একটি বৈষম্যহীন, শোষণহীন, অসাম্প্রদায়ীক ও ঐক্যবদ্ধ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি
আমাদের এই শহরে অনেক দিনের পুরোনো এক কাকের বসবাস। এক সময়ের দাম্ভিক আর প্রচন্ড ক্ষমতাবান নিঃসঙ্গ বুড়ো কাকটি ঘুড়ে বেড়ায় শহরের এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়ালে, এক গাছ থেকে আরেক গাছে। অনেক স্মৃতি, অনেক অভিজ্ঞতার বোঝা বয়ে বেড়ায় সে প্রতিদিন, আর অপেক্ষা করে মৃত্যুর। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এই বুড়ো কাক পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে চায় তার না বলা গল্পগুলো মাথায় নিয়েই। এই বলতে না পারার কষ্ট নিয়েই সে প্রতিদিন ঘুড়ে বেড়ায় শহরের এ গলি থেকে ও গলি, এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত।
একা একটি নিঃসঙ্গ কাক হয়তো আপনাদের মধ্যে অনেকেই দেখেছেন। হয়তো, ভরদুপুরে এক মনে কা কা করতেও শুনেছেন।
তরুন কিংবা কিশোর বয়সের কাকেরা সহজে তার ধারে কাছে ঘেষে না। হয়তো ভাবে এই বোধহয় বুড়ো আবার শুরু করল। বুড়ো কাকগুলো আসলে এরকমই হয়।
একবার শুরু হলে থামতেই চায় না। এই কাকটা অবশ্য ওরকম নয়। প্রচন্ড গম্ভীর, নিজের খেয়াল খুশিমত ঘুড়ে বেড়ানো কাক। নিজের খাবার নিজেই খুঁজে বের করে খায়, কারো উপর নির্ভরশীল নয় সে। যদিও বয়সের ভারে আগের মত উড়তে পারে না এখন।
তাই কোথাও উড়ে গিয়ে বসে দেখতে থাকে মানুষের কাজ কারবার। আর মানুষকে তার না বলা গল্পগুলো বলতে চায়। যদিও মানুষ তার গল্প শোনে না। উল্টো তার কর্কশ ডাকে বিরক্ত হয়ে ঢিল ছোড়ে। এতে অবশ্য সে বিরক্ত হয় না।
কারণ জন্মের পর থেকেই মানুষের কাছ থেকে এরকম ব্যবহার পেয়েই সে অভ্যস্ত। মাঝে মাঝে এসব মানুষদের জন্য তার প্রচন্ড করুনা হয়। আকৃ্তিতে মানুষের মত হলেও এদের বেশির ভাগই মানুষ হতে পারেনি এই কথাটি ভেবে। মানুষের আচরণ কতটা পাশবিক হতে পারে সেটা চিন্তা করা বোধহয় বেশিরভাগ পশু-পাখিরও ক্ষমতার বাইরে।
বুড়ো কাকের জন্ম যখন তখন ঢাকায় মোটামুটি গাছপালা ভালোই ছিল।
এরকম একটা গাছেই কাকের জন্ম। নারিকেল না আমগাছ সেটা মনে নেই। কারণ জন্মের কিছুদিন পরেই কাককে বাস্তুহারা হতে হয়েছিল। বাড়ির মালিক কাকের অসহ্য কা কা সহ্য করতে না পেরে গাছটা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। এর আগেও অবশ্য তিনি বাসা ভেঙ্গেছেন কয়েকবার, কিন্তু লাভ হয়নি।
