Not for sale
পর্ব-২: জীবকূলে শক্তির প্রবাহ
গত পর্বে আমরা দেখিয়েছিলাম কিভাবে শক্তি একরূপ থেকে আরেকরূপে পরিবর্তিত হয়। এর ধারাবাহিকতায় আজ আমরা দেখব উদ্ভিদ ও প্রানীদেহের শক্তির উৎস ও রূপান্তর প্রক্রিয়া।
আমরা এখন যেমন পৃথিবী দেখছি একটা সময় এমন ছিল না। কয়েক কোটি বছর আগে পৃথিবী অনেক উত্তপ্ত ছিল। সে সময় বায়ুমন্ডলের উপাদানসমূহ ছিল এখনকার তুলনায় ভিন্ন।
তখন বাতাসে অক্সিজেন ছিল না, ছিল কার্বন ডাইঅক্সাইড, জলীয়বাষ্প, মিথেন, অ্যামোনিয়া প্রভৃতি গ্যাস। এই অবস্থায় প্রথম জৈবিক অনু অ্যামাইনো এসিডের সৃষ্টি হয় এবং পরে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় প্রথম এককোষী জীবের জন্ম হয়। এসময় প্রথম সালোক সংশ্লেষন(photosynthesis) প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বর্ণকণিকা ক্লোরোফিল সৃষ্টি হয় এবং শৈবাল জাতীয় জীবের আবির্ভাব ঘটে। প্রাণীর উদ্ভবের পূর্বে পৃথিবীতে উদ্ভিদের আবির্ভাব ধটেছে।
সবুজ উদ্ভিদে ক্লোরোফিল থাকায় এরা সালোক সংশ্লেষনে সক্ষম হয়।
ক্লোরোফিল হল সবুজ রং এর এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ। ক্লোরোফিলের উপস্থিতির কারনেই গাছের পাতা ও অন্য কিছু অংশ সবুজ দেখায়। সালোক সংশ্লেষন(photosynthesis) হল এক ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া যার ফলে আলোক শক্তি রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এটা বেশ জটিল প্রক্রিয়া। নিচের কয়েকটি ধাপে এই প্রক্রিয়াটিকে যতদূর সম্ভব সরল করে উপস্থাপন করছি।
• ১. আমরা জানি আলো শক্তির একটি রূপভেদ। গাছের সবুজ অংশে আলো পড়লে তা কার্বন ডাইঅক্সাইড ও পানির অনুকে একত্রে যুক্ত করে গ্লুকোজে পরিনত করে। এই প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন নির্গত হয়।
কার্বন ডাইঅক্সাইড + পানি = গ্লুকোজ + অক্সিজেন
• গ্লুকোজ সম্বন্ধে আমরা সবাই জানি যে এটি মিষ্টি জাতীয় বস্তু এবং আমাদের জন্য শক্তির উত্স। অর্থাৎ এ পর্যায়ে এসে আমরা বুঝতে পারছি সূর্যের আলোক শক্তি গাছের সবুজ অংশের উপস্থিতিতে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও পানির সহায়তায় গ্লুকোজের মাধ্যমে রাসায়নিক শক্তি হিসেবে উদ্ভিদের দেহে জমা হয়।
জীব সৃষ্টির প্রথম দিকে শৈবাল জাতীয় উদ্ভিদেই এই ঘটনা ঘটনা ঘটত, পরবর্তীতে বিবর্তনের ধারায় উচ্চতর উদ্ভিদের জন্ম হয় এবং এই ধারা অব্যাহত থাকে।
• উত্পন্ন গ্লুকোজ পাতায় উত্পন্ন হওয়ার পর উদ্ভিদের বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে যায় এবং বিশেষ বিশেষ অঙ্গে সঞ্চিত হয় (ফল, মূল, কান্ড প্রভৃতি)। গ্লুকোজ সঞ্চিত হওয়ার কারনেই ফল খেতে মিষ্টি লাগে।
• গ্লুকোজের একাধিক অণু একত্রে যুক্ত হয়ে অন্যান্য উচ্চ শক্তি সম্পন্ন শর্করায় পরিণত হয়। যেমন: দুটি গ্লুকোজ অণু মিলে চিনিতে পরিণত হয় (আখের কান্ডে সঞ্চিত থাকে), অনেকগুলো গ্লুকোজ অণু মিলে শ্বেতসার তৈরি হয় (আলু, চাল, গম) কিংবা সেলুলোজ তৈরি করে (কাঠ, তুলা, পাতার মূল উপাদান) ইত্যাদি।
