মানুষের জীবনে কিছু একান্ত বিষয় আছে যা আর কারো সাথে শেয়ার করা দূরের কথা, তার নিজের জীবনে কি তাৎপর্য বহন করে বা কতোখানি গুরুত্বপূর্ণ সে নিজেও অনুধাবন করতে পারেনা।
আটপৌঢ়ে জীবনের অংশ হয়ে উঠা এমন কিছু ব্যাপার যা আসলে জীবনের পরম সম্পদ! এই সম্পদের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা অনেকে উদাসীন, কেউ বা অবগত নই আবার কেউ স্বীকার করতে চাইনা। অবহেলায় এড়িয়ে যায়...
প্রাত্যহিক জীবনের একান্ত সঙ্গী হয়ে ওঠা এমন কিছু আমার জীবনেও আছে। পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্যান্য বই পড়া, গান শোনা। খুব সহজ ভাষায় বলা সাধারণ একটি কথা, যার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবনে আমিও হয়তো খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অপরাগ ছিলাম।
আমার দৈনন্দিন জীবনে মিশে থাকা এমন একটি বই “যে জলে আগুন জ্বলে”।
নামের মাঝেই রহস্য, অন্যরকম মাধুর্য আর মাদকতা।
নামটা শুনলে গভীরবোধ সম্পন্ন কারো অস্তিত্ব অনুভূত হয়!
সাধারন বই পাঠ যতো আনন্দময় হোক, পড়াশুনার ব্যাপারটা আমার মতো অনেকের জন্যই ক্লান্তিকর হয়ে উঠে সময়ে সময়ে। সারাবছর পড়াশুনায় অবহেলা যারা করে, পরীক্ষার আগে তাদের আরো কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়.... প্রস্তুতি গ্রহনের পরীক্ষা।
প্রফেশনাল পরীক্ষা এগিয়ে এলে মোটা মোটা সব বইয়ের খুঁটিনাটগিুলোও খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতো.. একটি শব্দ, একট দাঁড়ি-কমা, সেমকিোলনও যে কোন কিছুর অর্থ ও গুরত্ব বদলে দিতে পারে, সেসময় তা বড় সুক্ষভাবে অনুভূত হয়... এই অনুভূতি, মনযোগ আর ব্যস্ততার সাথে বোনাস হিসেবে পাওয়া যেতো এক কালো মেঘ, যার নাম “স্ট্রেস”!!!
ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক এই স্ট্রেস.... এর কাছ থেকে অব্যহতি পেতে একেক জনেক একেক প্রচেষ্টা.. কেউ বাইরে হাঁটতে যায়, কেউ টিভি দেখে, গান শুনে, কেউ ইয়োগা বা যোগব্যায়ামের চিরন্তন ফর্মূলা চেষ্টা করে দেখে আর কেউ বা ঘুমের দেশে স্বপ্ন রাজ্যে বিচরণ করতে যেয়ে পরীক্ষাসংক্রান্ত দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে জেগে উঠে...
মেডিকেল কলেজের ভয়াবহ সব পড়াশুনায় চোখ মুখ ডুবিয়ে পড়াকালীন সেসময় আমার স্ট্রেস রিলিভার ছিলো প্রিয় কাব্যগ্রন্থ “যে জলে আগুন জ্বলে”।
খুব দুর্বোধ্য কোন চ্যাপ্টার, কোন দুর্বোথ্য কম্পোজিশন, প্যাথোফিজিওলজি, প্রসেডিউর আয়ত্ত্বে আনার পর সেলিব্রেশন হতো শেল্ফ থেকে আনমনে হাতে নেয়া বইটির পাতা উল্টে.. একেক কবিতা একেকটি ম্যাজিক!!!!
কবি হেলাল হাফিজ সেই ম্যাজিকের ম্যাজিশিয়ান! তাঁর শব্দের যাদু স্পর্শে নিমেষে উবে যেতো যতো ক্লান্তি। ঝরঝরে মন নিয়ে আবার ফিরে যেতাম পরবর্তী যুদ্ধে, অর্থাৎ আরো দুর্বোধ্য কোন পড়া মগজে গেঁথে নিতে।
“কবির জীবন খেয়ে জীবন ধারণ করে
কবিতা এমন এক পিতৃঘাতী শব্দের শরীর,
কবি তবু সযত্নে কবিতাকে লালন করেন,
যেমন যত্নে রাখে তীর
জেনে-শুনে সব জল ভয়াল নদীর।
সর্বভূক এ কবিতা কবির প্রভাত খায়
দুপুর সন্ধ্যা খায়, অবশেষে
নিশীথে তাকায় যেন বয়ঃসন্ধিকালের কিশোরী,
কবিকে মাতাল করে
শুরু হয় চারু তোলপাড়,
যেন এক নির্জন বনের কোনো হরিণের লন্ডভন্ড খেলা
নিজেরই ভিতরে নিয়ে সুবাসের শুদ্ধ কস্তুরী।
কবির কষ্ট দিয়ে কবিতা পুষ্ট হয়
উজ্জ্বলতা বাড়ায় বিবেক,
মানুষের নামে বাড়ে কবিতার পরমায়ু
অমরতা উভয়ের অনুগত হয়।
”
হেলাল হাফিজ আমার কাছে জলের আগুনে মিশে থাকা একজন.. কখনও মনে হয়নি কষ্টের এই ফেরিওয়ালা দেখতে কেমন! তিনি আমার কাছে দুপংক্তির শব্দাক্ষরের মাঝে বন্দী এক অদ্ভুত ভালোলাগা.
মনে হয়নি যৌবনদীপ্ত তারুণ্যকে তাদের সময়ে শ্রেষ্ঠ.ব্যবহার মনে করিয়ে দেয়া কবির বয়স কতো হতে পারে!!
