কয়েক দিন আগে জেলা পর্যায়ের এক সরকারদলীয় নেতার সঙ্গে দেখা। শুভেচ্ছা বিনিময় শেষেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কাকা, নির্বাচন কি হবে? উত্তরে প্রথমেই পাল্টা প্রশ্ন করলাম- এ প্রশ্ন তুমি আমাকে করলে? তোমার কাছেই তো বরং প্রশ্নটি আমার রাখার কথা। বিষয়টি কি উল্টা হলো না?
সেই নেতাটি তখন বললেন, না কাকা, আমার কিছুই জানা নেই উপরতলার ব্যাপার সম্পর্কে। আর উপরতলা থেকে প্রতিনিয়ত যা বলা হচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষের মতো আমিও শঙ্কিত। আপনি সম্ভবত অনেক বেশি জানেন, তাই আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি।
বললাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানা হবে না, তোমাদের দলের নেতারা এমন জিদ ধরেছেন। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়েই তো তোমাদের দল দুইবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হলো। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এবার ক্ষমতায়। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান সংশোধন করে উঠিয়ে দেওয়া হলো কেন? তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে প্রধান বিরোধী দল ও তাদের সঙ্গী-সাথীরা বার বার হরতাল ডেকে জনজীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করার সুযোগ পাচ্ছে। দাবি না মানলে তারা আরও কঠিন আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে।
সরকারি দলের নেতাটি শেষ অবদি বললেন, কাকা, যে যাই বলুক এ দেশে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যেমন ধরনের সম্পর্ক তাতে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। এই বলে তিনি বিদায় নিলেন। অর্থাৎ যে কথাগুলো বলার পটভূমি আমি রচনা করেছিলাম তিনি এক কথায় সেই কথাটিই বলে ফেললেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এবার যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে তবে ১০ বছরের মধ্যেও তারা নির্বাচন দেবে না। এমন আশঙ্কা যদি সত্যি থাকে তবে সে বিপদ ঠেকাতে সর্বসম্মতভাবে সরকারের তরফ থেকেই উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
তবে এখন যুক্তিতর্ক এবং তথ্যাদি দিয়ে সবাইকে বুঝাতে হবে যে, তাদের এই আশঙ্কা আদৌ অমূলক নয়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের স্থলে দুই বছর ক্ষমতায় ছিল শুধু এই দৃষ্টান্ত দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী যদি এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে থাকেন তবে তার ওই মত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। কারণ সবকিছুর নিয়ামক যে জনগণ সেই জনগণ কোনো অসাংবিধানিক বা অগণতান্ত্রিক সরকার কোনো দিন মেনে নেয়নি, এবারও মেনে নেবে না। কেউ ১০ বছর ক্ষমতায় থাকবে এমন দাবি করতেও সাহস পাবে না।
বস্তুত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যেতে সরকার দুটি কারণ দেখিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে।
তার প্রথমটি হলো- সংবিধানে ওই ব্যবস্থার অস্তিত্ব নেই এবং সেটি সুপ্রিমকোর্টের রায়ের কারণে।
দ্বিতীয়ত তারা বলছেন, পৃথিবীর কোনো সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত নেই, বরং নির্বাচনের প্রাক্কালে যে দলীয় বা জোট সরকার ক্ষমতায় থাকুক, তার পরিচালনাধীনেই সেসব দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
এই উভয় যুক্তি নিয়ে নিরাসক্ত চিত্তে আলোচনা করা যাক। প্রথম যুক্তি হিসেবে যা বলা হয়েছে- সেটি হলো সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান নেই। কারণ সুপ্রিমকোর্ট প্রদত্ত এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক এবং অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।
