সুখ চাহি নাই মহারাজ—জয়! জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ। ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা কুরুপতি! দীপ্তজ্বালা অগ্নিঢালা সুধা জয়রস, ঈর্ষাসিন্ধুমন্থনসঞ্জাত,সদ্য করিয়াছি পান—সুখী নহি তাত, অদ্য আমি জয়ী।
আপনারা যারা পড়েছেন, তাঁদের একমত হতে দ্বিধা নেই যে ছিন্নপত্র রবীন্দ্রনাথের এক অনবদ্য গদ্যসৃষ্টি। বাংলাদেশের নদীমাতৃক নিসর্গে আপ্লুত অতি অন্তরঙ্গ এক পত্রকাব্য। বিশ্বপত্রসাহিত্যের সাথে আমার তেমন কোন পরিচয় নেই।
একসময় ভার্জিনিয়া উলফ-এর Collected Letters মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়েছিলাম। সেই সাথে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে কিছু পশ্চিমা ও বাঙালী দিকপাল সাহিত্যিকের পত্রসাহিত্যও। কিন্তু সেই কবে মৃদুগম্ফু এই কিশোরের ছিন্নপত্রাবলী পাঠ এতো বছর পরেও আমাকে এক তুরীয় ভাবাবেগে আচ্ছন্ন করে। প্রমথনাশ বিশীর মতো আমাদেরও যেন বলতে ইচ্ছে করে এই পত্রগুচ্ছের তন্তুতে তন্তুতে মজ্জায় মজ্জায় পদ্মাতীরের সুখ সৌভাগ্য আনন্দচিন্তা চিত্রকবিত্ব এখনো সমানভাবে প্রবাহিত। ছিন্নপত্র কাব্যের নায়িকা পদ্মা, নায়ক কবি রবীন্দ্রনাথ!
১৮৮৯ সন থেকে ১৮৯৫ সনের মধ্যে ভ্রাতুষ্পুত্রী, মেজ ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে শ্রীমতি ইন্দিরা দেবীকে লিখিত এই পত্রগুচ্ছে কাব্যময় হয়ে উঠেছে পদ্মা ও তার চারপাশের নিসর্গ ও মানুষের কথা।
এই পত্রের সংখ্যা ২৪৪টি। অনেক সমালোচক এই পত্রগুচ্ছকে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথের পদ্মাতীরবাসের মহাকাব্য বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ছিন্নপত্রাবলী থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু চিঠির খন্ড খন্ড অংশের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি ছবিব্লগ বানাবার দুর্বল চেষ্টা করা হলো। দেখেন আপনাদের ভালো লাগে কি না।
... ঐ-যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে ওটাকে এমন ভালোবাসি- ওর এই গাছপালা নদী মাঠ কোলাহল নিস্তব্ধতা প্রভাত সন্ধ্যা সমস্তটা-সুদ্ধ দু’হাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছা করে... মনে হয় পৃথিবীর কাছ থেকে আমরা যে-সব পৃথিবীর ধন পেয়েছি এমন কি কোনো স্বর্গ থেকে পেতুম?...
...স্বর্গ আর কী দিত জানি না, কিন্তু এমন কোমলতা দুর্বলতা-ময়, এমন সকরুণ আশঙ্কা-ভরা, অপরিণত এই মানুষগুলির মতো এমন আপনার ধন কোথা থেকে দিত!...
...আমাদের এই মাটির মা, আমাদের এই আপনার পৃথিবী, এর সোনার শস্যক্ষেত্রে এর স্নেহশালিনী নদীগুলোর ধারে, এর সুখদুঃখময় ভালোবাসার লোকালয়ের মধ্যে এই সমস্ত দরিদ্র মর্ত হৃদয়ের অশ্রুর ধনগুলিকে কোলে করে এনে দিয়েছে।
...
