জগৎ ও জীবনের সর্বতো কল্যাণ ও শান্তির একমাত্র কার্যকর ও পূর্ণতর ব্যবস্থাপনা হচ্ছে ইসলাম। মানুষের জীবন তো কেন্দ্রীয় বিষয়; ইসলাম এমনকী ক্ষুদ্র কোনো প্রাণীকে পর্যন্ত কষ্ট দিতে দেয় না, অযথা গাছের একটা পাতা ছিঁড়তেও বারণ করে। এ সর্বব্যাপী ইনসাফ ও মহত্ত্বই ইসলামের শক্তিমত্তার মূল। ইসলাম সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হিসেবে মানুষকে যে গুরুত্ব ও মর্যাদা দিয়েছে, মানুষের নিজের তৈরি কোনো মতবাদ তা দেয় নি। মানুষের জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত যতো প্রয়োজন দেখা দিতে পারে, স্থানকালপাত্রনির্বিশেষে জীবনপরিক্রমার যতো বাঁক তার পার হতে হয়, সবখানেই ইসলাম এঁকে রেখেছে তার চিরকালীন ও সার্বজনীন কল্যাণকর পথরেখা।
মানুষ একা জীবনযাপন করতে পারে না। সমাজবদ্ধতা তার মজ্জাগত। সুযোগ, সহযোগ, ও শান্তির জন্যেই সমাজ। কিন্তু প্রয়োজনের বিস্তৃতি ও প্রবৃত্তির অস্থিতির কারণে মানুষ যখন অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে বসে, তখনই ভেঙে পড়ে শান্তি ও সুনীতির শৃঙ্খলা। ইসলাম তাই সমস্ত ভাঙনের উৎসমুখ যেমন চূড়ান্ত প্রজ্ঞার সঙ্গে শনাক্ত করে সেসব রোধ করবার নির্ভুল পথ ও পদ্ধতি উপস্থাপন করেছে, তেমনি সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনার জন্যে মানবতাকে উপহার দিয়েছে সুবিন্যস্ত ও সুবিস্তৃত রাজনৈতিক নীতিমালা।
রাজনীতি
রাজনীতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অনেকে অনেক মতপ্রকাশ করেছেন, তা হতে বেছে নেয়া কয়েকটি :
# রাজনীতি ওই বিদ্যা যাতে রাজা-প্রজা, শাসক-শাসিত এবং সহাবস্থানকারী জাতিসমূহের মধ্যে ন্যায়নিষ্ঠ, কল্যাণকর ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে আলোচনা করা হয়।
# রাজনীতি ওই শাস্ত্র যার মাধ্যমে এমন নীতিমালা ও আইন-কানুন জানা যায় যা দ্বারা মানুষের সমাজজীবন শান্তিপূর্ণ ও কল্যাণকর হয়।
# এমন প্রক্রিয়া যা দ্বারা জনসমষ্টি সম্মিলিত সিদ্ধান্ত তৈরি করে।
# সামাজিক ক্ষমতালাভের জনযোগমূলক প্রক্রিয়া।
# অঞ্চলবিশেষে সরকার গঠন ও পরিচালনার পেশা।
# রাষ্ট্রীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট ধারণা।
রাজনীতির উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর কোনো কোনোটি পূর্ণ নয়, তবে এগুলো সামনে রেখে আমরা সাধাসিধে কথায় বলতে পারি : রাজনীতি হলো এমন নিয়ম ও কাজ যা দিয়ে মানবসমাজে সার্বজনীন ন্যায়প্রতিষ্ঠা ও শাসক-শাসিতের সুসম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। উল্লেখ্য, মানুষের মধ্যে নীতিবোধ, হৃদ্যতা ও সৌহার্দ সৃষ্টি করে তাদের জীবনকে সুখী ও সমৃদ্ধ করাই যেহেতু রাজনীতির প্রতিপাদ্য বিষয়, তাই --
