যা শিখেছি, সেখান থেকেই কিছু বলার ও করার চেষ্টা করি
অনেকদিনের পুরোনো অভ্যাস। ঢাকায় থাকলেই চন্দ্রিমা/জিয়া উদ্যানে গিয়ে বিকেলের সময়টা কাটানো। সম্ভব হলে বন্ধুদের সাথে অথবা মাঝেমধ্যে এক একাই। কিছুদিন আগেও এক বিকেলে একাই গিয়েছিলাম সেখানে। লেকের পাড়ের আমার অতিপ্রিয় সিড়িটায় বসতে।
বসেছিলাম একা একা। হঠাৎ চোখে পড়লো অপরিচিত এক দৃশ্য। পার্কে বসা অসংখ্য যুগলের মাঝে এক যুগল দেখে চোখ আটকে গেল। তারা একজন আরেকজনের হাত ধরে বসে বসে হাওয়াই মিঠাই খাচ্ছেন। তাদের সাথে আবার কিছু ফুলও আছে।
হুম, দৃশ্যটা পরিচিতই। তবে যদি বলি যারা বসে ছিলেন তাদের প্রত্যেকের বয়স ষাটোর্ধ। দুজনেরই অধিকাংশ চুৃল পাকা। লোকটির গালে সাদা দাড়ি। এবার মনে হয় কিছুটা অপরিচিতই মনে হচ্ছে, তাইনা ? তাদের বসা-বাচনভঙ্গি ইত্যাদি দেখে মনে হবার উপায় নেই যে তারা শেষ বয়সে উপনিত।
পোশাক-আশাকেও মার্জিত তবে রঙিন। দূর থেকে মনে হচ্ছিল ২৪/২৫ বছরের দুই তরুন-তরুনি চুটিয়ে প্রেম করছে। খুনসুটি করছে ঠুনকো বিষয়ে। কিছুক্ষণ পরপরই হেসে দিচ্ছেন দুজনেই। এত এত কমবয়সিদের মধ্যে তাদের যেন কোন সংকোচ নেই।
ব্যক্তিগত কৌতুহল থেকেই কেন জানি তাদের সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করলো। কাছে গেলাম, সালাম দিলাম। প্রাথমিক ভদ্রতা মেনে সমাধান চাইলাম আমার কৌতুহলের। বললাম,‘ এখানে আপনাদের বয়সের কেউ নেই, কিন্তু আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে আপনারাই যেন এখানে বসা সকলের আদর্শ। ’ নিজের অবাককরা ভালালাগা বিষয়গুলো খুলে বললাম।
বৃদ্ধ লোকটি আমার কথা শুনে বিশাল এক হাসিতে ফেটে পড়লো। এরপর তিনি আমাকে টেনে তার পাশে বসালেন। বললেন, ‘বস, চা খাই। তোমার চোখে-মুখে অনেক প্রশ্ন দেখতে পাচ্ছি। তোমাকে একটা গল্প শোনাবো।
’
আমাকে তারা এতটা সহজভাবে নেবেন সেটা আমার ধারনার বাইরে ছিল। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনকে এভাবে পাশে টেনে বসাবে এমনটা আজকাল কম ঘটে।
যাই হোক, লোকটি তার গল্প বলতে শুরু করলেন। গল্পটা আমার নিজের ভাষায় বললে হবে এরকম- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে পড়ার সুবাদে তাদের পরিচয়। ব্যবধান দুই ইয়ারের।
সেখান থেকে প্রেম। পালিয়ে পালিয়ে ঘুরে বেড়ানো। অন্যসব প্রেমের গল্পের মতই। ১৯৬৮ সালে ছেলেটি যখন মাস্টার্সে তখন বিয়ে করেন দুজনে। হল ছেড়ে একরুমের একটা বাসা নিয়ে জীবন শুরু করেন।
প্রথম সংসারে তাদের কয়েকটি হাড়িপাতিল ও তোষক-বালিশ ছাড়া কিছুই ছিল না। দেশে জমি বিক্রির টাকা দিয়ে লেখপড়া পাশাপাশি ছেলেটি শুরু করে ব্যবসা। এরপর জীবন চলেছে স্বাভাবিক নিয়মে। একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি হয়েছেন তিনি। দুটি সন্তান হয়েছে, তাদের বড় করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন।
