[লেখাটি কালের কন্ঠের রাজনৈতিক ম্যাগাজিন রাজকূট-এ প্রকাশিত হল আজ]
ভারতের অযোধ্যার মাত্র ২.৭৭ একরের একখণ্ড জমি এবং তার ওপর নির্মিত বিখ্যাত বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে গত ১৫০ বছর ধরে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে যে রক্তক্ষয়ী বিরোধ চলছিল গত ৩১ সেপ্টেম্বর সে বিষয়ে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন ভারতের হাইকোর্ট। দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে চলা এ মামলার রায়ে মালিকানার দাবিদার তিন পক্ষকেই সমানভাগে বিতর্কিত জমিটি বণ্টন করে দিয়েছেন এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি এস ইউ খান, বিচারপতি সুধীর অগরওয়াল ও ধরম বীর শর্মাকে নিয়ে গঠিত লক্ষ্নৌ বেঞ্চ। আদালতের রায়ও যুগ যুগ ধরে চলা এই বিরোধের সমাধান দিতে পারেনি। ফলে রায় ঘোষণার পরও থেমে নেই বিতর্ক। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস এই রায় মেনে নিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্যে হিন্দু-মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
বিরোধী দল বিজেপিও স্বাগত জানিয়েছে এই রায়কে। তবে ভারতীয় গণতন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একটি কাল্পনিক ধর্মীয় মিথলজির ওপর ভর করে দিনে দুপুরে ৫০০ বছরের একটি মসজিদকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার এমন সাদামাটা রায় মেনে নিতে পারেননি মুসলমানরা। হিন্দুরাও দেবতা রামের জন্মস্থান হিসেবে দাবিকৃত স্থানটির মালিকানার ভাগ মুসলমানদের দিতে নারাজ। এ অবস্থায় দুটি পক্ষই হাইকোর্টে আপিল করার ঘোষণা দিয়েছে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের উগ্রবাদী হিন্দুরা সাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে প্রশাসনের সামনেই ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদটি ভেঙে ফেলে।
তাদের দাবি, বাবরি মসজিদের স্থানটি রামের জন্মস্থান এবং মসজিদটি নির্মাণের আগে সেখানে রামমন্দির ছিল। ১৫২৮ সালে বাবর সেটি ভেঙে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। এই ঘটনার কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ বা যুক্তি না থাকলেও সাম্প্রদায়িকতার যে নগ্ন আঁচড় বাবরি মসজিদের ওপর পড়েছিল তা সমগ্র ভারত, এমনকি বাংলাদেশেও ছড়াতে সময় লাগেনি। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শুধু ভারতেই প্রায় দুই হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, যার অধিকাংশই ছিল মুসলমান।
বিতর্কের প্রেক্ষাপট
বাবরি মসজিদটি নির্মিত হয় ১৫২৭ সালে মোগল বাদশাহ বাবরের শাসনামলে।
সেই থেকে মুসলমানরা মসজিদটিতে নামাজ আদায় করত। কিন্তু হিন্দুরা এলাকাটিকে তাদের দেবতা রামের জন্মস্থান এবং রামমন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ নির্মিত হয়েছে বলে অভিযোগ করতে থাকে। তথ্য বলে, মসজিদ চত্বরে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ সেই ১৮৫৩ সাল থেকেই। ১৮৫৭ সালে হিন্দু-মুসলিম একত্রিত হয়ে সিপাহী বিদ্রোহ করলে ব্রিটিশরা তাদের ক্ষমতার স্থায়িত্ব নিয়ে শংকিত হয়ে পড়ে। সে সময়ে 'ভাগ কর শাসন কর' নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ব্রিটিশ সরকার ধর্মীয় এ ইস্যুটিকে কাজে লাগায়।