# রাজনৈতিক নীতিমালা সব রকম যুলম-অত্যাচারমুক্ত হতে হবে।
# এমন সার্বজনীন চিন্তা-চেতনা ও সভ্যতার ধারক হতে হবে যা সকলের জন্যে অনুসরণীয় হতে পারে।
# অত্যাচার, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও সামাজিক অবক্ষয় রোধে পূর্ণ কার্যকর হতে হবে।
# লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, প্রতিহিংসাপরায়ণ, অত্যাচারীদের দমন করে দুর্বল, নিরীহ, শান্তিকামী মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
# নীতিগুলোতে অপরাধের প্রতি ঘৃণা সঞ্চার ও ন্যায়পরায়ণতায় উজ্জীবিত করার শক্তি থাকতে হবে।
ইসলাম নিছক কোনো ধর্ম নয়, নয় এজন্যেই যে তাতে এমন সবকিছুই আছে যা ধর্মের ‘ধারণ’ ও ধারণার বাইরে। প্রস্তরফলকে খোদিত দশটি বাণী বা বোধিবৃক্ষের নিচে বসে সহসা টের পাওয়া চকিত কোনো বোধ সম্বল করে ধর্ম চলতে পারে, কিন্তু বিশ্বজনীন জীবন তা পারে না। তেমনি ইসলাম স্রেফ কোনো স্থানিক ও সাময়িক সমাজতত্ত্বও নয়, দেশকালের পরিবর্তনে যা অকার্যকর হয়ে পড়বে।
বরং ইসলাম প্রকৃত অর্থেই পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, একটি সুসংবদ্ধ ও সুষ্ঠু আদর্শ। গোটা মানবতা যার ছায়ায় নিরবচ্ছিন্ন আশ্রয় পেতে পারে এ তেমন একটি মহীরূহ, তার প্রতিটি পাতার সম্পর্কই শেকড়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ। ইসলামের খুঁটিনাটি বিষয়গুলোও এমনই মূলানুগ ও সংহত। তাই ইসলামী জীবনের যে কোনো বিভাগকে বুঝতে হলে সূত্রানুযায়ী তার মূল স্তম্ভকে বিশ্লেষণ ও অনুধাবন করতে হবে।
সূরা মায়িদাহর ৪৪-৫০ পর্যন্ত সাতটি আয়াতে আল্লাহ তা’লা হযরত মূসা, ঈসা ও মহানবী সা. এর শরীয়ত নিয়ে আলোচনা করেছেন।
তিনটি শরীয়তের যৌথ বিধান আল্লাহর দেয়া নিয়ম অনুযায়ী ফায়সালা ও মীমাংসা করতে হবে। এজন্যে হযরত মূসা আ. ও তৎপরবর্তী নবীগণকে নিজ নিজ সময়ের রাজ-রাজড়াদের মোকাবেলা করতে হয়েছিলো সবচে’ জোরালোভাবে। কারণ এক আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দাওয়াত মানেই সমাজপতি, গোত্রপতি ও রাষ্ট্রপতিদের কর্তৃত্বে আঘাত হানা। আবু জাহল-উতবার মতো মক্কার অসাধু স্বার্থান্ধ গোত্রপতিরা তাদের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব অবসানের আশঙ্কায়ই আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধে এতোটা ক্ষেপে উঠেছিলো।
মানববুদ্ধি ও আইন রচনা
আল্লাহ তা’লার কথামতো মানুষকে অতি সামান্য জ্ঞান দান করা হয়েছে।
মানুষের বিবেক-বুদ্ধি মোটেই পূর্ণ নয়। আগের দিন মানুষ যা কল্যাণকর ভাবে পরদিনই তাতে অমঙ্গল খুঁজে পায়। অনেকে মিলে দীর্ঘ চিন্তাভাবনার পর গ্রহণ করা সিদ্ধান্তও ক্ষণিকের মধ্যে ভুল প্রমাণিত হতে দেখা যায়। বড় বড় বুদ্ধিজীবী আর দার্শনিকেরা নিজেদের অপরিণামদর্শিতা আর জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে গেছেন অপকটে। মানুষের বুদ্ধির দশা যদি এমনটাই হয়, তাহলে তার পক্ষে আইন রচনার মতো কাজে হাত লাগানো কতোটা যুক্তিসঙ্গত? যে নিজের জন্যে খানিক পরের বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম, সে গোটা জাতির জন্যে স্থায়ী ও কল্যাণকর নীতিমালা প্রণয়ন করবে কীভাবে?