...আমরা হতভাগারা তাদের রাখতে পারি নে, বাঁচাতে পারি নে, নানা অদৃশ্য প্রবল শক্তি এসে বুকের কাছ থেকে তাদের ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিয়ে যায়। কিন্তু বেচারা পৃথিবীর যতদূর সাধ্য তা সে করেছে... আমি এই পৃথিবীকে বড় ভালোবাসি।
...শিলাইদহের অপর পারে একটা চরের সামনে আমাদের বোট লাগানো আছে। প্রকান্ড চর- ধু ধু করছে- কোথাও শেষ দেখা যায় না- কেবল মাঝে মাঝে এক এক জায়গায় নদীর রেখা দেখা যায়- আবার অনেক সময়ে বালি’কে নদী বলে ভ্রম হয়। ... গ্রাম নেই, লোক নেই, তরু নেই, তৃণ নেই- বৈচিত্রের মধ্যে জায়গায় জায়গায় ফাটল-ধরা ভিজে কালো মাটি, জায়গায় জায়গায় শুকনো সাদা বালি।
...
...পূর্ব দিকে মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখলে দেখা যায় উপরে অনন্ত নীলিমা আর নীচে পান্ডুরতা। আকাশ শূণ্য এবং ধরণীও শূণ্য, নীচে দরিদ্র শুষ্ক কঠিন শূণ্যতা আর উপরে অশরীরী উদার শূণ্যতা। এমনতর desolation কোথায়ও দেখা যায় না। ...
...হঠাৎ পশ্চিমে মুখ ফেরাবামাত্র দেখা যায় স্রোতোহীন ছোট নদীর কোল, ও পারে উঁচু পাড়, গাছপালা, কুটির। সন্ধ্যাসূর্যালোকে আশ্চর্য স্বপ্নের মতো।
ঠিক যেন এক পারে সৃষ্টি এবং আর এক-পারে প্রলয়। ...
...কাল পনের মিনিট বাইরে বসতে না বসতে পশ্চিমে ভয়ানক মেঘ করে এল। খুব গাঢ় আলুথালু রকমের মেঘ, তারই মাঝে মাঝে চোরা আলো পড়ে রাঙা হয়ে উঠেছে। ...
...গাছগুলো হাউহাউ শব্দে একবার পূর্বে একবার পশ্চিমে লুটিয়ে লুটিয়ে পড়তে লাগল। ঝড় যেন সোঁ সোঁ করে সাপুড়ের মতো বাঁশি বাজাতে লাগল।
আর জলের ঢেউগুলো তিন লক্ষ সাপের মতো ফণা তুলে তালে তালে নৃত্য আরম্ভ করে দিলে। ...
...কালকের সে যে কী কান্ড সে আর কী বলব! বজ্রের যে শব্দ সে আর থামে না- আকাশের কোন্খানে যেন একটা আস্ত জগৎ ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। বোটের খোলা জানালার উপর মুখ রেখে প্রকৃতির সেই রুদ্রতালে আমিও বসে বসে মনটাকে দোলা দিচ্ছিলাম। সমস্ত মনের ভিতরটা- যেন ছুটি-পাওয়া স্কুলের ছেলের মতো বাইরে ঝাঁপিয়ে উঠেছিল। ...
...কোজাগর পূর্ণিমার দিন নদীর ধারে ধারে আস্তে আস্তে বেড়াচ্ছিলুম- আর মনের মধ্যে কথোপকথন চলছিল; ঠিক ‘কথোপকথন’ বলা যায় না, বোধ হয় আমি একলাই বকে যাচ্ছিলুম আর আমার সেই কাল্পনিক সঙ্গীটি অগত্যা চুপ্চাপ করে শুনে যাচ্ছিল।
...
...কিন্তু কী চমৎকার হয়েছিল, কী বলব! কতবার বলেছি, কিন্তু সম্পূর্ণ কিছুতেই বলা যায় না। নদীতে একটি রেখামাত্র ছিল না; ও-ই সেই চরের পরপারে যেখানে পদ্মার জলের শেষ প্রান্ত দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে আর এ পর্যন্ত একটি প্রশস্ত জ্যোৎস্নারেখা ঝিক্ ঝিক্ করছে। ...
...মনে হয়, যেন একটি উজাড় পৃথিবীর উপরে একটি উদাসীন চাঁদের উদয় হচ্ছে, জনশূণ্য জগতের মাঝখান দিয়ে একটি লক্ষ্যহীন নদী বহে চলেছে, মস্ত একটা পুরাতন গল্পেই পরিত্যক্ত পৃথিবীর উপরে শেষ হয়ে গেছে। আজ সেই-সব রাজা রাজকণ্যা পাত্র মিত্র স্বর্ণপুরী কিছুই নেই, কেবল সেই গল্পের ‘তেপান্তরের মাঠ’ এবং ‘সাত সমুদ্র তেরো নদী’ ম্লান জ্যোৎস্নায় ধু ধু করছে। ... আমি সেই মুমূর্ষ পৃথিবীর একটিমাত্র নাড়ীর মতো আস্তে আস্তে চলছিলুম।
...