সিপাহী বিদ্রোহের দুই বছর পর পর্দা দিয়ে আলাদা করা হয় হিন্দু ও মুসলমানদের প্রার্থনাস্থল। এরপর ১৮৮৫ সালে রামচতুরায় পূজাপাঠ ও মন্দির গড়তে চেয়ে আদালতে মামলা করেন মোহান্ত রঘুবর দাস। আদালত সে আবেদনে সাড়া দেয়নি। পরের বছর পুনরায় চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তিনি। এরপর দীর্ঘ দিন কেটে গেলেও মসজিদ আর মন্দিরের বিরোধটি বড় আকার ধারণ করেনি।
১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয় আসল ঘটনা। কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাতের অন্ধকারে তালা ভেঙে মসজিদের ভেতর রামের মূর্তি স্থাপন করে এবং আদালতে স্থানটি তাদের উপাসনার জন্যে খুলে দেওয়ার দাবি করে। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ছিলেন বিচক্ষণ। তিনি জানতেন, এই উটকো ধার্মিকদের পাত্তা দিলে বিপদ হতে পারে। ফলে তিনি ফৈজাবাদের কালেক্টরকে জায়গাটায় তালা ঝুলিয়ে দিতে বললেন।
হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই উপাসনার পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। দীর্ঘদিন তালা ঝুলে থাকায় সবাই একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিল বাবরি মসজিদের কথা। বাবরি মসজিদ প্রসঙ্গে রাজীব গান্ধী অবশ্য দাদুর মতো ততটা বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারেননি। শাহবানু মামলায় মুসলিম মৌলবাদীদের তোষামোদ করায় কংগ্রেসের ওপর অসন্তুষ্ট ছিল হিন্দুরা। ফলে ১৯৮৬ সালে তাদের মন গলাতে রাজীব মসজিদের তালা খুলে পূজা ও ধর্মীয় আচারের অনুমতি দেন।
বিস্মৃত প্রায় বিতর্কটিকে পুনরায় জাগিয়ে তোলেন তিনি। অভিজ্ঞতার অভাবেই আধুনিক ভারতের সবচেয়ে কলঙ্কময় নর্দমার জলকে রাজীব নিজেই নিয়ে এলেন খাল কেটে। ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতেও সময় লাগেনি। ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে মাত্র দুটি আসন পাওয়া বিজেপি ১৯৮৯-তে পেল ৯০টি। বাঘের পিঠে চাপতে গিয়ে বাঘেই তাঁকে খেল।
তিনি গদিচ্যুত হলেন। ১৯৮৯ সালে লালকৃষ্ণ আদভানির নেতৃত্বে বিতর্কিত স্থানে রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হলে উত্তেজনা বেড়ে যায়। সেসময় বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির পুনঃস্থাপনের আন্দোলন জোরদার করেন আদভানি। উত্তর প্রদেশে কল্যাণ সিং ক্ষমতায় এলে বাবরি মসজিদ ভাঙার পথ সুগম হয়ে যায়। ১৯৯২ সালে কট্টর হিন্দুবাদী সংগঠন ভারতীয় হিন্দু পরিষদ এবং আরএসএসের নেতৃত্বে প্রায় দেড় লাখ উগ্র হিন্দু কর সেবকরা যখন ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদে নির্দয় হাতুড়ি পেটা করছে, কল্যাণের পুলিশ তখন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।
এই ঘটনায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গেলে সরকার মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিতর্কিত জমিটি অধিগ্রহণ করে নেয়।
রামের জন্মস্থান এবং রামমন্দিরের অস্বিত্ব
মহাভারতে রামের জন্মস্থান হিসেবে অযোধ্যার কথা বলা হয়েছে। এটি কেবল বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তথ্যের ওপর নয়। হিন্দুদের দাবি, ১৫২৭ সালে বাবর আফগান থেকে এসে চিত্তগড়ের রাজপুত রানা সংগ্রাম সিংকে পরাজিত করেন এবং অযোধ্যার পবিত্র ভূমিতে মন্দির ভেঙে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। কিন্তু এই দাবির পক্ষে জোরালো কোনো যুক্তি নেই।