এই কথাটি অবশ্য সরকার ঠিকই বলে; কিন্তু ওই রায়েরই অপর অংশে একই আদালত বলেছিলেন- তবে প্রয়োজনবোধে আরও দুই টার্ম এই ব্যবস্থা বজায় রাখা যেতে পারে। অর্থাৎ খোলামেলা না বললেও আদালত যা বুঝাতে চেয়েছেন তা হলো- সংঘাতময় বাস্তবতাকে এড়াতে হলে যদি প্রয়োজন দেখা দেয় তবে আগামী দুই টার্মের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বজায় রাখা যেতে পারে। তবে ওই সরকারে বিচার বিভাগ থেকে কাউকে নেওয়া যাবে না।
বাস্তবে আমরা কি দেখি? দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের মধ্যে সামান্যতম সমঝোতা, সহনশীলতা বা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের লেশমাত্র নেই। কারও সঙ্গে কারও মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত নেই।
নববর্ষে, দুটি ঈদে বা কারও বিয়েশাদিতে পর্যন্ত নিমন্ত্রণপত্র দেওয়া হয়নি। লোক দেখানোভাবে থাকলেও কেউ কারও বাড়িতে বা আয়োজনের স্থানে গিয়ে তাতে অংশগ্রহণ করেন না। হঠাৎ কোনো অনুষ্ঠানে দেখা হলেও কেউ কাউকে কুশলাদি বিনিময়ও করেন না। এহেন পরিস্থিতি উপলব্ধি করেই পরবর্তী দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন করা যেতে পারে বলে আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন। অথচ আদালতের রায়ের ওই অংশটুকু সম্পর্কে সরকার সর্বদাই অর্থপূর্ণ নীরবতা পালন করে আসছে।
দ্বিতীয় যে যুক্তি দেখানো হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে তা হলো- সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা যেসব দেশে প্রচলিত আছে সেসব দেশে রাজনৈতিক সরকারের অধীনেই সংসদ নির্বাচন হয়ে থাকে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নয়। এ যুক্তির মধ্যে আদৌ কোনো অসত্য নেই; কিন্তু ওই দেশগুলোতে সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যকার সম্পর্কও অত্যন্ত মর্যাদাকর, পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বিভিন্ন জাতীয় সমস্যা সমাধানে তারা পরস্পর বৈঠকে বসে আলাপ-আলোচনা করে তার সমাধান সূত্রও বের করে আনেন। সেখানে লাগাতার হরতাল বা সংসদ বর্জনের কথা কদাপি কেউ মুখেও আনেন না। নির্বাচনী কারচুপির অভিযোগও কেউ কারও বিরুদ্ধে করেন না।
তেমন একটা অনুকূল রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিদ্যমান থাকলে অবশ্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো যৌক্তিকতা থাকত না।
আসলে এ দাবিটা যখন যে দল সরকারবিরোধী অবস্থানে থাকে সে দলই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার হয়, আর ক্ষমতাসীন দল সংবিধান ও নানা যুক্তি দেখিয়ে তার বিরোধিতা করে। এই দাবির উৎপত্তি ঘটে সম্ভবত ১৯৯৩ সালে বিএনপি শাসনামলে, যখন মাগুরার উপনির্বাচন এত বেশি বিতর্কিত হয়ে পড়ে যে, ওই নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান এবং নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে আওয়ামী লীগ জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলে। তারই একপর্যায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সংসদ বর্জন ও হরতাল প্রভৃতি আন্দোলনের মাধ্যম হিসেবে আওয়ামী লীগ গড়ে তোলে। সে আন্দোলনের দাবি-দাওয়া না মেনে বিএনপি চেয়ারপারসন তখন বলেছিলেন, এদেশে নিরপেক্ষ বলে কেউ নেই।
শুধু শিশু আর পাগলরা এদেশে নিরপেক্ষ। তাই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। আজ সেই বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অটল এবং আপসহীন এবং তেমনি আবার আওয়ামী লীগকেও দেখা যাচ্ছে ওই দাবি না মানার পক্ষে আপসহীন। এহেন পরিস্থিতিতে দেশের পরিস্থিতি কখন কেমন দাঁড়ায় তা নিয়েও গভীর অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।
অপরপক্ষে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনাল দুটি সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বিচারাধীন বেশ কয়েকটি মামলার রায় ঘোষণা করবেন বলে সবাই আশা করছে।