...আমার সামনে নানারকম গ্রাম্য দৃশ্য দেখতে পাই, সেগুলো আমার দেখতে বেশ লাগে। ঠিক আমার জানলার সুমুখে, খালের ওপারে, একদল বেদে বাখারির উপর খানকতক দর্মা এবং কাপড় টাঙিয়ে দিয়ে তারই মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। গুটিতিনেক খুব ছোট ছোট ছাউনি মাত্র- তার মধ্যে মানুষের দাঁড়াবার জো নেই। ঘরের বাইরেই তাদের সমস্ত গৃহকর্ম চলে। ...
...অনেক কাল বোটের মধ্যে বাস করে হঠাৎ সাজাদপুরের বাড়িতে এসে উত্তীর্ণ হলে বড়ো ভালো লাগে।
বড়ো বড়ো জানলা দরজা, চারিদিক থেকে আলো বাতাস আসছে... যেদিকে চেয়ে দেখি সেই দিকেই গাছের সবুজ ডালপালা চোখে পড়ে এবং পাখির ডাক শুনতে পাই। ...
..এখানে যেমন আমার মনে লেখবার ভাব ও ইচ্ছা আসে এমন কোথাও না। বাইরের জগতের একটা সজীব প্রভাব ঘরে অবাধে প্রবেশ করে। ...আলোতে আকাশে বাতাসে শব্দে গন্ধে সবুজহিল্লোলে এবং আমার মনের নেশায় মিশিয়ে কত গল্পের ছাঁচ তৈরি হয়ে ওঠে!...
...বিশেষত এখানকার দুপুর বেলাকার মধ্যে একটা নিবিড় মোহ আছে। রৌদ্রের উত্তাপ, নিস্তব্ধতা, নির্জনতা, পাখিদের- বিশেষত কাকের ডাক, এবং সুন্দর সুদীর্ঘ অবসর- সবসুদ্ধ আমাকে উদাস করে দেয়।
...কেন জানি নে মনে হয়, এইরকম সোনালি রৌদ্রে ভরা দুপুর বেলা দিয়ে আরব্য উপন্যাস তৈরি হয়েছে। ...আমার এই সাজাদপুরের দুপুর বেলা গল্পের দুপুর বেলা। মনে আছে, ঠিক এই সময়ে এই টেবিলে বসে আপনার মনে ভোর হয়ে পোস্ট্মাস্টার গল্পটা লিখেছিলুম। ...
...যখন ভেবে দেখি এ জীবনে কেবলমাত্র ৩২ টি শরৎকাল এসেছে এবং গেছে, তখন ভারি আশ্চর্য বোধ হয়! অথচ মনে হয়, আমার স্মৃতিপথ ক্রমশই অস্পষ্টতর হয়ে অনাদিকালের দিকে চলে গেছে। ...
...এই বৃহৎ মানসরাজ্যের উপর যখন মেঘমুক্ত সুন্দর প্রভাতের রৌদ্রটি এসে পড়ে তখন আমি যেন আমার এক মায়া-অট্টালিকার বাতায়নে বসে এক সুদূর বিস্তৃত ভাবরাজ্যের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকি এবং আমার কপালে যে বাতাসটি এসে লাগতে থাকে সে যেন অতীতের সমস্ত অস্পষ্ট মৃদু গন্ধপ্রবাহ বহন করে আনতে থাকে।
...
...আমি আলো ও বাতাস এত ভালোবাসি! গেটে (Goethe) মরবার সময় বলেছিলেনঃ More light! ...আমার যদি সে সময় কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করবার থাকে তো আমি বলিঃ More light and more space!