বাবরনামায়ও মসজিদটির উল্লেখ নেই। ফলে বাবরি মসজিদ নির্মাণ ইতিহাস রহস্যঘেরা। ৩১ সেপ্টেম্বরের রায়েও বিচারকরা সেটি স্বীকার করেছেন। হিন্দুদের এই দাবির পিছনে মসজিদটির নাম একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। বাবরি মসজিদ হিসেবে অধিক পরিচিতি পেলেও মসজিদটির আসল নাম মসজিদ-ই-জন্মস্থান।
৫০০ বছরের এই নাম হঠাৎ করেই ১৯৪০'র দশকে বদলে যায়। কিভাবে, কেন এই নাম বদল তা আর কোথাও লেখা নেই। যেহেতু মসজিদটির নামের সঙ্গেই জন্মস্থানের কথাটি রয়েছে সেহেতু হিন্দুরা এটিকে রামের ঐতিহাসিক জন্মকেই নির্দেশ করে আন্দোলন শুরু করে। স্থাপত্যটির নাম যে মসজিদ-ই-জন্মস্থান ছিল, তাতেও কিন্তু প্রমাণ হয় না যে সত্যি সত্যি রাম বলে কেউ ছিলেন, ওখানেই জন্মেছিলেন এবং তাঁর জন্মভূমির মন্দির ভেঙেই মসজিদ হয়েছে। এই নাম কেবল এতটুকুই প্রমাণ করে যে রামের জন্ম বিষয়ে একটা বিশ্বাস এই ভূমির সঙ্গে জড়িত ছিল, যে ভূমিটির ওপর মসজিদ হয়েছে।
এই বিতর্ক নিরসনে হাইকোর্ট পুরাতাত্তি্বক খননের জন্যে একটি বিষেশজ্ঞ দল নিয়োগ দেন। প্রমাণ মেলে, স্থানটি জুড়েই ছিল একটি বিরাট মন্দির। বিশেষজ্ঞদের প্রত্নতাত্তি্বক পর্যবেক্ষণে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার হয়। খ্রিস্টপূর্ব হাজার সাল থেকেই স্থানটিতে নানান মন্দির ছিল। কিন্তু কোনোটাই রাম মন্দির নয়, ছিল বিষ্ণু-শিব ইত্যাদি জনপ্রিয় হিন্দু দেব-দেবীর মন্দির।
তবে একটি বিষয় অপরিষ্কার থেকে যায়। মন্দির ভেঙেই মসজিদ হয়েছে, না ধ্বংসাবশেষের ওপর মসজিদ হয়েছে এই বিষয়ে কোনো প্রামাণ্য ইতিহাস পাওয়া যায় না। এ বিষয়টিতে বিচারকদের সাম্প্রতিক রায় দেখে অবাক হতে হয়। বিচারক এস ইউ খান লিখেছেন, মন্দির ভেঙে মসজিদ হয়নি। অপর দুই বিচারক সুধীর অগরওয়াল ও ধরম বীর শর্মা লিখেছেন, প্রমাণাদি ঘেঁটে তাঁরা নিশ্চিত_মন্দির ভেঙেই মসজিদ হয়েছে।
বিচারকরাই যখন সাম্প্রদায়িকতার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারেননি, সেখানে সাধারণ মানুষের আর দোষ কোথায়! রাম মন্দিরের অস্তিত্ব বিশ্বাসের ভিতে দণ্ডায়মান। সে বিশ্বাসকে আদালতের রায় কিংবা সার্ভের রিপোর্ট দিয়ে পাল্টানো মুশকিল। গল্পের ভেতরেও তো গল্প থাকে, বিশ্বাসের ভেতরে বিশ্বাস। অবশ্যই ইতিহাসের পেছনেও ইতিহাস থাকে। মাটির ভেতরে যে ধ্বংসাবশেষকে রামমন্দির হিসেবে দাবি করা হচ্ছে, সেটা যে আরো কিছু ভেঙে তৈরি হয়নি, তার কোনো প্রমাণ আছে? বিশ্বাস তো ভিন্ন কথাও বলে।
বলে যে, সাকেত নামে বিখ্যাত বৌদ্ধবিহার ছিল ঠিক একই জায়গাতে, যা ভেঙে রামের ভক্তরা মন্দির বানিয়েছিলেন। মাটির নিচে সার্ভে করে সে বিহারেরও যদি হদিস পাওয়া যায়, কিংবা না পাওয়া গেলেও বিশ্বাসটা যদি থেকেই যায়, কী হবে তখন? অপরদিকে যদি ধরেও নেওয়া হয়, বাবর মন্দির ভেঙেই মসজিদটি নির্মাণ করেছেন তাহলে প্রেক্ষাপটটিকে বিবেচনায় আনতে হবে। ৫০০ বছর আগের সমাজব্যবস্থা ছিল 'জোর যার মুল্লুক তার'। তখন আন্তর্জাতিক কোনো আইন কিংবা বাধ্যবাধকতা ছিল না। কিন্তু ১৯৯২ সালে যখন যুক্তি-প্রমাণ ছাড়াই শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে মসজিদটি ভেঙে ফেলা হয় তখন ভারতে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ছিল, আন্তর্জাতিক আইনও ছিল।
সবকিছুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ৫০০ বছর আগের সমাজব্যবস্থাকেই ফিরিয়ে এনেছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো।
কচ্ছপ গতির তদন্ত কমিটি
বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনার ১০ দিন পর, ১৯৯২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন ভারত সরকার এই ঘটনার তদন্তের জন্যে গঠন করে লিবারহান কমিশন। প্রকৃত ঘটনা ও দোষীদের খুঁজে বের করতে এই কমিশন দীর্ঘ সতের বছর ধরে তদন্ত করেছে। শুরু থেকেই কমিশন ঘিরে যে বিতর্ক ও সন্দেহ মুসলমানদের মধ্যে বিরাজ করছিল, সেটিরই বাস্তবায়ন ঘটেছে কমিশনের দীর্ঘসূত্রতার ঘটনায়। সতের বছরে কমিশন ৪৮ বার বর্ধিত সময়ের আবেদন করেছে।
এই দীর্ঘসূত্রতায় প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ভারতজুড়ে। কমিশনের এমন নয়-ছয়ে অভিযোগ উঠেছিল, সরকার ইচ্ছা করেই সময় ক্ষেপণ করছে। বাছাই করা লোকজনকে তদন্ত থেকে রেহাই দেওয়ার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে সরকারের বিরুদ্ধে। অবশেষে গত বছরের ৩০ জুন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের নিকট তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয় আলোচিত লিবারহান কমিশন। এক হাজার পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্টে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে।
দেখা যায়, আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, ভারতীয় জনতা পার্টির সমন্বয়ে গঠিত সংঘ পরিবারের পাশাপাশি সে সময়ের ভারত সরকারের অনেক উচ্চপদস্থ সদস্য এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতারা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় জড়িত ছিলেন। কর সেবক নামক একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনের ব্যানারে বিজেপি নেতা এল কে আদভানি, বিনয় কাটিয়া, মুরালি মনোহর যোশী, বিজয় রাজ সিন্ধিয়াসহ ৬৮ জন বাবরি মসজিদের ধ্বংসযজ্ঞে প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। রিপোর্টে উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংয়ের ভূমিকারও তীব্র সমালোচনা করা হয়। রিপোর্ট বলা হয়, বাজপেয়ি সরকারের শতভাগ সমর্থন নিয়েই বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছে। রিপোর্টের অংশবিশেষ মিডিয়ায় প্রকাশ পেলেও পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টটি এখনো প্রকাশ করেনি ভারত সরকার।
আদালতের রায়
ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে যে বিরোধ তার নিষ্পত্তি কোনো আদালতের পক্ষেই করা সম্ভব নয়। এই প্রসঙ্গে ১৯৯২-এর ঘটনার পর বাবরি মসজিদ অঞ্চল আদালতের এখতিয়ারে চলে এলে সুপ্রিম কোর্ট সেই অধিগ্রহণ সমর্থন করে যে রায় দেয়, সেই রায়ের বক্তব্য তুলে দেওয়া যায়। রায়ে বলা হয়, 'আদালত কেবল বিরোধের মীমাংসা করতে পারে; কিন্তু সমস্যার সমাধান করতে পারে না। জাতীয় স্বার্থেই এই বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত রায় দেওয়া অসঙ্গত, কেননা আদালতের রায় তৈরি করে জয়ী আর পরাজিত পক্ষ। অথচ এক্ষেত্রে কোনো পক্ষকেই পরাজিত বোধ করতে দেওয়া সঙ্গত নয়।
জাতীয় স্বার্থে তাই প্রয়োজন, মামলার রায় নয়, দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা, যেখানে কোনো পক্ষই পরাজিত বোধ করবে না। কারো মধ্যেই তত তিক্ততা থাকবে না। ' বাবরি মসজিদের জমির মালিকানা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে করা নির্মোহী আখড়া, অখিল ভারত হিন্দু মহাসভা ও সুনি্ন ওয়াকফ বোর্ডের আবেদনের প্রেক্ষিতে দীর্ঘ ৬০ বছরের অধিক কালের মামলার যে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট তাতে ওপরের কথাগুলোরই প্রতিফলন ঘটেছে। তথ্য-প্রমাণ ঘেঁটে সিদ্ধান্তে পেঁৗছানোর চাইতে আদালত চেষ্টা করেছে উভয় পক্ষকেই সন্তুষ্ট রাখতে। ফলে ২.৭৭ একর জমির তিনটি ভাগ করে তিন পক্ষকে প্রদান করা হয়েছে।
