এস.এম.সৈকত
মানবাধিকারকর্মী ও
নির্বাহী পরিচালক,
সিরাক-বাংলাদেশ
মানুষের জন্মগত কিছু অধিকারের মধ্যে 'বেঁচে থাকার অধিকার' প্রতিষ্ঠা যেমন জরুরী তেমনি মানুষ হিসেবে 'যথার্থ স্বীকৃতি তথা মর্যাদা'ও অত্যাবশ্যক। পৃথিবীতে মানব হিতকর যত ধর্ম,যত মত রয়েছে সবগুলোতেই মানব মর্যাদার সুনির্দিষ্ট একটি মাপকাটি নির্ধারন করা হয়েছে। রহস্যাবৃত এই মাপকাটির একটা স্বচ্ছতা রয়েছে, আর তা হল- সকল মানুষ সমান মর্যাদার অধিকারী। এখন প্রশ্ন হল এই মর্যাদা আসলে কি অর্থে বুঝি আমরা? কারো কারো মতে মর্যাদা হল বিভিন্ন ধরনের সম্পদের মালিকানার উপর প্রতিষ্ঠিত একটি অবস্থান যার বলে মানুষ শ্রেষ্ঠত্বের দিকে এগিয়ে যায়। এ মতটিকে একদম উড়িয়ে দেয়াও যায় না।
অসম সমাজব্যবস্থায় সম মর্যাদা কল্পনা করা কঠিন। একই সাথে এই দ্বন্দ্বের সমাধানও রয়েছে মর্যাদার সম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। রাজনীতি, সমাজনীতি, জননীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, শিক্ষানীতি, সমরনীতি, শিল্পনীতি, কৃষিনীতি থেকে শুরু করে কোন খারাপ নীতি যেমন দুর্নীতি পর্যন্ত মর্যাদার অধিকারের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের সংবিধানে অধিকার সম্পর্কিত প্রতিটি অনুচ্ছেদের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সর্বক্ষেত্রে মানুষের সম মর্যাদা প্রতিষ্ঠার উপর জোর দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষনায় মর্যাদার অধিকার বাস্তবায়নের জন্য এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে আহবান জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তার নাগরিকের সমমর্যাদার নিশ্চয়তা প্রদানের। কিন্তু এই রাষ্ট্র কি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারছে? প্রিয় পাঠক, রাষ্ট্রের উপর অবজ্ঞাসূচক না'টুকু আনয়নের পূর্বে আমি একটু উকালতি করতে চাই। এ প্রসঙ্গে আমি যখন উকিল হচ্ছি, তখন আমার পাশে, পিছনে অনেক রথি মহারথি রা থাকবেন। উদ্দেশ্য মূলক উকালতিতে আমি বলতে চাই- আমাদের মতো একটি দরিদ্র ! দেশের পক্ষে সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্ভব না। কারন আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে সম্পদের, মাথাপিছু আয়ের, আরো অনেক মাথাপিছু বিষয়ের।
আর তাই আমরা নাগরিকের সমমর্যাদার প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থতার দায় মাথায় নিতেই পারি।
প্রসঙ্গতঃ মর্যাদা এবং মর্যাদাবাদ অনেক বৃহত্তর বিষয়। তাই আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের স্পর্ধায় আমি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সবচেয়ে জনমুখী একটি বিষয়ের ক্ষেত্রে মর্যাদার অধিকার প্রতিষ্ঠার বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে চেষ্টা করছি। 'জনপ্রশাসন' নামক শব্দের সাথে পরিচিত মানুষের বেশী সংখ্যার সাথে আমার পরিচয় নেই। তবে 'প্রশাসন' বলতে প্রায় সবাই খুব ভাল বুঝেন সরকারী কর্মকর্তা, কর্মচারী আরো নানান রকম সরকারী ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি।
আসল কথাটা অন্যরকম। 'জন' এবং 'প্রশাসন' শব্দ দুটি একত্রে যা সৃষ্টি করে তা-ই আমাদের সংবিধানের অংশ এবং স্বীকৃত রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান। এই জনপ্রশাসন পদ্ধতির সাথে মর্যাদার অধিকার প্রতিষ্ঠার সম্পর্ক বেশ পুরোনো। কারন এখানে শাসক বলতে বাইরের কেউ থাকে না। নিজেদের প্রয়োজনে পদ্ধতিগত আচরনে এবং বিধিবদ্ধ একটি প্রশাসন পরিচালনা করে থাকে রাষ্ট্রের জনগন স্বয়ং।