তাছাড়া মানুষ প্রবৃত্তিপরায়ণ ও উচ্ছ্বাস-আবেগের ঢেউয়ে নিরন্তর দোলায়মান।
নিখুঁত বুদ্ধি ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সুপ্রমাণিত অনেক সত্যকে মানুষ প্রবৃত্তি ও আবেগের চাপে জলাঞ্জলি দিয়ে বসে। ধরা যাক আমেরিকার মদ্যপান নিরোধ আইনের কথা। একসময় তাদের কাছে বুদ্ধি ও যুক্তির আলোকে প্রবলভাবে প্রতিভাত হয়েছিলো মদ স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। মন, বুদ্ধি ও বিবেকশক্তির ওপর মদ্যপানে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এই সত্য উপলব্ধি করে মদ্যপান নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করতে তারা সরকারকে চাপ দেয়।
জনগনের চাপে সরকার আইন পাশ করে। কিছুদিনের মাথায় দেখা গেলো, যাদের তাগিদে আইন পাশ হলো, তারাই আইনটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসলো। আইনি বাধা উঠে যাওয়ার পর দেশের যত্রতত্র আগের চে’ বেশি পরিমাণে নিকৃষ্ট হতে নিকৃষ্টতর মদ তৈরি হতে লাগলো। বৈধাবৈধতার নির্ণায়ক যখন মানুষ, তখন এমন অস্থিরতা, পরস্পরবিরোধিতা ও অনিশ্চয়তা খুবই স্বাভাবিক। আমাদের দেশের ধূমপায়ী আর তামাক-জর্দ্দাখেকোরা কি জানেন না ধূমপান আর তামাক সেবনের ক্ষতিকর দিক? আলবৎ জানেন।
তবু তারা তা ত্যাগ করেন না।
এ থেকে প্রমাণিত হয়, আইন রচনার অধিকার মানুষের নেই এবং থাকা উচিতও নয়। অতি সীমিত বুদ্ধি দিয়ে স্রেফ অনুমানে ভর করে নিজেদের জন্যে নিজেরাই আদর্শ রচনার মতো জটিল, ঝুঁকিপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী কাজে হাত দেয়া আদৌ সঙ্গত হতে পারে না। এজন্যে আল্লাহ তা'লা ‘হুদুদুল্লাহ’ বা আল্লাহর নির্ধারিত সীমা নামের কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন। এই ‘হুদুদুল্লাহ’ দ্বারা মানুষের স্বাধীনতার শেষ সীমা নির্দেশ করা হয়েছে।
এ সীমার ভেতরে থেকে খুঁটিনাটি ও আনুষঙ্গিক আইন রচনার এখতিয়ার মানুষের থাকলেও সীমা অতিক্রমের এখতিয়ার তার নেই। বরং এই সীমা অতিক্রম করলেই শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হবে। অন্যায় মাথা বুলন্দ করবে। ভেঙে পড়বে সামাজিক নিরাপত্তা। বস্তুত এই অলঙ্ঘনীয় সীমা লঙ্ঘন করার ফলে সমাজ তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
নারীর যৌনস্বাধীনতা ও উত্তরাধিকারে সমতার শ্লোগানও এ সীমা অতিক্রমেরই উদাহরণ।
ইসলামের এই সীমানা পার না হলে ইভটিজিং আর এইড্স নিয়ে বিশ্ববিবেক নাকানি-চুবানি খেতো না, সাম্রাজ্যবাদী হায়েনাদের থাবায় ঝাঁঝরা হতো না মানবতার শান্ত-সুন্দর দেহ। স্থানে স্থানে নিরপরাধ শিশুদের রক্তের বন্যা বইতো না। ত্রাণবাহী জাহাজে মানবতার খাদিমদের পাখির মতো হত্যা করা হতো না। এসবই মানবরচিত আইনের শ্রেষ্ঠ উপহার।
তাই বলতে হয় মানুষ যতোবারই সার্বজনীন নীতিমালা প্রণয়নের চিন্তা করেছে ততোবারই তারা ধোঁকায় পড়েছে। কালের বিবর্তনে সীমিত জ্ঞানপ্রসূত নীতিমালার ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়েছে। যার সর্বশেষ প্রমাণ গণতন্ত্র। মানবতার নিরাপদ অস্তিত্বের জন্যে কুরআন-সুন্নাহর মাধ্যমে ইসলাম তার রাজনৈতিক আদর্শের বিশ্লেষণ করেছে।