বুড়ো কাকের পিতা-মাতা পুনরায় বাসা বানিয়েছে। তাই সেবার গাছটাই কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। কাকটা তখন কেবল উড়তে শিখছে, ভালোমত উড়তেও পারেনা। গাছ কাটার সময় বোনটা মারা গেল গাছের নিচে পড়ে। মানুষের প্রতি বুড়ো কাকের খুব রাগ ছিল অনেকদিন।
বোনের সাথে ভাইটিও মারা গেছে ভেবে বোনের লাশের পাশে আরো জ্ঞাতি ভাই-বোনদের নিয়ে অনেক কান্নাকাটি করলেন বাবা-মা। এরপর কোথায় যে চলে গেলেন তাদের আর খুঁজে পেল না বুড়ো কাক। সেই থেকেই একা।
কিছুদিনের মধ্যে অবশ্য দুনিয়ার হাব-ভাব বুঝে ফেলেছিল সে। জুটিয়ে নিয়েছিল কিছু সাঙ্গ-পাঙ্গ।
এরপর শুরু করেছিল এলাকার ডাস্টবিন আর ময়লা ফেলার জায়গাগুলোতে হামলা। সম্মিলিত আক্রমনে টিকতে পারত না অন্য কাকের দলগুলো। অনেক বড় আর নামকরা নেতা হয়ে উঠেছিল একসময় এই বুড়ো কাকটা। ওদের দলটার সাথে পেড়ে উঠতো না চিল শকুনেরাও। শহরের সব আবর্জনার স্তুপ দখলে নিয়ে নিয়েছিল ওরা।
প্রায় ছাদে কাপড় শুকাতে যাওয়া মানুষগুলোকে খাঁমচে দেয়ার ভঙ্গিতে এগিয়ে যেত দলবেধে। একটা সন্ত্রাসী সন্ত্রাসী ভাব ছিল।
একটা ঘটনার পর থেকে ছেড়ে দিয়েছিল সব। সেসব দিনের কথা এখন আর মনে করতে চায় না সে। এখন তার নিয়মিত কাজ হচ্ছে ঘুড়ে বেড়ানো।
অনেক লড়াই, ক্ষমতার দাপট তো হল, এবার বিশ্রাম। প্রায়ই সে পরিচিত ডাস্টবিনগুলোতে খাবারের খোঁজে যায়। সেখানে থাকা নেতা গোছের কাকগুলো তাকে চিনতে পেড়ে এগিয়ে এসে কা কা করে। কথা বলতে চায়। এদের বেশিরভাগই ওর সাথে কাজ করত।
সবাইকেই সে এড়িয়ে চলে। নীরবে খাওয়া শেষ করে উড়ে যায়। অপেক্ষাকৃ্ত তরুন কাকগুলো তখন কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে থাকে তাদের নেতাদের দিকে, কিছু জানবার আশায়। একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ছাড়া কিছুই শুনতে পায় না তারা।
বুড়ো কাক উড়ে বেড়ায় শহরের বিভিন্ন জায়গায়।
শহরের প্রায় সব বস্তি তার পরিচিত। এই তো ক’দিন আগে একটা বস্তিতে যখন আগুন লাগল তখন সে সেখানেই ছিল। গরীব মানুষগুলো সামান্য সম্বল হারানোর ভয়ে কিংবা হারিয়ে কি দিগবিদিকই না ছুটছিল। এর মধ্যেও কেউ কেউ হয়তো প্রতিবেশির তাড়াহুড়ার সুযোগ নিয়ে চুরি করছিল। হায়রে মানুষ !!! কাক তো কাকের মাংস খায় না, মানুষগুলো কেন একে অপরের ক্ষতি করতে চায় ???