কবিতার পংক্তিমালার সাথে মিশে আছেন হেলাল হাফিজ। কবিকে কখনও আলাদা করে মনে পড়েনি, মনে হয়েছে তাঁর কবিতাই হয়তো মূখ্য.. এই ভীষণ বড় ভ্রান্তি দূর হয়, বলা যায় এই ভ্রান্ত ধারনা সম্পর্কে অবগত হই যেদিন এই সাইটে হঠাৎ তাঁর নাম চোখে পড়ে!! বেশ কয়েক বছরর আগ কেউ একজন পোস্ট দিয়েছিলনে যার শিরোনাম ছিলো, হেলাল হাফিজের কবিতা অথবা যে জলে আগুন জ্বলে উল্লেখ করে। চোখে পড়তেই চমকে উঠি!!! এতো আমার একান্ত কবিতার বই, আমার অতি আপন কেউ... মন ভালো হয়ে যায় শিরোনামে তাঁর নাম দেখে...
বুঝতে পারি হৃদয়ছোঁয়া অথচ আটপৌঢ়ে পংক্তিমালার মতো কবিতার সাথে একাকার হয়ে খুব সন্তপর্নে কবি আমাদের মগজে ও ভাবনায় স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন!!
কখনও না দেখা এই কবি সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারনাও মনে গেঁথে আছে, যা তাঁর কবিতার মতোই সহজ সুন্দর. কোমল অথচ দৃঢ়। বুঝতে পারি জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে প্রচারে তাঁর বড্ড অনীহা! ঘনঘন মিডিয়ায় চেহারা দেখিয়ে খ্যাতি ও আধিপত্য বিস্তারে তাঁর আগ্রহ নেই। তিনি কাউকে গভীর ভাবে ভালোবেসেছিলেন, যে ভালোবাসা থেকে জন্ম হয়েছিলো লাল নীল হরেক রকমের কষ্টের, সেই কষ্ট আর ভালোবাসাকে পুঁজি করে বেঁচে আছেন তিনি।
সস্তা প্রচার আর ঢাক ঢোল পিটিয়ে কাব্যগ্রন্থের কাটতির প্রয়োজন নেই তাঁর! আত্মপ্রচার বিমূখ, নির্লোভ একজন সুন্দর মনের মানুষ তিনি।
যিনি হাতগুটিয়ে বসে থেকেও নিজের অজান্তেই ছুঁয়েছেন আকাশ.....
আজও কোথাও কখনও খুব হৃদয়ছোঁয়া পংক্তিমালা চোখে পড়লে, হঠাৎ কোন কবিতার লাইন গভীর ভালোলাগায় ভরিয়ে দিলে নিমেষেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে.. কারণ কবিতার নাম উল্লেখ না থাকলেও বুঝতে পারি এটা হেলাল হাফিজের কবিতা.. জ্বলন্ত আগুনে ভরা জল কেউ আঁজলা ভরে তুলে এনেছেন!
“ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো
ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে
শান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো।
........
ইচ্ছে ছিল রাজা হবো
তোমাকে সাম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,
আজ দেখি রাজ্য আছে
রাজা আছে
ইচ্ছে আছে,
শুধু তুমি অন্য ঘরে। ”
ছোট্ট ছোট্ট কিছু শব্দমালা, অল্পকিছু কথায় এভাবে হৃদয়ের কোমল দ্বার কড়া নাড়তে পারে কেবল এই একজন কবির কবিতা। স্নিগ্ধতা, নিমর্লতা আর গভীর ভালোলাগার আবেশে মন ছুঁয়ে যেতে পারে কেবল কবি হেলাল হাফিজের পংক্তিমালা!
"এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিয়ো৷
এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালী তাল পাখাটা
খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো৷
ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত
ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিয়ো৷
কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে
কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে
পত্র দিয়ো, পত্র দিয়ো৷
আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেয়ো, আপত্তি নেই৷
গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কী তাতে?
আমি না হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি,
নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরের নির্জনতা খুন করেছি, কী আসে যায়?
এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে,
এক মানবী কতোটা আর কষ্ট দেবে!"
আপনি কেমন আছেন প্রিয় কবি?
মহান সৃষ্টি কর্তা যেন আপনাকে সুস্থ, সুন্দর, সুখি ও শান্তিপূর্ণ দীর্ঘ জীবন দান করেন এই প্রার্থনা।
***প্রায় তিনমাস আগে ব্লগে প্রিয়কবিকে নিয়ে লেখা একটি পোস্ট পড়ে এটা লিখেছিলাম। তারপর খোঁজ পেলাম এই জীবিত কিংবদন্তীরর। সৌভাগ্যক্রমে অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী বন্ধুর মাধ্যমে সম্প্রতি ভীষণ প্রচারবিমূখ, নিভৃতচারী প্রিয়কবির খোঁজ জানতে পারি। মহান স্রষ্টার কৃপায় কবি হেলাল হাফিজ ভালো আছেন, আর.. আজ তাঁর জন্মদিন!!!!!***
শুভ জন্মদিন প্রিয় কবি। :-)
যাঁর জন্মদিন তাঁকে উপহার দেবার নিয়ম, আমি আপনার জন্মদিনে আপনার ভক্তকূলকে উপহার দিতে চাই একটি সংবাদ.. “কবি হেলাল হাফিজ” এর নতুন বই শীঘ্রই প্রকাশ পাবে :-)প্রার্থনা করি , নতুন বইটির জনপ্রিয়তা যেনো “যে জলে আগুন জলে”র আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাকেও ছাড়িয়ে যায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।