আকাশজুড়ে নীল মেঘের ছড়াছড়ি। প্রকৃতিতে মিষ্টি রোদের ঝিলিক। সবুজ পাতায় উপর খেলা করে সকালের সোনারোদ। নরম সকালে দূর্বাঘাসের ডগায় ফুটে ছোট ছোট শিশিরবিন্দু। দিগন্ত প্রসারিত মাঠে হলুদ ধানের জড়াজড়ি।
কবি জসিমউদ্দীন লিখেছেন-
‘সবুজ হলুদে সোহাগ ঢুলায়ে ধান ক্ষেত,
পথের কিনারে পাতা দোলাইয়া করে সাদা সঙ্কেত।
ছড়ায় ছড়ায় জড়াজড়ি করি বাতাসে ঢলিয়া পড়ে,
ঝাঁকে আর ঝাঁকে টিয়া পাখিগুলি শুয়েছে মাঠের পরে।
কৃষাণ কনের বিয়ে হবে হবে তার হলদি কোটার শাড়ি,
হলুদে ছোপায় হেমন্ত রোজ কচি রোদ রেখা-নাড়ি। ’
ঝিমিয়ে থাকা লাউ গাছটা লকলকিয়ে বাড়তে থাকে। শিমগাছে সাদার ভেতর বেগুনি রঙের ফুল ফোটে।
পাকা ধানের গন্ধে মৌ মৌ করে উত্তরের বাতাস। কানা বক মাছ ধরতে আসে নদীর তীরে। মাছরাঙা বসে থাকে পুকুরের গাছের ডালে। কাশফুল শরতের নিজস্ব ফুল হলেও হেমন্তে উঁচু টিলায় সাদা সাদা কাশফুল ফুটতে দেখা যায়। খালে-বিলে, হাওড়-বিলে, পুকুরে শাপলা ফুটে।
গ্রাম্য কিশোর-কিশোরীরা দলবেঁধে ফুল তুলতে আসে। শরতে ফোটা শেফালি, স্থলপদ্ম হেমন্তেও রূপের বাহার দেখায়। বাতাসে ফুলের সৌরভ ছড়ায়। বাগানে ফুটে নয়নাভিরাম ছাতিম ফুল। ছাতিম ফুল নিয়ে চমৎকার কবিতা লিখেছেন কবি গোলাম মোহাম্মদ।
‘ছাতিম ফুলের গন্ধে ভাসে পথ
উঠোন ভরে ভরলো ঘরের কোণ
জোছনা মেখে হচ্ছে আরো মিহি
সেই সোহাগে উঠলো ভরে মন।
....
গন্ধে কাঁপে ছাতিম ফুলের রাত
হাতের ভেতর মধুমতির হাত। ’
গাছের ডালে বসে পাখি গান ধরে। নতুন বৌ নাইয়র যায় বাপের বাড়ি। এসব হেমন্তেরই নিদর্শন।
হেমন্ত বাংলার নিজস্ব ঋতু হলেও এটি কখন আসে কখন যায় তা আমরা অনেকেই জানিনা। এটি শরৎ থেকে খুব একটা পৃথক নয়; শীত থেকে আবার খুব একটা দূরেও নয়। হেমন্তের রঙ ধূসর। বর্ষার মতো রুক্ষ নয় তার রূপ। তবে শীতের মতো শান্তও নয়।
উদাসীন পথিকের মতো হেমন্তের হাঁটাচলা। আবার হেমন্ত একগুচ্ছ প্রিয় ঝারাপাতার বাহারও বটে। তাইতো হেমন্তের রূপে মুগ্ধ হয়ে কবিগুরু লিখেছেন-
‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে
জনশূণ্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে
শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার
রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার। ’
অন্যান্য ঋতুর তুলনায় হেমন্তে খুব সামান্যই ফুল ফোটে। অনিন্দ্যসুন্দর হিমঝুরি, দেবকাঞ্চন, রাজ অশোক হেমন্তের প্রকৃতিকে মাতিয়ে রাখে।
হেমন্তের সকালে শিশিরভেজা ঘাসের ডগাকে মনে হয় মুক্তোর মালা। বাংলা সাহিত্যের একটা অংশ জুড়ে আছে শিশিরের নরম স্পর্শের বর্ণনা। কখন কোথা থেকে শিশির এসে ঘাসের ডগায় গাছের পাতায় মুক্তোর মালা পরিয়ে দিয়ে যায় তা কেউ জানেনা। আর সূর্যদয়ের সাথে সাথেই প্রকৃতিকে কাঁদিয়ে কোন সুদূরে মিলিয়ে যায় তাও মানুষের দৃষ্টির বাইরে। এ এক অবাক করার বিষয় রহস্যময়ও বটে।
হেমন্তের সকালে শিশিরভেজা সকাল, দুপুরের রোদের ¯িœগ্ধতা, সন্ধ্যায় বাঁশ ঝাড়ের শিরশির ধ্বনি প্রকৃতিতে ভিন্ন এক দ্যোতনা সৃষ্টি করে।
হেমন্তের মেঘমুক্ত আকাশে রাতের জোছনার আলো অন্য সময়ের তুলনায় একটু বেশিই পরিলক্ষিত হয়। এ সময় রাতের পথে, ঘাটে, বনে, বাদাড়ে জোছনার আলো ঠিকরে পড়ে। এ সময় চাঁদের শরীর থেকে মোমের মত গলে পড়ে জোছনার আলো। হেমন্ত আসে ধীর পদক্ষেপে।
শীতের পরশ গায়ে মেখে। তাইতো হেমন্তের রাতে শীত শীত অনুভব হয়।
হেমন্ত ঋতুর দু’টি মাস কার্তিক ও অগ্রহায়ণ। ‘কৃত্তিকা’ ও ‘আদ্রা’ তারার নামানুসারে নাম রাখা হয়েছে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস। নদীমাতৃক এ দেশের প্রধান ফসল ধান।
এক সময় বাংলা বছরের গণনা শুরু হতো হেমন্ত মাস দিয়ে। কারণ, ধান কাটার মওসুম এ হেমন্ত। বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমন-আউশ ধান বেড়ে উঠে শরতে। হেমন্তের প্রথম দিকে পাক ধরে। কার্তিকের শেষ দিকে গ্রামের মাঠে কৃষকেরা দলবেঁধে ধান কাটে।
মনে সুখে গলা ছেগে গান গায়।
‘কচ্-কচা-কচ্, কচ্-কচা-কচ্ ধান কাটি রে
(ও ভাই) ঝিঙ্গা শাইলের হুডুম ভালা
বাঁশ ফুলেরি ভাত
লাহি ধানের খই রে
দইয়ে তেলেস্মাত। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।