মেডিকেলের সামনে বসে সে প্রায়ই দেখে দূর-দুরান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসা অশিক্ষিত মানুষগুলো কিভাবে ঠকছে দালালদের খপ্পরে পড়ে।
এমনকি শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তরাও যে এদের পাল্লায় পড়ে অসহায় তাতো সে নিজের চোক্ষেই দেখেছে। আহারে ! সেদিন একটা পিচ্চি মেয়ের বড়ভাই দালালদের কথা না শুনে সরাসরি চিকিৎসা নিতে গিয়ে কি হেনস্তাই না হয়েছিল। পরে দালালদের হাতে পায়ে ধরে মাফ চেয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। সমাজটা এখন দালালদের, যে যেভাবে পারছে দালালী করছে। আর যারা দালালীর প্রতিবাদ করছে তারা হেনস্তা হচ্ছে।
বাবা-মা’র কাছে গল্প শুনেছিল মানুষের মধ্যে পুলিশ নামের একটা প্রজাতি আছে, যাদের কাজ হল মানুষের মধ্যে যারা খারাপ কাজ করে বেরায় তাদের ধরে ধরে শাস্তির ব্যবস্থা করা। বুড়ো কাকের প্রায়ই মনে হয়, ছোটবেলা থেকে যেসব কাজকে খারাপ জেনে এসেছে, সেগুলো যারা করে তাদেরই তো পুলিশ সাহায্য করে আর যারা এর প্রতিবাদ করে তাদেরকেই পেটায়। তাহলে কি ছোটবেলায় বাবা-মা ওকে ভূল বলেছিলেন, মিথ্যা বলেছিলেন !!!
এই তো দু’বছর আগে এক কাঠফাটা গরমের দিনে পল্টন এলাকায় ছিল সে। একদল মানুষ সরকারের দালালির বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে মিছিল করছিল। ওরা নাকি, রক্ত দেবে কিন্তু তেল-গ্যাস দেবে না।
কি মারটাই না মরল ওদের পুলিশ!!! শিক্ষক-ছাত্র-নেতা কেউ বাদ পড়ল না। অথচ ওদের দোষ ছিল ওরা দেশের সম্পদ বাঁচানোর দাবী তুলেছিল। দেশের মানুষের কাজে লাগানোর কথা বলেছিল।
কোন এক হরতালের আগে থানার সামনে বসে ঝিমুচ্ছিল বুড়ো কাক, তখনও অতটা বুড়ো হয়নি, তবে দলে-বলে চলা ছেড়ে দিয়েছিল। হঠাৎ রাতের বেলা প্রচন্ড শোরগোল গাড়ি ভর্তি করে মানুষ এনে ঢুকাচ্ছে খাঁচার ভেতরে মানে জেল না কি বলে।
খুব সম্ভবত ঈদের সময় ছিল সেটা, এদের মধ্যে ক’জন অপরাধী ছিল সেটা নিয়ে ওর যথেষ্ঠ সন্দেহ ছিল। বারোঘাটের জল খেয়ে ততদিনে মানুষ সে ভালোই চিনেছে। পরদিন কিংবা রাতেই এদের অনেককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এক একজনকে ছেড়ে দিচ্ছিল আর থানার অফিসারদের দন্ত বিকশিত হচ্ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাগুলো ওর খুব পছন্দের।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায়ই যাওয়া হয় তার। ওখানে গেলে কষ্ট ছাড়াই বেশ খানিকটা খাবারের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। তবে সমস্যা হয়। প্রচুর পরিমানে খাবার থাকায় প্রচুর সংখ্যক কাকের সমাগম ঘটে এসব জায়গায়। একসময় ক্যাম্পাসগুলোতে গেলে জাতীয় ও বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে ছাত্রদের তুমুল আলোচনা শোনা যেত।
এখন খালি পরীক্ষার কথাই শোনা যায়। মানুষের বাচ্চাগুলো মনে হয় খালি পরীক্ষাই দেয়।