ইসলামী রাজনীতি
ইসলামী রাজনীতির ভিত্তি তিনটি মূলনীতির ওপর স্থাপিত : ১. তাওহীদ ২. রিসালত ৩. খিলাফত।
তাওহীদ
তাওহীদের অর্থ হলো, আল্লাহপাক সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও মালিক। প্রভুত্ব , শাসন ও আইন প্রণয়নের অধিকার একমাত্র তাঁরই। তাঁর সত্ত্বা, মতা, গুণাবলি ও অধিকারে কারো কোনো অংশিদারত্ব নেই। সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী তিনিই। তাঁর আদেশ-নিষেধ মানুষের ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির জন্যে একমাত্র আইন।
ব্যক্তি, গোষ্ঠি, সমাজ, পরিবার, দল, জাতি কারো অধিকার নেই তাঁর আইনে হেরফের করা বা সাংঘর্ষিক আইন রচনা করার।
রিসালত
আল্লাহ তা’লার এ আইন মানুষের কাছে যে মাধ্যম ধরে এসে পৌঁছেছে তার নাম রিসালত। কখনো এ আইন কিতাবুল্লাহ্ আকারে আর কখনো সুন্নাতে রাসূল আকারে আমাদের সামনে হাজির হয়। আল্লাহ তাঁর কিতাবে যেভাবে যে বিধানের বর্ণনা দিয়েছেন, রাসূল (সা.) কর্মেক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন করে একটি পরিপূর্ণ ব্যবস্থা তৈরি করে গিয়েছেন।
খিলাফত
খিলাফত মানে প্রতিনিধিত্ব।
আল্লাহর যমিনে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। প্রতিনিধি বলেই : ১. সে যমিনের মালিক নয়, ২. মালিকের দেয়া আদেশ-উপদেশ অনুসারে সে যমিনকে ব্যবহার করবে, ৩. মালিক কর্তৃক স্বীকৃত স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার সীমার ভেতরে থেকেই তাকে কার্যপরিচালনা করতে হবে, ৪. মালিকের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে হবে।
ইসলামী শাসনব্যবস্থার উদ্দেশ্য
ইসলামী শাসনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের কয়েকটি স্থানে আলোকপাত করা হয়েছে। সূরা হাদীদের ২৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে : “আমি আমার নবীদের সুস্পষ্ট বিধানসহ পাঠিয়েছি। তাঁদেরকে দিয়েছি কিতাব ও মীযান, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
আমি লৌহও দিয়েছি, এতে রয়েছে বিরাট শক্তি ও মানুষের কল্যাণ। ” আয়াতে সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে কিতাব ও মীযান নাযিল করা প্রসঙ্গে লৌহ নাযিল করার বিষয় জুড়ে দিয়ে রাষ্ট্রশক্তির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। সূরা হাজ্বের ৪১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন : “এদের যদি আমি ভূপৃষ্ঠে কর্তৃত্ব দান করি তবে তারা নামায যথারীতি আদায় করবে, যাকাত দেবে এবং ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে। সূরা আল-ইমরানের ১১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে : “তোমরা সর্বোত্তম জাতি, মানুষের কল্যাণের জন্যে তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দেবে, পাপ থেকে লোকদের বিরত রাখবে এবং আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে।
”
আয়াতগুলোতে আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের পাশাপাশি সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, ভালো কাজের পথ সুগম করা ও মন্দ কাজের পথ বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