এক হাজার ৪০০ পৃষ্ঠার রায়ের সারাংশ লেখা হয়েছে ১২৫ পৃষ্ঠায়। রায়ে সবচেয়ে আলোচিত যে বিষয়টি ছিল এবং যে পয়েন্টে এত বিতর্ক, এত প্রাণহানি, সেই রামের জন্মস্থান সম্পর্কে বিচারক ধরম বীর শর্মা বিস্ময়কর কথা লিখেছেন! তিনি লিখেছেন, ' The disputed site is the birth place of Lord Ram. Place of birth is a juristic person and is a deity. It is personified as the spirit of divine worshipped as birth place of Lord Ram as a child. Sprite of divine ever remains present every where at all times for aû one to invoke at aû shape or from in accordance with his own aspirations and it can be shapeless and formless also.' কথাগুলো পরিষ্কার করতে একটা উদাহরণ দিচ্ছি। মনে করুন, স্পাইডারম্যান ফ্যান ক্লাব দাবি করল ম্যানহাটনের ওমুক স্ট্রিটে ৩৪৫ নম্বর বাড়িটাতে স্পাইডারম্যানের জন্ম। তাহলে বিচারপতি শর্মার রায়টা দাঁড়ায় এ রকম_ 'এই দাবি না মানার কোনো কারণ নেই। কারণ স্পাইডারম্যান সর্বভূতে বিরাজমান এবং বিশ্বাসীরা যদি সেই বাড়িটিকেই বিশ্বাস করে, তাহলে সেটিই সত্য!'
ব্লগ থেকে
ঐতিহাসিক এ রায়ের পর যখন চারদিকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তখন ভারতীয় ব্লগ লোটা কম্বলে বঙপেন ছদ্মনামে এক ব্লগার লিখেছে, '১৫২৮ সালে কে, কি করে গেছে তাতে আমার, ধোনির, মনমোহন সিংয়ের, বিনি বৌদির, বোচাদা'র বা দেশের জিডিপি'র কিছু এসে যায় না, কিন্তু ১৯৯২ সালে যে রাজনৈতিক শয়তানি-কাম-গুণ্ডামি গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরেছিল, তাতে আমাদের এসে যায়, ভীষণভাবে এসে যায়; কমনওয়েলথ গেমস ভিলেজের নোংরা বাথরুমের থেকেও বেশি এসে যায়।
' হিন্দুদের দাবি ও আদালতের রায়কে ব্যঙ্গ করে তিনি আরো লিখেছেন, 'তবে এই লজিক খাটিয়ে শ্রীলঙ্কার এক-তৃতীয়াংশের দাবি জানিয়ে রাখলাম, ভুললে চলবে না, রাম লাল্লা কিন্তু সম্পূর্ণ লঙ্কা জয় করেছিলেন রাবণের মুণ্ডু চটকে। বিভীষণকে রাজ্য ফেরত দেওয়া তো চ্যারিটি মাত্র। অতএব লঙ্কার এক-তৃতীয়াংশ এবং মুত্তিয়া মুরালি ধরনের ২৬৭ (১/৩ অংশ) উইকেট আমাদের প্রাপ্য, ব্যাস!'
শেষ কোথায়
রামের জন্মস্থান মিথলজির ওপর দাঁড়িয়ে গত শতকে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা আমাদের উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্যে হতাশার। এ পর্যন্ত এ বিরোধে জড়িয়ে প্রাণ হারিয়েছে সাড়ে চার হাজারেরও বেশি মানুষ। এ বিরোধের পেছনে বড় ধরনের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের গন্ধ পাওয়া যায়।
ব্রিটিশরা এই বিরোধ উসকে দিয়েছিল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে। এরশাদের স্বৈরাচারী সরকারও রাজনৈতিক স্বার্থে বাবরি মসজিদ ভাঙার মিথ্যে গুজব ছড়িয়ে দাঙা বাঁধিয়ে দিয়েছিল, হত্যা করেছে শত শত নিরীহ হিন্দুকে। একই কাজ করেছে বিজেপি। স্থানীয় সাধুদের হাতে রাখতেই নির্দ্বিধায় হুকুম দিয়েছিল বাবরি মসজিদ ভাঙার। আবার ধর্মীয় রাজনীতির স্বার্থেই ১৫০০ শতকের বিরোধের জের টানতে হয় একবিংশ শতাব্দীতেও! এই ঘটনার রায়েও রাজনৈতিক ভোটের স্বার্থ ও ধর্মীয় রাজনীতির জয় হয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।