আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অস্ত্র নিয়ে গার্লস স্কুলে ঢুকে পড়ে বখাটেরা:



ইভটিজিং নাজনীন আখতার ॥ "জাতীয় পর্যায়ের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবে আমাদের স্কুল। অনুশীলনের জন্য মেয়েদের নিয়ে স্টেডিয়ামে যাচ্ছিলাম সেদিন। আমি সামনে, মেয়েরা পেছনে। হঠাৎ পেছন দিক থেকে একটি মেয়ের চিৎকার শুনে থমকে দাঁড়ালাম। হতভম্ব হয়ে দেখলাম আমাদেরই একটি মেয়ের গা রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

একটি ছেলে অতর্কিতে এসে মেয়েটির পিঠে ক্ষুর দিয়ে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিয়েছে। হাসপাতালে মেয়েটিকে নেয়ার পর তার পিঠে ৩২টি সেলাই দেয়া হয়। "_ খিলগাঁও গার্লস স্কুল এ্যান্ড কলেজের শিক্ষক গুলশানআরা বেগম তাঁর এক ছাত্রীর হামলার শিকার হওয়ার ঘটনা বর্ণনা করছিলেন এভাবে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ইভটিজিংয়ের শিকার হওয়ার নানা ঘটনা দেখলেই আমার ওই ছাত্রীর কথা মনে হয়। ভাবলেই গা শিউরে ওঠে।

সামাজিক মর্যাদার কথা চিন্তা করে তিনি ছাত্রীর নাম প্রকাশ না করে বলেন, পরে জানতে পেরেছিলাম ওই ছেলেটিকে চেনে মেয়েটি। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে ছেলেটি তাকে বিরক্ত করত। প্রেমের প্রস্তাব দিত। কিন্তু মেয়েটির দিক থেকে কোন সাড়া না পেয়ে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে সে ওই ঘটনা ঘটায়। ঘটনায় আতঙ্কিত মেয়েটির পরিবার দীর্ঘদিন তাকে আর স্কুলে পাঠায়নি।

শিৰক গুলশানআরা বেগম দুঃখ করে বলেন, মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এ ঘটনাগুলো বেশি প্রত্যৰ করতে হয়। দেখা যায়, মেয়েদের শিৰা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে বখাটেদের ভিড় থাকে বেশি। মাঝে মাঝে কিছু কম বয়সী ছেলে অস্ত্র নিয়ে টুকে পড়ে দাবি করতে থাকে, 'অমুকের সঙ্গে প্রেম। তমুককে বিয়ে করতে চাই। ' সংশ্লিষ্টদের মতে, নারীর প্রতি যত ধরনের নির্যাতন প্রচলিত আছে, সৌভাগ্যক্রমে সব নারীই সে সব নির্যাতনের শিকার হন না।

তবে ইভটিজ বা উত্ত্যক্ততা থেকে রেহাই পেয়েছে এমন নারীর সংখ্যা শূন্যের কোঠায়। প্রত্যেক নারী তার জীবনের কোন না কোন সময়ে কৈশোরের আহ্লাদিত সময়, তারম্নণ্যের চপলতা, যৌবন্যের ধীরস্থিরতা বা মধ্যবয়সের ভাবগাম্ভীর্যের সময়েও এ নির্যাতনের শিকার হন। বর্তমানে এটি মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটের মতো আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত হয়েছে কেউ এ থেকে নিসত্দার পাচ্ছেন না। এটা এক ধরনের অবর্ণনীয় নির্যাতন। সাম্প্রতিককালে নানান আকার-প্রকারে বাড়ছে ইভটিজিংয়ের ঘটনা।

বাড়ছে বখাটেদের মাত্রা ছাড়ানো অসহনীয় উৎপাতে আত্মহননের পথ বেছে নেয়া কিশোরী-তরম্নণীদের সংখ্যাও। গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে দ্বিগুণসংখ্যক মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। গত সাড়ে চার বছরে আত্মহত্যা করেছে ৪০ কিশোরী-তরুণী। গত পাঁচ মাসে ১৪ মেয়ের আত্মহত্যা ॥ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে ইভটিজিং বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালে ৭ মেয়ে বখাটেদের উৎপাতে আত্মহত্যা করে। আর চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম পাঁচ মাসে আত্মহননকারীদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ জনে।

এছাড়া ২০০৬ সালে ৫ জন, ২০০৭ সালে ৫ জন এবং ২০০৮ সালে ৯ মেয়ে আত্মহত্যা করে। ওই সময়গুলোতে জাতীয় দৈনিকগুলোতে শুধু আত্মহত্যা নয়, ইভটিজিংয়ের শিকার হওয়ার ভয়াবহ কিছু ঘটনাও তুলে ধরা হয়। ২০০৬ সালে ঘটনার শিকার ২৪টি মেয়ের কাহিনী উঠে আসে পত্রিকায়। ২০০৭ সালে ২০, ২০০৮ সালে ৩৯, ২০০৯ সালে ৫৪ এবং ২০১০ সালের মে মাস পর্যনত্দ ৫২ মেয়ের ইভটিজিংয়ের শিকার হওয়ার ঘটনা প্রকাশিত হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের অপর একটি প্রতিবেদনে ইভটিজিংকে সাম্প্রতিককালের এক উদ্বেগজনক প্রবণতা আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে, উৎপাত শুধু মেয়েটির ৰেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকছে না।

