কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, দেশের রাজা ভালো হলে প্রজারা সুখে থাকে। আর রাজা যদি খারাপ হয় তবে প্রজাদের দুঃখ ও দুর্ভোগ বাড়ে। তিনি আরও বলেছেন, আম গাছ লাগালে আম খাবেন আর আমড়া গাছ লাগালে আমড়া খাবেন। গত ৭ সেপ্টেম্বর শেরপুরের নকলা থানার বিভিন্ন ইউনিয়নে গরিব, দুস্থ ও অসহায় মানুষদের মাঝে বিশেষ ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় ঈদপণ্য বিতরণকালে তিনি এ অমৃতবানী দেন।
তবে তিনি হয়ত এই প্রবাদটি ভুলে গেছেন ‘রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট প্রজা কষ্ট পায়, রানীর দোষে সংসার নষ্ট শান্তি চলে যায়।
’
তা না হলে এমন অপ্রিয় সত্যকথা বলতেন না, যখন তার রাজার (শেখ হাসিনা) শাসন চলছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তার এ বক্তব্য কতটা মানানসই, কতটা যুক্তিসঙ্গত? বাংলাদেশের আপামর সাধারণ মানুষ কতটা ভালো আছেন তা কিন্তু তিনি বলেননি। আর প্রজা বলতে তিনি শুধু দলীয় নেতাকর্মী, চেলাচামুণ্ডাদের বুঝিয়েছেন কিনা তারও কোনো বিশদ ব্যাখ্যা তার বক্তব্যে নেই। বিষয়টা যদি সার্বজনীন হয়, তাহলে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশের মানুষ কি খুব সুখে আছে? আদৌ কি তারা সুখে আছে? বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ভয়াবহ লোডশেডিংয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত। বছরে এগারোটি মাস পর একটি মাস পবিত্র মাহে রমজান এলো এবং চলেও গেল।
মাত্র এই একটি মাসে সরকার বিদ্যুত্ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পারেনি। ইফতার, তারাবি, সাহরি অথবা সারাদিনের কখনোই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত্ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। আর বিদ্যুত্ না থাকলে পানি থাকে না, একথা সবারই জানা। গ্যাস সঙ্কট তো লেগেই আছে। তার কোনো সুরাহা হবে এমন কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
মাছ-মাংসের বাজারে পাগলা ঘোড়া ছুটছে। চালের বাজার অস্থিতিশীল। ১৫ টাকার চাল এখন ৩৮ টাকা। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য হচ্ছে ভাত। আওয়ামী মহাজোট নির্বাচনের আগে ওয়াদা করেছিল জনগণকে ১০ টাকা কেজি চাল খাওয়াবে।
হুজুগে বাঙালি ভোট দিয়েছিল। কিন্তু তাদের স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছে এরই মধ্যে। ১০ টাকা তো নয়ই, চালের মূল্য বেড়েছে তিনগুণ। আওয়ামী মহাজোটের ওয়াদা ছিল ৫ টাকা কেজি কাঁচা মরিচ খাওয়াবে। ভাগ্যিস ৫ টাকার বদলে ৫শ’ টাকা হয়নি, হয়েছে ২০০ টাকা মাত্র।
পুরো রমজানে অনেকেই কাঁচামরিচের ধারে-কাছেও যায়নি। কথা ছিল ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার। উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার। কিন্তু সেসব স্বপ্ন কর্পূরের মতো উবে যেতে শুরু করেছে। উপকূলীয় জেলা বরগুনায় গিয়ে ঘটা করে ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার কার্যক্রম শুরু করা হলো।
কিন্তু তারপর কী ঘটেছে সে খবর আর কেউ রাখেনি। কোথায় আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ? দু’চারটা কম্পিউটার বিতরণ আর উজির-নাজিরদের সামনে দামি ল্যাপটপের উপস্থিতিই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রমাণ বহন করে না।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ দলীয় চেলাচামুাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলের দুর্গন্ধে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। নারীর ইজ্জত হরণ থেকে শুরু করে হেন অপকর্ম নেই যা সোনার ছেলেদের দ্বারা সংঘটিত হয়নি। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, হামলা, হয়রানি, জেল, জুলুম, গ্রেফতার, স্মরণকালের রেকর্ডকারী রিমান্ডে পুরো দেশ এক বিশাল কারাগারে পরিণত হয়েছে বলে অনেকেই মন্তব্য করছেন।
আওয়ামী মহাজোট সরকার এবার বিভিন্ন ক্ষেত্রেই রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। প্রতিপক্ষ দমনে, গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার নীলনকশা বাস্তবায়ন পরিকল্পনাসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই এ সরকার আদালতকে নগ্নভাবে ব্যবহার করেছে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দেশে ঈমান, আমল, আকিদা ও ইসলামের বিরুদ্ধে নগ্ন অবস্থান নেয়া, তথাকথিত জঙ্গি আখ্যা দিয়ে হাক্কানি আলেম-ওলামাদের নানাভাবে নাজেহাল ও হেনস্তা করায় দেশের মানুষ আজ এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। তারপরও উজির-নাজিররা বলছেন, দেশ খুব ভালো চলছে। মানুষ নাকি খুব শান্তিতে (?) আছে।