মোটামুটি জীবনের সকল কর্তব্যই শেষ করেছেন।
তিনি বললেন, আমাদের প্রেমের প্রথম দিনগুলিকে আমরা আজও বাচিয়ে রেখেছি। শত ব্যস্ততা, চাপ, বিপদের মধ্যেও আমরা হাত ছাড়িনি। একজন আরেকজনের ভরসা হয়ে থেকেছি। একজনকে আরেকজনের আশ্রয় মনে করেছি।
পাশাপাশি থেকেই কাটিয়ে দিয়েছি এতগুলো বছর। এক মূহুর্তের জন্যেও কেউ কাউকে আলাদা ভাবিনি। প্রেমকে কখনোই পূরনো হতে দিইনি। আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী পাশাপাশি এই দিনেই আমি ওকে প্রথম দেখেছিলাম, প্রেমেও পড়েছিলাম। গত প্রায় পঞ্চাশ বছরে আমরা এই দিনটিকে উদযাপন করি ঠিক প্রথম দিনগুলির মত করে।
আবার জাগিয়ে তুলি প্রিয় অনুভুতিগুলোকে। ঘুরে বেড়াই যুবক-যবতিদের মত। ভালবাসায় কখনো বয়সের ক্লান্তি পড়তে দেইনি। অনেক ঝড়ঝাপটার মধ্যেও শুধুমাত্র এই কারনেই সুখে ছিলাম, আজো আছি, থাকবো শেষদিন পর্যন্ত।
এরকম আরও অনেক কথাই বললেন তারা দুইজন।
প্রায় দেড় ঘন্টা বসে ছিলাম তাদের সাথে। অনেক গল্প করলেন দুই প্রেমিক-প্রেমিকা। তাদের যৌবনের স্মৃতি। আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে গোগ্রাসে গিলেছি সব। বেশ আদরও করলেন তাদের সন্তানের মত।
পরিশেষে তাদের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে তাদেরকে কিছু ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলাম।
সেদিন এক বিকেলে আমি নতুন করে অনেক কিছু শিখেছি। সভ্যতা, প্রেম, আন্তরিকতা, মমতা ও দ্বায়িত্ব। বিশেষ করে দেখেছি প্রেমের এক নতুন রূপ। জীবনে প্রেমিক-প্রেমিকা দেখেছি অনেক।
তবে প্রেম খুব কমই দেখেছি। অধিকাংশ প্রেমই দেখেছি প্রয়োজন নির্ভর, প্রতিশ্রুতি নির্ভর প্রেম তেমন একটা চোখে পড়েনি। তবে যে কটাই পড়েছে তার মধ্যে এটা যে সর্বশ্রেষ্ট সেটা বলতে আমার বাধা নেই। মানছি সকল ভালবাসার সম্পর্কই টিকে থাকে জীবনের শেষ পর্যন্ত। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ আবেগ ও যৌবন নিয়ে থাকে কয়টা? এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা জীবনের সকল ব্যস্ততা ডিঙিয়ে এসে আজ সূর্যাস্তের মুখে দাড়িয়েও বুড়ো হতে দেননি তাদের প্রেমকে।
শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ধরে রেখেছেন একই রকম প্রনয়, একই রকম আগ্রহ, একই রকম মানসিকতা। তারা প্রেম করে বেড়াচ্ছেন একখনকার যুবক-যুবতীদের মতই। বয়সের কোন প্রভাবই যেন পড়েনি তাদের ভালবাসায়। আবার তাদের প্রেমের উচ্চতাও হাড় মানাচ্ছে নব্য যুগলদের। প্রেমের ভাল-মন্দের দ্বন্দে যাচ্ছিনা।
তবে যেটা দেখেছি তা অবশ্যই পূজনীয়। নশ্বর পৃথিবীতে প্রেমের অবিনশ্বরতার নমুনা বুঝি এরকমই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।