদ্দ পেতে গড়ে আট মাস সময় লাগে। সরকারী বাসার পরিবর্তে তারা যে বাসা ভাড়া পায় তা দিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকা প্রায় অসম্ভব। স্ত্রী পরিজন নিয়ে মেসে একটি মাত্র রুম নিয়ে তারা অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করেন একথা আপনার অজানা নয়। ৬ মঈনুল রোডের যে বাসায় আপনি বসবাস করেন সেখানে মাঝারি পর্যায়ে সেনা কর্মকর্তাদের জন্যে প্রায় তিনশ' ফ্ল্যাট বানানো সম্ভব।
জিয়ার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি, আজ বাড়িটির যে অবস্থা তাতে জিয়াউর রহমানের স্মৃতির প্রতি অবমাননাই বেশি করে দৃষ্টি গোচর হয়। বাড়ির ভেতর নির্মিত সুইমিং পুল, নতুন করে নির্মিত বিলাস বহুল ভবন এবং এর রক্ষনাবেক্ষণ ব্যায়ের কথা মনে হলে আর যাই হোক আটপৌরে জীবনে অভ্যস্ত জিয়ার কথা মনে হয়না।
প্রিয় খালেদা জিয়া, দেশের মানুষ এখনও আপনাকে ভালোবাসে। বিদেশে যাবার আগে নিজের দোষ স্বীকার করে জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়ায় তারেকের উপরও নতুন করে সহানুভুতি জন্মেছে জনতার । কিছু মতলববাজ মানুষের ভুল পরামর্শে জনতার এই আস্থার এই জায়গা টুকুনষ্ট করবেন না।
শুধু একটি মাত্র বাড়ির জন্যে যদি গোটা দেশবাসী হাত ছাড়া হয়ে যায় সেটা হবে দুর্ভাগ্য জনক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।