এ ধরনের পদ্ধতির ধারনায়ন হয় সাধারনত যে কোন উপনিবেশিক ব্যবস্থার ভেঙ্গে পড়ার পর। এই ইতিহাস আমাদের রয়েছে। কিন্তু কোথায় যেন একটি বিচ্যূতি রয়ে গিয়েছে। কারন তাই যদি না হয় তবে আজকের জনপ্রশাসন কি করে শুধু প্রশাসনে রূপান্তর হল? আর প্রশাসন যদি জনগণ থেকে সরে যায় তবে সেই সর্বনাশ-ই হল। কারন আমার ভাই ডিসি বা এসপি হলে তাকে আমার 'স্যার' বলতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে, 'ভাই' সম্বোধন করলে তাঁর সম্মান হানি হয় (!)।
এমন বাস্তবতা এখন আমাদের দেশের জন(!)প্রশাসনে। এই মানসিকতাই সমাজে শ্রেণী বৈষম্য তৈরী করছে। আর এর প্রতিচ্ছবি দেখা যায় সভ্য কোন জাতির নাগরিকের সাথে চলতে গেলে যখন সে বলে তোমাদের দেশে তো নাগরিকের অভ্যন্তরীন বৈষম্যই দূর করতে পারলে না আর এখানে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কথা বল ! সত্যিই তখন নিজেকে আরো বেশী অসহায় মনে হয় সেই বৈরী ভিনদেশে।
আসলে সেই ফিরিঙ্গি বন্ধু যা বলেছেন তা কি সত্যি? জানার তাগিদে একটু ভেবে দেখুন আপনার জীবনের কোন এমন বৈষম্যপূর্ণ আচরনের ঘটনা। ধরুন, একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বা রাজনীতিবিদ কোন সরকারী কর্মকর্তার দারস্ত হলে তিনি তাঁকে সম্মানের সাথে চেয়ার ছেড়ে উঠে না দাড়ালেও অন্তঃত সৌজন্য প্রকাশের স্বার্থে সেই আগন্তুকের নামের শেষে 'সাহেব' যোগে সামনের চেয়ারে বসিয়ে এক কাপ চা না পান করিয়ে ছাড়বেন না।
আর কাজের ফাঁকে খোশগল্পও জারি থাকবে। কিন্তু সেই সরকারী কর্মকর্তা বাবুর দরজার বাইরে প্রায় গোটা ত্রিশেক আধনোংরা কাপড়ের মানুষ কর্ম ফেলে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় বিসর্জন দিয়ে, 'স্যার' না ডেকে অমুক (পদবী) সাহেব সম্বোধন করায় সরকারী কর্মকর্তা সাহেব ক্ষেপে গিয়ে গরীব সেই কৃষকের সাথে দুর্ব্যবহার করে তাড়িয়ে দিলেন। তাহলে কি প্রশাসন আর জন-প্রশাসন হতে পারলো? দরিদ্র সংখ্যাগরিষ্ট এই দেশে যদি জনপ্রশাসন ধনী শ্রেণীর সেবায় সদা নিয়োজিত থাকে আর গরীব মানুষকে পেতে হয় অমার্জিত আচরন, তবে মর্যাদার আয়নায় আমরা জাতি হিসেবে কেমন তা নিশ্চয় পাঠকের বোধগম্য হচ্ছে। তাই সংবিধানের সকল অংশে জন-প্রশাসন শব্দটির সংস্কার করে শুধৃ প্রশাসন দিলেই হয়। তাহলে মানুষ ভুল করে আর কোন সরকারী কর্মকর্তা মহোদয়কে 'স্যার' না বলে 'ভাই' বলতে সাহস পাবেনা।
আর যদি নাগরিকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন কোন সরকারের মূলনীতি হয়ে থাকে তবে তার উচিত রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি স্তরে প্রশাসনকে জন-প্রশাসনে রূপান্তরের উদ্যোগ গ্রহন করা। 'প্রশাসক' না লিখে 'জনসেবক' (যা বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন স্বীকৃত) লেখা উচিত। অন্যথায় তা সংবিধানের চেতনার জন-প্রশাসনের সাথে সাংঘর্ষিক হবে।
জনগণের সাথে আচরনের জন্য সুনির্দিষ্ট বিধান করতে হবে, যেন তা যেকোন রাষ্ট্রীয় বেতন কাঠামোর অধীন কর্মকর্তা-কর্মচারী মেনে চলেন এবং তা পালনের নিশ্চয়তার জন্য স্বাধীন ন্যায়পাল পদ সৃষ্টি করতে হবে। তবেই একটি স্বাধীন দেশে জনসেবক জন-প্রশাসনের সেবা পাবে সাধারন মানুষ।
নইলে বাড়বে বৈষম্য, দুর্নীতি, হানাহানি, অনাচার। বাধাগ্রস্ত হবে সরকারের সকল উন্নয়ন পরিকল্পনা। আর শত শত প্রকল্প হাতে নিয়ে, বাজেট পাশ করে, আইন করেও বিশ্বের দরবারে একটি বৈষম্যপূর্ণ জাতি হিসেবেই পরিচিত হব আমরা। আর এই বিচারে মর্যাদার আয়নায় জাতি হিসেবে কতটুকু মর্যাদা পাবার অধিকার সংরক্ষণ করি তাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।