সূরা নাহলের ৯১ নং আয়াত : “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে সৎকর্মের নির্দেশ দিচ্ছেন। ” এর ব্যাখ্যায় ইমাম জাসসাস বলেন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি কুরআনের নির্দেশ আসার আগেই বিবেকের আলোকেই অপরিহার্য ছিলো। কুরআন একে আরো দৃঢ় করে দিয়েছে।
সূরা নিসার ১০৫ নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে : “আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি সত্যময় কুরআন, যাতে আল্লাহ তোমাকে যা জানিয়েছেন সে অনুযায়ী বিবাদ মীমাংসা করো।
উদ্ধৃত আয়াতগুলো স্পষ্ট নির্দেশ করছে যে, ইসলামী রাজনীতি তথা ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক উদ্দেশ্য দু’টি : এক. আল্লাহরই ইবাদতের নিরাপদ ব্যবস্থা করা; ২. আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের দ্বারা মানুষের সঠিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
ইসলামী রাজনীতির অস্বীকার
ইসলামী রাজনীতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ইতিহাস অনেক পুরনো। কেউ বলেন ইসলামে রাজনীতি নেই, ইসলাম একটি অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম। কেউ মনে করেন ইসলামে রাজনীতি আছে বটে, তবে তা অনেক সেকেলে ধাঁচের, ডিজিটাল সমাজব্যবস্থার সাথে খাপ খাওয়ার মতো নয়। বর্তমান সময়ে প্রয়োগযোগ্যতা রাখে না।
কারো মতে ইসলামী রাজনীতিতে উগ্রতা, সাম্প্রদায়িকতা, কট্টরপন্থা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অস্বীকৃতির মতো কিছু নেতিবাচক দিক বিদ্যমান থাকায় এই রাজনীতি বর্তমান সভ্য জগতের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা প্রদানের পরিবর্তে নিরাপত্তাহীন করে তুলবে। তাই তা পরিত্যাজ্য। কেউ ভাবেন, ইসলাম একটি পবিত্র ধর্ম, রাজনীতির মতো নোংরা বিষয়ের সাথে জড়ালে ইসলামের ভাবমর্যাদা বিনষ্ট হয়ে যাবে।
বস্তুত ইসলামী রাজনীতির বিরুদ্ধে এসব বক্তব্য একই সূত্রে গাঁথা। এর উৎস আমাদের কথিত সুশীল সমাজের ইউরোপ-আমেরিকা থেকে ধার করা বিবেক-বুদ্ধি।
পশ্চিম থেকে যে বুলি বাজারজাত করা হয় তা লুফে নিতে তাঁরা কার্পণ্য করেন না। পশ্চিমা প্রগতিশীলরা যখন দেখে তারা নিজেদের ধর্ম অনেক আগেই পঙ্গু করে গীর্জার খাঁচায় বন্দি করে ফেলেছে, রাষ্ট্রযন্ত্র এবং রাজনীতি হতে নিরাপদ দূরে সরিয়ে দিয়েছে, এখন যদি ইসলামকে ও খোঁড়া করা না যায় তাহলে ইসলামের সামগ্রিকতা, পরিপূর্ণতা ও ব্যাপকতা রোধ করার উপায় থাকে না। তাই ঝোঁপ বুঝে যখন যা গলধঃকরণ করানো সম্ভব ভাবে তখন তাই প্রচার করতে থাকে। সেই প্রচারণার মোহে আমাদের গঙ্গাস্নাতক বিদ্বান-বুদ্ধিজীবীরাও বিভ্রান্তিকর নসীহতের বুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। তারা যদি প্রখ্যাত বৃটিশ মনীষী জর্জ বার্নাড শ’র কথা ‘পৃথিবীর একমাত্র শতভাগ সফল ও আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক হলেন হযরত মুহাম্মদ।
