নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কাল ম্যাচের দ্বিতীয় ভাগজুড়ে ক্রিকেটের মনোযোগী অনুসারীদের ভেতর ছিল শঙ্কাটা। শেষাঙ্কে রুবেল হোসেনের হাতে বল দেখে জাঁকিয়ে বসে তা! তবে সব সময় তো আর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় না, মাঝে মাঝে দায়ও শোধ করে ইতিহাস। কাল সেটি করল বলেই না সে দিনের হতাশায় ন্যুব্জ বাংলাদেশের কণ্ঠে এখন বিজয়নিনাদ; সে দিনের খলনায়ক রুবেল রূপান্তরিত মহানায়কে। শেষ বিকেলে এই পেসারের গুড লেন্থ বল কাইল মিলসের স্টাম্প উড়িয়ে দিতেই আনন্দসাগরে পরিণত হলো মিরপুর স্টেডিয়াম। যার ঢেউ ইট-কংক্রিটের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ৬৮ হাজার বর্গমাইলে।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হোয়াইটওয়াশ বলে কথা!
পূর্ণ শক্তির টেস্ট খেলুড়ে কোনো দেশের বিপক্ষে এটি প্রথম হোয়াইটওয়াশ। তবে বছর দুয়েক আগে কিন্তু আরেকটি 'প্রথম' হয়ে যেতে পারত। হয়নি যে, সেজন্য এত দিন হয়তো নিজেকে দুষেছেন রুবেল।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জিততে জিততেও জেতা হয়নি। শেষ ৩০ বলে লঙ্কানদের চাই ৩৫ রান, হাতে মাত্র ২ উইকেট_এমন পরিস্থিতিতে অধিনায়ক বল তুলে দিয়েছিলেন আগের ম্যাচে অভিষিক্ত রুবেলের হাতে।
ব্যাট হাতে অতিমানব হয়ে ওঠা মুত্তিয়া মুরালিধরন ২০ রান নিলে ম্যাচের পাল্লা ঝুঁকে যায় শ্রীলঙ্কার দিকে। রুবেলের দুর্দশার এখানেই শেষ না। পরের ওভারে ১২ রান দিলে পূর্ণ হয় ষোলকলা। বড় কোনো দলকে নিয়ে আয়োজিত ওয়ানডে টুর্নামেন্টের প্রথম শিরোপা জেতা হয়নি বাংলাদেশের। কাল নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করার পর রুবেলের বুকের ওপর থাকা পাষাণভারটা নেমে গেছে নিশ্চয়ই।
বাংলাদেশের এমন কত ম্যাচ গেছে, যখন প্রথমার্ধ মানেই খেলা শেষ। হয় প্রতিপক্ষের তিন-সাড়ে তিন শ রান কিংবা নিজেরা দেড় শ-দুই শতে অলআউট। এরপর আর আনুষ্ঠানিকতার অপেক্ষা ছাড়া উপায় কী! কাল বাংলাদেশ ১৭৪ রানে গুটিয়ে গেলে ফিরে আসে সেই স্মৃতি। বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে সবচেয়ে আশাবাদী লোকটির কাছেও তখন হোয়াইটওয়াশের স্বপ্ন গৌণ হয়ে সিরিজ জয়ের আলোচনা হয়ে ওঠে মুখ্য। কিন্তু এই বাংলাদেশ যে বদলে যাওয়া দল; অন্তত কালকের ম্যাচ বিবেচনায় কখনো-সখনো তাদের অস্ট্রেলিয়া বলেও ভ্রম হচ্ছিল।
তাই তো হারার আগে না হারার মানসিকতার প্রকাশ ছিল বোলিং-ফিল্ডিংয়ের পরতে পরতে। শুরুতে ৫ উইকেট নেয়ার সময়; আবার মাঝের দিকভ্রান্ত তরী শেষ বেলায় তীরে ভেড়ানোর সময়টাতেও।
ওই ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টের ফাইনালে ১৫২ রানে অলআউট হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। এরপর বোলিংয়ে সেই স্বপ্নের শুরু। ৮ ওভারে ৬ রান তুলতেই লঙ্কানদের ৫ উইকেট হাওয়া।
এবার রানটা একটু বেশি হয়ে গেছে, এই যা! ৬.৫ ওভারে স্কোর বোর্ডে ২০ রান জমা করতেই কিউইদের অর্ধেক ইনিংস শেষ! শুরুটা সেই রুবেলের। ইনিংসের দ্বিতীয় এবং নিজের প্রথম ওভারেই তাঁর আগুনে-গোলায় জ্বলে ছাই ব্রেন্ডন ম্যাককালাম (৪) ও জেসি রাইডার (৪)। প্রথমজন পুল করতে গিয়ে ক্যাচ দিয়েছেন মিড অফে; পরেরজন গতিতে পরাস্ত হয়ে এলবিডবি্লউ। ১৭৪ করেও যে জেতা যায়, এই দুই উইকেটে বিশ্বাসটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ১১ ক্রিকেটযোদ্ধার ভেতর।
সেই বিশ্বাসের পালে হাওয়া লাগাতে ভাগ্যের সহায়তাও কম ছিল না।
নইলে কেন পঞ্চম ওভারে ব্রাডলি-জন ওয়াটলিং (১) অমনভাবে রান নেয়ার জন্য ছুটবেন! আর তৃতীয় আম্পায়ারই-বা কেন 'আগে হাত লেগে না বল লেগে স্টাম্প পড়েছে'-র দোলাচলে রানআউটের রায় দেবেন! পরের ওভারে আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান কেন ওয়াটলিংকে (০) স্লিপে ক্যাচ বানান রুবেল। তাঁর বোলিং স্পেলটি তখন বাঁধিয়ে রাখার মতো_২.৪-১-৫-৩! পরের ওভারে আবদুর রাজ্জাকের আর্ম বলে রস টেলরের (৩) বেলস নড়ে গেলে ২০ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বসে নিউজিল্যান্ড। গ্যালারির 'বাংলাদেশ, বাংলাদেশ' ধ্বনি জানান দিচ্ছিল, ম্যাচে তখন একটিই দল!