সরকারের মন্ত্রী-এমপি, মন্ত্রীপুত্রদের দুর্নীতিতে প্রশাসনে স্থবিরতা সৃষ্টি হওয়ার পরও নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায় থেকে দাবি করা হয়, এ সরকারের আমলে নাকি দুর্নীতির ছিটেফোঁটাও হয়নি। অথচ গণমাধ্যমে খবর বের হয়, ‘ঘুষের টাকা ফেরত পাচ্ছেন না ৪৩ হাজার শিক্ষক প্রার্থী’ (আমাদের সময় : ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১০)। ঘুষের পরিমাণ জনপ্রতি ২ থেকে ৪ লাখ টাকা। এখন আবার সার্ভিস চার্জ দিয়ে ঘুষের টাকা ফেরত নিতে হচ্ছে শিক্ষক প্রার্থীদের। এসব যদি দুর্নীতি না হয় তাহলে দুর্নীতির সংজ্ঞা কী সেটাও জানা দরকার।
এসবের পরও দেশের মানুষ কী করে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারে বোধগম্য নয়।
মালিবাগ হত্যাকাণ্ডের অন্যতম খুনি শাওনকে চ্যাংদোলা করে ধরে নিয়ে ভোলার উপনির্বাচনে পেশিশক্তিবলে এমপি বানিয়ে আনা হলো। কিন্তু কথায় আছে না, কয়লার ময়লা যায় না ধুইলে, তেমনি স্বভাব যায় না মইলে। শাওনের স্বভাব চরিত্রেরও কোনো পরিবর্তন হয়নি। রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ও দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত সহকর্মী ইব্রাহিমের হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করেছে, তার চরিত্রের সামান্যতম পরিবর্তনও হয়নি।
অক্ষরে অক্ষরে আরও প্রমাণিত হয়েছে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর বক্তব্যও। তিনি বলেছেন, আমড়া গাছে কখনও আম হয় না। একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসীকে ক্ষমতার জোরে এমপি কেন, মন্ত্রী-উপদেষ্টা বানালেও সময়মত তার আসল চেহারা প্রকাশ পেয়েই যায়। মহান জাতীয় সংসদে এরকম একজন দাগি আসামিকে নিয়ে যাওয়াটা কতটা ভুল হয়েছে, আওয়ামী মহাজোট সরকার এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, নিজের গাড়িতে নিজের পিস্তল দিয়ে ইব্রাহিম খুন হওয়ার পর, শাওন যেখানে স্বীকার করেছেন তার পিস্তলের গুলিতেই এ হত্যাকা সংঘটিত হয়েছে, তারপরও শাওনকে বাঁচানোার জন্য সরকার ও প্রশাসন যন্ত্রের সে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা! ক্ষমতার মদমত্ততায় সরকারের এতটা বেসামাল হওয়া আগে কখনও চোখে পড়েনি।
মতিয়া চৌধুরীর বক্তব্যকে স্যালুট করতে হয়। তিনি ঠিকই বলেছেন, আমড়া গাছে কখনও আম হয় না। আপনি লাগাবেন আমড়া গাছ, আর খেতে চাইবেন আম—তা কী করে হয়? কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, রাজা ভালো হলে প্রজারা সুখে থাকে। নিখাদ সত্য কথা। কিন্তু রাজা যদি শাওনের মতো হয়? তখন তো শুক পাখি হয়ে উড়াল দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের কথাবার্তা আর বাতচিত্ শুনলে মনে হয়, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছেন।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর বক্তব্যের সূত্র ধরেই বলতে হয়, দেশের মানুষ সুখে আছে নাকি টেনেটুনে কোনোমতে জীবন পরিচালনা করছে তা জানতে হলে, দেখতে হলে জনতার কাতারে শামিল হতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস, পানি, বিদ্যুত্ সঙ্কটে জনজীবনে চলছে ত্রাহি অবস্থা। দলীয় গুণ্ডাপাণ্ডা, ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের ভয়াবহ সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জবরদখল, খুনখারাবি, দিনেদুপুরে নারীর ইজ্জত হরণ, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার, রিমান্ড, মধ্যযুগীয় বর্বরতায় নির্যাতন, দলীয় লোক বসিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে যথেচ্ছ ব্যবহার, র্যাব-পুলিশ বাহিনীকে দলীয় ঠেঙ্গারে বাহিনীতে পরিণত করা, এশিয়ান হাইওয়ের নামে ভারতকে ট্রানজিট ও সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের সুবিধাদান, ভারতের সঙ্গে একের পর এক আত্মঘাতী চুক্তি করে দেশকে দীর্ঘমেয়াদি গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ করা, দেশের হাক্কানি আলেম-ওলামাদের তথাকথিত জঙ্গি আখ্যা দিয়ে নানাভাবে অপদস্থ ও হেনস্তা করে দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যদি বলা হয়, বাহ্ প্রজারা বড়ই সুখে আছে। আহা কী আনন্দ! কী আনন্দ! তা শুনতে বড়ই বেসুরো লাগে।
আর এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি যে দেশে হয়, সে দেশের রাজা ভালো না মন্দ তার বিচারের ভার থাকল জনতার ওপর। ঢাকঢোল পিটিয়ে উজির-নাজিরের এসব তো বলার দরকার নেই। জনগণই বলুক না, তারা কেমন আছেন?
সূত্র: দৈনিক আমারদেশ, ০৮ অক্টোবর ২০১০।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।