রাষ্ট্রপরিচালনায় তাঁর অনুসরণ করা দরকার’ শোনেন, তবু নসীহতের বোতলের ছিপি আঁটবেন না। দুর্বৃত্ত আরব জাতির সোনার মানুষে পরিণত হওয়ার বাস্তবতা দেখে, ইতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধান কিতাবুর রাসূল বা মদীনা সনদ, খুলাফায়ে রাশেদার স্বর্ণযুগের চিত্র দেখেও তারা নিবৃত্ত হবেন না। আজো যে অনেক দেশ কিছুটা ইসলামী আইন প্রবর্তন করে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ রয়েছে এরও কোনো অদ্ভুত ব্যাখ্যা তাদের কাছে থাকতে পারে।
প্রগতির বিপুল উৎকর্ষের এই একুশ শতকে কোনো দারিদ্র্যপীড়িত দেশ যখন ইসলামী অনুশাসন পূর্ণ মেনে নিরাপত্তার নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, উদ্বৃত্ত বাজেট পেশ করতে পারে, তখন খোঁড়া অজুহাত দাঁড় করিয়ে সামরিক অভিযান চালিয়ে দেশটিকে ধ্বংস করা ছাড়া প্রগতিশীলদের কোনো উপায় থাকে না। আবার কোথাও যদি বিভ্রান্তিকর ‘নসীহতে’ পানি ঘোলা না হয়, তবে আদাজল খেয়ে বিদ্বান-বুদ্ধিজীবীরা ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধের আয়োজন চূড়ান্ত করেন।
ইসলাম একটি সার্বজনীন জীবনব্যবস্থা। মানুষকে নিরাপদ সুন্দর জীবনের সন্ধান দিয়েছে ইসলামই। কোনো অজুহাতে ইসলামকে রাজনীতি হতে মুক্ত বা রাজনীতিকে ইসলাম থেকে বিচ্যূত করার বিন্দু-বিসর্গ সুযোগও নেই। ইসলামের মৌলিক কিতাবাদিতে ইবাদতের জন্যে শত পৃষ্ঠা ব্যবহার করা হলে রাজনৈতিক বিধান বর্ণনার জন্যে হাজার পৃষ্ঠা ব্যবহৃত হয়েছে। সরাসরি কুরআন-হাদীসে ইসলামের রাষ্ট্রনৈতিক বিধিবিধান, আইন-আদালত, জননিরাপত্তা ও মানবাধিকার ইত্যাদি যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা থেকে প্রতীয়মান হয়, ইসলাম রাজনীতির সাথে আর রাজনীতি ইসলামের সাথে অঙ্গাঙ্গী জড়িত।
মুসলমান নামধারী যে বিদ্বানবর্গ ইসলাম ও রাজনীতির মাঝখানে প্রাচীর নির্মাণ করতে চান, বিজ্ঞ মুসলিম মনীষী ও রাজনীতিতাত্ত্বিকরা তাঁদের গ্রন্থাবলিতে এদের মোক্ষম জবাব দিয়েছেন। আমরা পবিত্র কুরআনের নিচে উদ্ধৃত আয়াতের আলোকে সম্মানিত পাঠককে শুদ্ধতম ফায়সালায় পৌঁছে যাওয়ার অনুরোধ করবো:
“আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম। ” (মায়িদা : ৩)।
“তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করো নি, যারা ধারণা করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা অবতীর্ণ হয়েছিলো তোমার পূর্বে তৎপ্রতি তারা বিশ্বাস করে, অথচ তারা নিজেদের মোকদ্দমা শয়তানের নিকট নিয়ে যেতে চায়, যদিও তাদেরকে আদেশ করা হয়েছিলো যেনো তাকে অবিশ্বাস করে আর শয়তান তো চায় যে, তাদেরকে সত্যের পথ থেকে বহুদূরে নিয়ে গিয়ে বিভ্রান্ত করে ফেলবে। ” (নিসা : ৬০)।
“অনন্তর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সেদিকে এবং রাসূলের দিকে এসো, তখন তুমি মুনাফিকদেরকে দেখবে, তারা তোমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। (নিসা : ৬১)।
লেখক : শিক্ষাবিভাগীয় প্রধান, শাহবাগ জামিয়া মাদানিয়া ক্বাসিমুল উলূম, জকিগঞ্জ, সিলেট।
+৮৮০১৭১২৭৪৫০৪৮
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।