উপরের ধাপগুলোতে দেখা যাচ্ছেসূর্যের আলোই রাসায়নিক শক্তি রূপে উদ্ভিদের দেহের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন উপাদানের মাধ্যমে সঞ্চিত হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় বাতাসে প্রচুর অক্সিজেন নির্গত হয়। শুরুতে প্রাণীর আবির্ভাব ঘটেনি বলে নির্গত অক্সিজেন বায়ুমন্ডলে জমা হতে থাকে। আর উদ্ভিদ দেহে সঞ্চিত শক্তির একটি অংশ অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে শক্তি উত্পাদন করে যা উদ্ভিদের বিভিন্ন শরীরবৃত্তীয় কাজে ব্যবহ্রত হয়। তবে এতদ সত্বেও উদ্ভিদ দেহে বিপুল পরিমান শর্করা এবং বাতাসে পর্যাপ্ত অক্সিজেন জমা হয।
উদ্ভিদ মারা গেলে ব্যাক্টেরিয়া ও ছত্রাক উদ্ভিদের সঞ্চিত শক্তি গ্রহণ করে এবং অবশিষ্ঠ অংশ দীর্ঘ সময়ের আবর্তনে কয়লায় পরিণত হয়। বর্তমান বিশ্বে কয়লা শক্তির একটি উল্লেখযোগ্য উত্স সেটা আমরা সকলেই জানি।
এভাবেই চলল কয়েক কোটি বছর। উদ্ভিদের সঞ্চিত শক্তির সদ্ব্যবহার করার জন্য পৃথিবীতে কেবল ব্যক্টেরিয়া ও ছত্রাকই ছিল যারা সালোক সংশ্লেষন করত না। ক্রমেই পৃথিবীতে প্রাণীর আবির্ভাব হল বিবর্তন প্রক্রিয়ায় এবং শক্তির প্রাপ্যতা ও অক্সিজেনের উপস্থিতির নিশ্চয়তা থাকায় প্রাণীর বিবর্তন উত্সাহিত হল এবং ঝাঁকে ঝাঁকে নতুন নতুন প্রাণীর আবির্ভাব হতে লাগল।
উদ্ভিদের সঞ্চিত শক্তি প্রানী খাদ্য হিসেবে গ্রহন করে এবং তা অক্সিজেনের সাহায্যে ভেঙ্গে পুনরায় কার্বন ডাইঅক্সাইড ও পানিতে পরিণত হয় এবং প্রচুর শক্তি উত্পন্ন হয়। উত্পন্ন শক্তি দ্বারা প্রানীর যাবতীয় শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম চালিত হয় এবং অতিরিক্ত শক্তি উদ্ভিদের মতই একইভাবে দেহে সঞ্চিত থাকে। প্রকৃতপক্ষে জীবের সম্পূর্ণ দেহই সঞ্চিত শক্তির এক আধার। ফলে এসব প্রাণীকে খাদ্য হিসেবে গ্রহন করার জন্যও আরো প্রানীর আবির্ভাব ঘটে এবং নতুন নতুন খাদ্য চেইন সৃষ্টি হয়। যেসব প্রানী অন্য কারো খাদ্য হয় না এবং স্বাভাবিক ভাবে মৃত্যুবরন করে তাদের দেহ পরবর্তীতে ব্যক্টেরিয়া ও ছত্রাক দ্বারা বিশ্লেষিত হয় এবং তাদের অন্তর্নিহীত শক্তি পরিবেশে বিমুক্ত হয় কিংবা মাটির নীচেই বিভিন্ন উপাদান হিসেবে চাপা পড়ে থাকে।
এখন দেখা যাক মানুষের দেহে এই শক্তির গতিময়তা কিভাবে কাজ করছে। মানুষ উদ্ভিদ বা প্রানীকে খাদ্য হিসেবে ভক্ষন করে থাকে। মানুষ উদ্ভিদের ফল-মূল বা পাতা খেয়ে থাকে। এধরনের খাদ্যে প্রচুর গ্লুকোজ, চিনি, শ্বেতসার, চর্বি, সেলুলোজ প্রভৃতি সঞ্চিত থাকে। মানবদেহের অভ্যন্তরে চিনি ও শ্বেতসার গ্লুকোজে পরিণত হয় এবং গ্লুকোজ ও চর্বি অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও পানি উত্পন্ন করে যা নিঃশ্বাসের সাথে বের হয়ে যায়।
এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর শক্তি উত্পন্ন হয় যাতে মানবদেহের যাবতীয় কার্যক্রম চলে। আর উদ্ভিদের সঞ্চিত খাদ্যের এক বিরাট অংশ সেলুলোজ হলেও তা মানুষ হজম করতে পারে না কিন্তু গরু, ছাগল সহ অন্যন্য তৃণভোজী প্রাণী ঘাস হজম করতে পারে।
আলোচনা থেকে যেটুকু বোঝা গেল কিংবা অন্তত আমি যা বোঝানোর চেষ্টা করলাম তা হল উদ্ভিদ ও প্রানীর যাবতীয় শক্তির প্রকৃত উৎস হল সূর্য। সূর্যের আলোক শক্তিই নানাবিধি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে গিয়ে উদ্ভিদ ও প্রানীর যাবতীয় শক্তির প্রয়োজন মিটিয়ে আসছে। আগামী পর্বে আমরা দেখব শুধু জীবকূলে নয় বরং পৃথিবীর অধিকাংশ প্রাকৃতিক ক্রিয়াকান্ডের মূলে রয়েছে সূর্যশক্তি।
আজকের মত বিদায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।