আক্রান্ত হচ্ছেন বাবা-মা, পরিবার-পরিজনও। চলতি বছর মেয়ের ওপর বখাটেপনা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন এক বাবা। বখাটেদের উৎপাতের প্রতিবাদ করায় খুন হয়েছেন ৩ জন। এছাড়া বখাটেদের উৎপাতে পরীৰা স্থগিত হয়েছে। এ ধরনের ঘটনার শিকার ছাত্রীরা অতিষ্ঠ হয়ে গণআত্মহত্যার ঘোষণা দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে চলতি বছরের গত পাঁচ মাসে।

ইভটিজিং কেন ঘটছে ॥ বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির গবেষণা প্রতিবেদনে ইভটিজিংয়ের মতো জঘন্য অপরাধের পেছনে আটটি কারণকে চিহ্নিত করা হয়েছে। পারিবারিক ও সামাজিক রীতিনীতি, বেকারত্ব ও হতাশাব্যঞ্জক জীবন, মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি ও সুস্থ বিনোদনের অভাব, রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক অবহেলা, আর্থ-সামাজিক কাঠামো, চলমান অবস্থা থেকে শেখা এবং একে অপরের প্রতি মর্যাদা ও শ্রদ্ধাবোধের অভাব থেকেই ঘটনাগুলো ঘটছে বলে উলেস্নখ করা হয়েছে। ইভটিজিংয়ের ধরনগুলোর মধ্যে রয়েছে অশ্রীল গান বাজানো ও গাওয়া, অশস্নীল বা উদ্দেশ্যমূলক কথা বলা, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, পিছু নেয়া, প্রেম নিবেদন বা বিয়ের প্রসত্দাব দেয়া, চিঠিপত্র দেয়া, পথরোধ করে দাঁড়ানো, প্রসত্দাবে সাড়া না দিলে হুমকি দেয়া ইত্যাদি। সংশ্লিষ্টদের মতে, ইভটিজিংয়ের ক্ষেত্রে এ আটটি কারণ প্রায় একই সঙ্গে ঘটে থাকে। যে কোন ব্যক্তির আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ওপর তার আচরণ নির্ভর করে।

সুস্থ সামাজিকীকরণ না হওয়ায় উঠতি বয়সের ছেলেরা মেয়েদের প্রতি অশালীন অঙ্গভঙ্গি, স্পর্শ, কটূক্তি করাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়। বাংলাদেশে ছেলেদের সুস্থ বিনোদনের অভাব আর অন্যদিকে মুক্ত আকাশ-সংস্কৃতির সহজলভ্যতার কারণে ছেলেরা না বুঝেশুনেই নানান ধরনের অপরাধ সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে উঠছে। তারা প্রেম বিষয়টিকে সস্তা মনে করে। নিজেদের একতরফা ভাললাগাকেই চূড়ানত্দ বলে বিবেচনা করে এবং অশালীনভাবে প্রেমের প্রসত্দাব দিয়ে থাকে। সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়, আত্মনির্ভরশীল হতে পারে না এবং হীনম্মন্যতায় ভোগে এমন হতাশা থেকে যুবকরাও ইভটিজিং করে থাকে।

এ প্রসঙ্গে সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী জনকণ্ঠকে বলেন, মেয়েদের পারিবারিক ও সামাজিকভাবে শেখানো হয়, যেন তারা অত্যন্ত সচেতনভাবে রাস্তায় চলাচল করে। রাস্তায় কেউ কিছু বললে তার প্রতিবাদ করা চলবে না। সে ধরনের কোন ঘটনা ঘটলে মেয়েটিকেই দায়ী করা হয়। ফলে বখাটেরা আরও সাহস পায় এবং মেয়েরা উত্ত্যক্তার মধ্য দিয়েই জীবনযাপন করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, ইভটিজিংয়ের পেছনের কারণগুলো একে অপরের সঙ্গে জড়িত।

বেকারত্ব অন্যতম কারণ হলেও দেখা যায় কর্মৰেত্রে নারীরা উত্ত্যক্তার শিকার হচ্ছেন। প্রশাসনে থাকা ব্যক্তিরাও নারী সহকর্মীকে উত্ত্যক্ত করেন। স্থানীয় প্রশাসন থেকে ইভটিজিংকে তেমন অপরাধ হিসেবে দেখাও হয় না। ইভটিজিংয়ের পেছনে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাকে দায়ী করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে ইভটিজিং এভাবে বেড়ে যেতে পারে না। নানান ঘটনায় দেখা যায়, বখাটেরা কোন একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থেকে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে।

এ ধরনের কাজে বাধা দেয়া বা শাস্তির ব্যবস্থা না নিলে ইভটিজিং নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। সমাজে নারীরা সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারবেন না। এটা প্রতিরোধে মানবাধিকার ও মর্যাদার বিষয়টিতে মনোযোগী হতে হবে। সাম্প্রতিককালে ইভটিজিং বেড়েছে স্বীকার করে পুলিশের মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ একে অপরের প্রতি মর্যাদা ও শ্রদ্ধাবোধ কমে যাওয়াকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অনেকাংশে কমে যাওয়ায় উত্ত্যক্ততার মতো ঘটনাগুলো বাড়ছে।

এক সময় প্রতিবেশী বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে এলাকার ছেলেরা সম্মান করত, ভয় পেত। এ ধরনের শ্র্দ্ধাবোধের কারণে স্থানীয়ভাবেই সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব হতো। এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শ্রদ্ধাবোধের ক্ষেত্রগুলোতে পরিবর্তন এসেছে। এখন যে যার মতো চলে। বখাটে ছেলেরা কাউকে তোয়াক্কা করে না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.