...অনেকে বাংলাদেশকে সমতলভূমি বলে আপত্তি প্রকাশ করে; কিন্তু সেইজন্যেই এ দেশের মাঠের দৃশ্য, নদীতীরের দৃশ্য আমার এত বেশি ভালো লাগে। যখন সন্ধ্যার আলোক এবং সন্ধ্যার শান্তি উপর থেকে নামতে থাকে তখন সমস্ত অনবরুদ্ধ আকাশটি একটি নীলকান্তমণির পেয়ালার মতো আগাগোড়া পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে, যখন স্তিমিত শান্ত নীরব মধ্যাহ্ন তার সমস্ত সোনার আঁচলটি বিছিয়ে দেয় তখন কোথাও সে বাধা পায় না। ...
...চেয়ে চেয়ে দেখবার এবং দেখে দেখে মনটা ভরে নেবার এমন জায়গা আর কোথায় আছে!...
...কাল থেকে হঠাৎ আমার মাথায় একটা হ্যাপি থট এসেছে। আমি চিন্তা করে দেখলুম, পৃথিবীর উপকার করব ইচ্ছা থাকলেও কৃতকার্য হওয়া যায় না; কিন্তু তার বদলে যেটা করতে পারি সেইটে করে ফেললে অনেক সময় আপনিই পৃথিবীর উপকার হয়, নিদেন যা হোক একটা কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। আজকাল মনে হয়, যদি আমি আর কিছুই না করে ছোট ছোট গল্প লিখতে বসি তা হলে কতকটা মনের সুখে থাকি এবং কৃতকার্য হতে পারলে হয়তো পাঁচজন পাঠকেরও মনের সুখের কারণ হওয়া যায়।
...গল্প লেখবার একটা সুখ এই, যাদের কথা লিখব তারা আমার দিনরাত্রির সমস্ত অবসর একেবারে ভরে রেখে দেবে, আমার একলা মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার সময় আমার বদ্ধ ঘরের সংকীর্ণতা দূর করবে। ...
...এই সুবিস্তীর্ণ জলরাজ্যের মধ্যে শরতের উজ্জ্বল রৌদ্রে আমি জানালার কাছে এক চৌকিতে বসে আর-এক চৌকির উপর পা দিয়ে সমস্ত বেলা কেবল গুন্গুন্ করে গান করছি। ...রামকেলি প্রভৃতি সকালবেলাকার সুরের একটু আভাস লাগবামাত্র এমন একটি বিশ্বব্যাপী করুণা বিগলিত হয়ে চারি দিককে বাষ্পাকুল করছে যে এইসমস্ত রাগিণীকে সমস্ত আকাশের সমস্ত পৃথিবীর নিজের গান বলে মনে হচ্ছে। এ একটা ইন্দ্রজাল, একটা মায়ামন্ত্র। ...
...এখানে আমি একলা খুব মুগ্ধ এবং ত গত চিত্তে অর্ধনিমীলিতনেত্রে গেয়ে থাকি এবং পৃথিবীটা একটি সূর্যকরোজ্জ্বল অতি সুক্ষ্ম অশ্রুবাষ্পে আবৃত হয়ে, সাতরঙা ইন্দ্রধনু-রেখায় রঞ্জিত হয়ে দেখা দেয়।
...
...হে পদ্মা আমার,
তোমায় আমায় দেখা শত শত বার।
একদিন জনহীন তোমার পুলিণে,
গোধুলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে,
সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অস্তমান
তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরান।
অবসানসন্ধ্যালোকে আছিলে সেদিন
নতমুখী বধুসম শান্ত বাক্যহীন;
সন্ধ্যাতারা একাকিনী সস্নেহ কৌতুকে
চেয়ে ছিল তোমাপানে হাসিভরা মুখে।
সেদিনের পর হতে, হে পদ্মা আমার,
তোমায় আমায় দেখা শত শত বার।
...তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনো লেখায় হয় নি।
...তোকে আমি যখন লিখি তখন আমার এ কথা কখনো মনে উদয় হয় না যে, তুই আমার কোন কথা বুঝবি নে, কিম্বা ভুল বুঝবি, কিম্বা বিশ্বাস করবি নে, কিম্বা যেগুলো আমার পক্ষে গভীরতম সত্য কথা সেগুলোকে তুই কেবলমাত্র সুরচিত কাব্যকথা বলে মনে করবি। সেই জন্যে আমি যেমনটি মনে ভাবি ঠিক সেই রকমটি অনায়াসে বলে যেতে পারি। ...
ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।