কাদের মোল্লার আপিলের রায় তো যে কোনো মুহূর্তে ঘোষিত হতে পারে বলে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ জানিয়েছেন। তাই সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেও কয়েক দফা হরতাল জামায়াত-শিবির ডাকবে বলে ধরে নেওয়া যায়। সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের ভোটার তালিকায় নাম না রাখা এবং জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাওয়ায় তারা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় মদদ জোগাতে পারে। তাদের অপর টার্গেট আগামী নির্বাচনে যে করেই হোক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিকে পরাজিত করা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ এবং কারারুদ্ধ তাদের সব নেতাকে কারাগার থেকে মুক্ত করাও তাদের টার্গেট।
এহেন পরিস্থিতিতে দেশের অশান্ত রাজনৈতিক ময়দানের যে ভয়াবহ আশঙ্কা তা যেমন জাতীয় সংকটকে গভীর করে তুলেছে, তেমনি আবার নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে উভয়পক্ষের অনমনীয় অবস্থান এক ভয়াবহ জটিলতারও সৃষ্টি করেছে আমাদের জাতীয় জীবনে। সংকট দৈনন্দিন জীবনযাত্রায়ও প্রকট। দ্রব্যমূল্যের অব্যাহত বৃদ্ধি, নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলাম ও তার আমিরের কট্টর অবস্থান ও হুমকি সংঘাতকে ঘনীভূত করছে। সরকারের প্রগতিশীল নারীনীতি ও শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে তাদের আপসহীন অবস্থান দেখে মনে হয়, এ জাতিকে তারা অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে চায়। জনগণের মধ্যে বিভেদ ও সংশয় সৃষ্টির সাম্প্রদায়িক বিষাক্ত পরিস্থিতির নতুন করে উন্মেষ ঘটানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে তারা।
এই অপশক্তিগুলো দমনে সরকারের প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত ভূমিকা দেশের গণতন্ত্রকামী সর্ব স্তরের মানুষকেই উৎকণ্ঠিত করে তুলেছে।
যদি নির্বাচন প্রশ্নে বিরাজমান বিরোধগুলো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান শান্তিপূর্ণভাবে না হয় তবে দেশে এই দফায় আদৌ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কিনা বা হতে দেওয়া হবে কিনা, না হলে দেশ কোন পথে অগ্রসর হবে তা ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়। প্রশ্ন জাগে, দফায় দফায় বাঙালি জাতির গণতন্ত্রের জন্য জীবনাহুতি, রক্তের স্রোতে দেশটাকে ভাসিয়ে দেওয়ার স্মৃতি তো খুব একটা বেশি দিনের নয়। সেই বেদনাদায়ক স্মৃতি তো সবাই ভুলেই গিয়েছিলেন ১৯৯০-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের তাৎপর্যপূর্ণ বিজয়ের মধ্য দিয়ে। সেই বিজয় কি তবে ছিনতাই হতে চলেছে? এ প্রশ্নও মানুষের মনকে ভাবিয়ে তুলেছে।
কিন্তু এই সমস্যাগুলো দীর্ঘদিন ধরে কোনো সমাধান না হওয়ায় জাতীয় জীবন যেভাবে সংকটাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে তেমনি আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে বলে দেশের চিন্তাশীল অর্থনীতিবিদরাও মনে করেন। কিন্তু এ থেকে পরিত্রাণের পথ কি?
পরিত্রাণের একমাত্র পথই খোলা আছে, আর তা হলো জাতীয় সংকট উত্তরণে জাতীয় সংলাপে বসা। শর্তহীনভাবে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো কালবিলম্ব না করে সংলাপে বসলে মন খুলে দেশের ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থকে বিবেচনায় রাখলে এবং ক্ষুদ্র দলীয়, গোষ্ঠী বা ব্যক্তিস্বার্থের ঊধের্্ব জাতীয় স্বার্থকে স্থান দিলে অবশ্যই সমাধান সূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। সংকটগুলোর কোনোটাই প্রকৃতির সৃষ্টি নয়, সবই মানুষের সৃষ্টি। তাই মানুষ চাইলেই সমস্যাগুলোর সমাধান করে ফেলতে পারেন।
জাতির সমবেত আকাঙ্ক্ষা দেশ, জনগণ, গণতন্ত্র ও অর্থনীতিকে বাঁচাতে অবিলম্বে জাতীয় সংলাপে বসুন। যে কোনো মূল্যে সংলাপ সফল করে তুলুন। গণতন্ত্রকে রক্ষা করুন। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে অচিরেই সমাধানও সম্ভব। লেখক : রাজনীতিক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।