সত্যকে বলতে শিখুন.......
মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার (ইভ টিজিং) প্রতিকার চাওয়ায় এবার এক মায়ের প্রাণ কেড়ে নিল বখাটেরা। তাঁর নাম চাঁপা রানী ভৌমিক (৪৮)। রাস্তায় মোটরসাইকেল চাপা দিয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে। ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার পশ্চিম গাড়াখোলাতে গত মঙ্গলবার বিকেলে এ ঘটনা ঘটে। বখাটেদের মোটরসাইকেলের চাপায় নাটোরের লোকমানপুর কলেজের শিক্ষক মিজানুর রহমানের মৃত্যু নিয়ে দেশজুড়ে যখন প্রতিবাদ-মানববন্ধন চলছিল, তার মধ্যেই মধুখালীতে একই রকম নৃশংস ঘটনা ঘটল।
হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ও বখাটে দেবাশীষ সাহা ওরফে রনিকে (২২) গ্রেপ্তারের দাবিতে গতকাল বুধবার উত্তাল ছিল মধুখালী। গতকাল উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী, স্থানীয় চিনিকলের শ্রমিক থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ নেমে আসে রাস্তায়। দিনভর চলতে থাকে বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সভা। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে টায়ারে আগুন দিয়ে সড়ক অবরোধও করে বিক্ষুব্ধ লোকজন।
চাঁপা রানী মধুখালীতে অবস্থিত ফরিদপুর চিনিকলের করণিক।
তাঁর স্বামী স্বপন কুমার বিশ্বাস মধুখালী উপজেলার বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের (বিআরডিবি) পরিদর্শক। তাঁদের যমজ দুই মেয়ে ফরিদপুর চিনিকল উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীতে পড়ে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে, আর মেজো মেয়ে ঢাকার ইডেন কলেজে পড়েন।
নিহত চাঁপার ভাই অরুণ কুমার ভৌমিক গতকাল বখাটে দেবাশীষকে আসামি করে মধুখালী থানায় হত্যা মামলা করেছেন। পুলিশ হত্যায় ব্যবহূত মোটরসাইকেলটি জব্দ করতে পারলেও দেবাশীষকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
মামলার এজাহারে বলা হয়, মধুখালী বাজারের মদ ব্যবসায়ী রতন সাহার ছেলে বখাটে দেবাশীষ ফরিদপুর চিনিকলের কর্মচারী চাঁপা রানী ভৌমিকের দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া যমজ দুই মেয়েকে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার পথে উত্ত্যক্ত করত। প্রতিবাদ করলে তাদের অপহরণের হুমকি দিত। মেয়েদের পড়াশোনা ও ভবিষ্যৎ চিন্তা করে এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি দেবাশীষের উত্ত্যক্ত করা বেড়ে যাওয়ায় চাঁপা রানী মধুখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান, নারী ভাইস চেয়ারম্যান সুরাইয়া সালাম ও চিনিকল উচ্চবিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের জানিয়ে প্রতিকার চান। তাঁরা দেবাশীষ ও তাঁর বাবাকে শাসন করলে দেবাশীষ আরও ক্ষিপ্ত হয় এবং চা্পাঁর পরিবারকে হুমকি-ধমকি দেয়।
এজাহারে আরও বলা হয়, গত মঙ্গলবার বিকেলে চাঁপা রানী ভৌমিক স্বামী স্বপন বিশ্বাসকে নিয়ে প্রতিবেশী হারানচন্দ্র সরকারের মেয়েকে বিদায় জানাতে মধুখালী রেলগেটে যান। সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে বিকেল চারটা ২৫ মিনিটের দিকে চিনিকল সড়কের খাদ্যগুদামের সামনের রাস্তায় বখাটে দেবাশীষ পূর্বপরিকল্পিতভাবে মোটরসাইকেল দিয়ে পেছন থেকে চাপা দেয়। এতে চাঁপার মাথা গুরুতর জখম হয় এবং মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। এ অবস্থায় চাঁপাকে প্রথমে মধুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। পরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল বেলা তিনটার দিকে চাঁপা রানীর মরদেহ পশ্চিম গাড়াখোলার বাসভবনে নেওয়া হলে হূদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। স্বজন-প্রতিবেশীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। বিকেল চারটায় বাড়ির আঙিনায় তাঁকে সমাহিত করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা: চাঁপা রানীর প্রতিবেশী হারানচন্দ্র সরকারের মেয়ে শ্রাবণী সরকার ডিভি (ডাইভারসিটি ভিসা) লটারি পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র যাবেন। তাঁকে বিদায় জানাতে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে চাঁপা রানী বাড়ি থেকে প্রায় ৬০ গজ দূরে খাদ্যগুদামের সামনে চিনিকল সড়কে যান।
হারানচন্দ্র সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাঁপা পশ্চিম দিকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। দক্ষিণ দিক থেকে দুই আরোহীসহ দেবাশীষ একটি মোটরসাইকেল দ্রুতবেগে চালিয়ে আসছে। হঠাৎ দেখি দেবাশীষ মোটরসাইকেলের গতি না কমিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা চাঁপা রানীর ওপর মোটসাইকেল তুলে দেয়। চাঁপা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মাথা দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে।
আমরা দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। ’
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ফরিদপুর চিনিকলের গাড়িচালক আকরাম শেখ বলেন, ‘দেখে মনে হয়েছে, দেবাশীষ সজোরে মোটরসাইকেল দিয়ে চাঁপা রানীর শরীরে আঘাত করেছে। রাস্তা ফাঁকাই ছিল। মোটরসাইকেলটি রাস্তা দিয়ে চললে এ ঘটনা ঘটত না। ’