তবে এই উইকেট-উৎসবেও জানা ছিল যে, ফেরার এক চেষ্টা কিউইরা করবেই। ষষ্ঠ উইকেটে ড্যানিয়েল ভেট্টোরি ও গ্রান্ট এলিয়টের ৮৬ রানের জুটিতে সেই প্রত্যাশিত প্রতিরোধ। সেজন্য অবশ্য জুনায়েদ সিদ্দিকীকে এক বিশাল ধন্যবাদ দিতে পারেন নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক।
মাহমুদুল্লাহর বলে স্লিপে তাঁর সহজ ক্যাচ ফেলেছেন বাংলাদেশের এই বাঁ-হাতি ওপেনার। দলের রান তখন ৪১, ভেট্টোরির ১২।
বাংলাদেশের হোয়াইটওয়াশের স্বপ্ন যখন ছিনতাই করে নিচ্ছিল এই জুটি, তখনই মঞ্চে সাকিবের প্রবেশ। ব্যাট হাতে দলের সর্বোচ্চ রান করেছেন ঠিক; তবে সেটি তো মাত্রই ৩৬। বল হাতে তাই জাদু না দেখালে চলে! সেই জাদু সম্পন্ন হতো না শফিউল ছাড়া।
ডিপ স্কয়ার লেগ থেকে দৌড়ে ভেট্টোরির (৪৩) কী অসাধারণ ক্যাচটাই না নিয়েছেন এই পেসার! নাথান ম্যাককালামকেও ফিরিয়ে দেন সাকিব। অবশ্য তার আগে জুনায়েদের সৌজন্যে একটি 'লাইফ' পেয়েছিলেন।
ম্যাচ তখন পুরোমাত্রায় হেলে বাংলাদেশের দিকেই। বাধা কেবল এলিয়ট। সাকিবের বলে ডিপ স্কয়ার লেগে মাহমুদুল্লাহ যখন এলিয়টের ক্যাচ ছাড়েন, তখন আবারও ম্যাচের ভাগ্য নিয়ে অনিশ্চয়তা।
৪৫ রানে থাকা এলিয়ট হাফ সেঞ্চুরি পেরিয়েও এগোচ্ছিলেন তর তর করে। কিন্তু সোহরায়ার্দির ঘূর্ণিজাদুতে সেই রুবেলের তালুবন্দি হলে থেমে যায় তাঁর প্রতিরোধ।
তবুও শেষ ওভারে জয়ের অবস্থানে চলে গিয়েছিল নিউজিল্যান্ড। ম্যাচের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতা, ইমরুল (৩৪), মুশফিকুর (২৯) মাহমুদুল্লাহদের (১৯) ভালো শুরুর পরও বড় স্কোর করতে না পারা, তৃতীয় আম্পায়ারের দেওয়া সাকিবের বিতর্কিত আউট, ৩১ রানে শেষ ৫ উইকেট হারানো_এসব ছাপিয়ে তখন নাটকের শেষ অঙ্কের শিহরণ। রুবেলের প্রথম বলে কাইল মিলসের বাউন্ডারিতে যা ইঙ্গিত দিচ্ছিল ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির।
কিন্তু ওই যে, কাল ছিল দায় শোধের দিন। বাংলাদেশের; রুবেলেরও। তাই তো তাঁর তৃতীয় বলটি বাতাসে ভাসিয়ে দিল মিলসের স্টাম্প। আকাশে উড়িয়ে দিল রুবেলকে, বাংলাদেশকে। হতাশার অথৈ সমুদ্র ফুঁড়ে জয়ধ্বনিতে মুখরিত হলো ১৫ কোটি জনতা।
নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করার জয়ানন্দ তো বড্ড কম নয়!
CLICK THIS LINK
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।