তবে একবার প্রচন্ড খেঁপে উঠতে দেখেছিল ওদের। ক্যাম্পাসসহ শহরের বিভিন্ন জায়গায় একদল জলপাই রঙের মানুষ দেখা যাচ্ছিল। এর আগেও অবশ্য এদেরকে দেখেছিল বুড়ো কাক, তবে সারা শহরে নয়, শহরের কয়েকটা নির্দিষ্ট জায়গায়।
এদেরই একটা দলের সাথে ছাত্ররা মারামারি বাধাল। সেকি মারামারি !!! সারা শহরে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে এসে এর প্রতিবাদ করতে লাগল। সেই ক’টা দিন এবং তার পরেও কিছুদিন ছাত্রদের দেখেছিলাম পরীক্ষা ছাড়া অন্য বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। মানুষগুলো তখন বেশ কয়েকদিন যাবৎ খুব চুপচাপ ছিল। কেউ কারো সাথে কথা বলত না তেমন, বললেও জোড়ে বলত না।
ওদের মধ্যে কি যেন এক জরুরী আইন না কি ছিল তাই ওরা কোন অন্যায়ের প্রতিবাদও করতে পারত না। জড়ো হতে পারত না। কাকেরা অবশ্য সেসময় খুব ভালো ছিল। মধ্যেখানে সে সময় মানুষের সমাবেশ না হওয়ায় কয়েকটা কাকের সমাবেশ দূর থেকে দেখতে গিয়েছিল বুড়ো কাক। ওর কাছে মনে হয়েছিল কাকগুলো মানুষের তুলনায় স্বাধীন।
ঠিক ওইরকম একটা সময় পিচ্চি পিচ্চি মানুষের বাচ্চাগুলো প্রতিবাদ করেছিল। ছোটবেলায় অবশ্য শুনেছিল এরাই সবসময় সবার আগে প্রতিবাদটা করে। আর মানুষের মধ্যে এরাই সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ।
একসময় শহরে কিছুটা হলেও বিশুদ্ধ বাতাস ছিল। গাছ ছিল, খেলার মাঠ ছিল।
খোলা জায়গা ছিল। এখন সেসব খুব কম। দেখাই যায় না বলতে গেলে। মাঠগুলো সব বাড়ি হয়ে যাচ্ছে। গাছগুলো সব ল্যমপোস্ট।
খোলা জায়গা আর খোলা আকাশের জায়গা নিয়েছে বারান্দার গ্রিল। মানুষগুলো সব চড়ুই পাখির মত জীবন যাপন করে। সাজায়-গোছায়, থাকে কিন্তু মালিকানা দাবী করতে পারে না। যে যেভাবে পারছে সেভাবেই এক টুকরো থাকার জায়গা করে নিচ্ছে। কি বস্তি আর কি আবাসিক এলাকা কোন তফাত নেই।
তফাত কেবল বাড়ি-ঘরের উপকরণের। এক ফোঁটা সবুজ নেই, গরমে হাঁস-ফাঁস করে মানুষ, কাক আর কুকুর। প্রচণ্ড গরমে এক ফোটা পানির জন্যে শহরের এ-মাথা ও-মাথা এক করে ফেললেও পানি পাওয়া দুস্কর। এ অবস্থায় ঘুড়ে বেড়াতে কষ্টই হয় ওর।
তবুও গ্রীষ্মের এই তাপে বুড়ো কাক ঘুড়ে বেড়ায়।
দেখে মানুষগুলোর কাজ-কারবার। মনে মনে কষ্ট পায়, যদিও জানে কষ্ট পাবার কোন কারণ বা প্রয়োজন তার নেই। তারপরও “সামাজিক জীব” হিসেবে তারও তো কিছুটা দায় আছে। আর তাছাড়া সমাজের প্রতি তার কিছু অনুভূতিও জন্মেছে। নিয়মিত ক্যাম্পাস এলাকাগুলোতে ঘোরার সুবাদে অনেক কিছুই সে শিখেছে, অনেক কিছুই সে বুঝেছে।
সে জানে এবং বিশ্বাস করে এই মানুষগুলো এত সমস্যার ভিড়েও একসময় জেগে উঠবে।
ছোটবেলায় একটা গল্প সে প্রায় শুনতো ভস্ম থেকে পূণর্জন্ম নেয়া ফিনিক্স পাখির গল্পটা। মানুষের এত সমস্যার মাঝেও বুড়ো কাক মানুষকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। গোধূলী লগ্নে কোন এক গাছের ডালে বসে অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে সেও আশাবাদী হয় কোন এক সময় নিশ্চয়ই মানুষগুলো জেগে উঠবে ফিনিক্স পাখির মত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।