প্রত্যক্ষদর্শী ফরিদপুর চিনিকল উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র বিজয় সরকার বলে, ‘দেবাশীষ ও তার সহযোগীরা পালিয়ে যাওয়ার সময় কাকার (চাঁপা রানীর স্বামী) উদ্দেশে বলছিল, তোর বউকে মেরেছি।
তোকেও হত্যা করব। ’
সরেজমিন: চাঁপা রানীর বাড়ি থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে ফরিদপুর চিনিকল উচ্চবিদ্যালয়। চাঁপার দুই মেয়ে এই স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, ‘ওরা আগামী মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাবে বলে আশা করি। ’
মেয়েদের সহপাঠী জানায়, স্কুলে ও কোচিংয়ে যাতায়াতের পথে দেবাশীষ প্রতিদিনই তাদের (বোনদের) একজনকে উত্ত্যক্ত করত।
সামনে মোটরসাইকেল থামিয়ে কথা বলতে চাইত। স্কুলের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকেরা এটা জানেন।
দুই মেয়ের একজন বলে, ‘কিছুদিন আগে আমি স্কুল থেকে আসার পথে দেবাশীষ আমার হাত টেনে ধরে। আমি বিষয়টি মাকে জানাই। পরে মা স্কুলের প্রধান শিক্ষককে জানান।
’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে দুই বোন জানায়, মা-ই তাদের সবকিছু দেখাশোনা করতেন। এখন তাদের কে দেখবে। তারা চায় হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।
চাঁপার স্বামী স্বপন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘আমি ঘাতকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। যাতে আর কেউ কোনো দিন কোনো মেয়েকে উত্ত্যক্ত করতে না পারে।
’
ক্ষোভে উত্তাল মধুখালী: বখাটেদের হাতে একজন মায়ের মৃত্যুর খবরে গতকাল ক্ষোভে ফেটে পড়ে মধুখালীর সর্বস্তরের মানুষ। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে ‘মধুখালীর জনতা গড়ে তোলো একতা, ইভ টিজারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও এক সাথে’ স্লোগান দিয়ে চিনিকল শ্রমিক, ফরিদপুর চিনিকল উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাসহ স্থানীয় লোকজন মিলগেটে জড়ো হয়। তারা বখাটে দেবাশীষকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ করে। সেখানে প্রতিবাদ সভায় চিনিকল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হামিদুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক জহুরুল হক, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ মধুখালী শাখার সভাপতি সুরাইয়া সালাম, শ্রমিকনেতা আবুল বাশার, মজিবুর রহমান প্রমুখ বক্তব্য দেন। সমাবেশ শেষে জনতা মধুখালী থানার সামনে মানববন্ধন করে।
মানববন্ধন শেষে ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে বসে পড়ে এবং মহাসড়কের একাধিক জায়গায় টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করে। এখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ী বক্তব্য দেন। ঘটনাস্থলে পুলিশ থাকলেও তারা বিক্ষোভকারীদের বাধা দেয়নি। আধা ঘণ্টা পর অবরোধকারীরা স্বেচ্ছায় অবরোধ তুলে মিছিল করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে যায়। সেখানে ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ মধুখালী শাখার সভাপতি সুরাইয়া সালাম ও সাধারণ সম্পাদক শাহীদা আকরাম স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপি তুলে দেওয়া হয়।
এরপর চিনিকল শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা চাঁপা রানীর হত্যার প্রতিবাদে তিন দিনব্যাপী শোক কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
সরেজমিন বখাটের বাড়ি: গতকাল দুপুর একটার দিকে মধুখালী বাজার এলাকায় দেবাশীষের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি তার বাবা রতন সাহাকেও। রতন সাহার দ্বিতীয় স্ত্রী প্রমিতা রানী সাহা জানান, ‘দুর্ঘটনার পর দেবাশীষ বাড়িতে আসেনি। ওর বাবা গত মঙ্গলবার রাত থেকে বাড়িতে নেই।
’ তিনি জানান, চার বছর আগে দেবাশীষের মা মারা যাওয়ার পর রতন সাহা তাঁকে বিয়ে করেন। দেবাশীষ ২০০৭ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফেল করে আর পড়াশোনা করেনি। সে বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করে এবং বাবার মোটরসাইকেল চালিয়ে বেড়ায়। তিনি এ উত্ত্যক্তের বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘তবে কিছুদিন আগে দেবাশীষ আরেক মেয়েকে অপহরণ করেছিল বলে শুনেছি।
’
প্রশাসন: পুলিশ সুপার মো. আওলাদ আলী ফকির বলেন, ‘উত্ত্যক্তের বিষয়টি আমাকে আগে জানানো হয়নি বা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়নি। তবে ওই পরিবার বিষয়টি মধুখালী উপজেলা চেয়ারম্যানকে জানিয়েছিল বলে জানতে পেরেছি। আমরা এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। দুর্ঘটনার মামলা না নিয়ে হত্যা মামলা নেওয়া হয়েছে। আসামিকে অচিরেই গ্রেপ্তার করা হবে।
’
জেলা প্রশাসক হেলালুদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার ও শাস্তির ব্যবস্থা করতে প্রশাসন সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।