অজানাকে জানতে ছুটছি অবিরাম...!
অল্পদর্শী
দেড় যুগ পেরিয়ে গেছে, ভারতের অযোধ্যায় নির্মিত ষোড়শ শতকের ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে ফেলেছে ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ওই ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনায় ভারতে হিন্দু-মুসলিম জাতিগত দাঙ্গায় নিহত হয় দুই হাজারের বেশি লোক, যাদের বেশিরভাগই ছিল মুসলিম। তবে মসজিদ নিয়ে মূল বিতর্ক তথা আইন-আদালত শুরু হয় ৬০ বছর আগে, ১৯৫০ সালে। বিতর্কÑ বাবরি মসজিদের ২.৭ একর জমি কাদের? বাবরি মসজিদ নির্মাণের আগে; অর্থাৎ ১৫৩৮ সালের আগে জায়গাটিতে কি রাম মন্দির ছিল? ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর মসজিদের ভেতরে রামের মূর্তি এল কোত্থেকে, আগেই ছিল নাকি রাতের আঁধারে এনে বসানো হয়েছে? দীর্ঘ ৬০ বছর পর ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ মামলার রায় হলো বৃহস্পতিবার। রায় যাই হোক, এবার ঘেঁটে দেখা যাক বাবরি মসজিদ বিতর্কের ইতিহাস।
বাবরি মসজিদের জন্ম
১৫২৬ সালে পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে ভারতবর্ষে পা রাখেন প্রথম মুঘল সম্রাট জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর। আরো কিছু অঞ্চল জয় করে ১৫২৭ সালে মধ্য-ভারত থেকে উত্তর প্রদেশের অযোধ্যা অতিক্রমের সময় বাবর চিতোরগড়ের রানা সংগ্রাম সিংকে সিক্রিতে পরাস্ত করেন। অধিকৃত অঞ্চলে সেনাপতি মীর বাকিকে প্রশাসকের দায়িত্বে রেখে যান বাবর। সেনাপতি মীর বাকি ১৫৩৮ সালে অযোধ্যায় বাবরের নামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। সেটিই বাবরের মসজিদ বা বাবরি মসজিদ নামে পরিচিত।
তবে অনেকের মতে, বাবর নিজেই এ মসজিদ নির্মাণ করেন।
মুসলিম-হিন্দু-জৈন বিতর্ক
প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর বা তার প্রতিনিধি মীর বাকি; যেই মসজিদটি নির্মাণ করে থাকুন না কেন, মসজিদটির জন্মের সোয়া ৩০০ বছর পর উনিশ শতকের মাঝামাঝি জমিটি নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মতে, অযোধ্যার ওই স্থানটি তাদের দেবতা রামের জন্মভূমি। তাদের দাবি, মসজিদটি তৈরি করা হয়েছে রামমন্দির ভেঙে। তবে জায়গাটির দাবিদারদের মধ্যে রয়েছে হিন্দু, মুসলিম ছাড়াও জৈন সম্প্রদায় রয়েছে।
হিন্দুদের দাবি, ১৯৯২ সালে মসজিদটি ভাঙার পর সেখানে ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রাচীন মন্দিরের ২৬০টি উল্লেখযোগ্য নমুনা পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে পাথরের এক বিশাল খ-ে নাগরি লিপিতে সংস্কৃত ভাষায় লেখা ২০টি পঙক্তি এবং ৩০টি শ্লোক।
জৈনদের মতে, ১৮ শতকে তাদের পাঁচজন তীর্থঙ্কর এ স্থানে অবস্থান করেছিলেন। তাছাড়া ১৫২৭ সালের আগে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের পাঁচটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্রের মধ্যে অযোধ্যাও একটি।
আর মুসলিমদের মতে, বাবরি মসজিদ নিয়ে বিতর্ক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ইসলামবিদ্বেষী।
অর্থাৎ সবপক্ষই জায়গাটিকে নিজেদের ধর্মীয় স্থাপনা দাবি করে মসজিদটির জায়গা দখলে নিতে চেয়েছে বিভিন্ন সময়।
অসন্তোষ-দাঙ্গা-দখল
বাবরি মসজিদ নিয়ে উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই চলছে অসন্তোষ, দাঙ্গা ও মামলা। জমি নিয়ে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে প্রথম অসন্তোষ দেখা দেয় ১৮৫৩ সালে। হিন্দুদের একটি গ্রুপ মসজিদটিকে রামমন্দিরের ওপর নির্মিত বলে দাবি করে। দু’বছর শুধু এ নিয়েই দেন-দরবার চলতে থাকে।
১৮৫৭ সালে এ নিয়ে দেখা দেয় দাঙ্গা।
১৯০৫ সালের ফয়জাবাদ জেলা গেজেটে বলা হয়, ‘১৮৫৫ সাল থেকে হিন্দু ও মুসলিম উভয়েই স্থাপনাটি (মসজিদ) যার যার ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করছিল। কিন্তু ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর প্রশাসন মসজিদের সামনে একটি বেষ্টনী তৈরি করে এবং হিন্দুদের মসজিদের ভেতরের আঙিনায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। হিন্দুরা এতে মসজিদের বাইরের আঙিনায় একটি বেদী স্থাপন করে পূজা করে। ’ অর্থাৎ মসজিদের ভেতরের অংশ ব্যবহার করছিল মুসলিমরা আর বাইরের অংশ হিন্দুরা।
এরপর হিন্দুরা ১৮৮৩ সালে বাইরের অংশের বেদীতে মন্দির নির্মাণের উদ্যোগ নিলে ১৮৮৫ সালে প্রশাসন তা স্থগিত করে। পরের বছর দু’দফা মন্দির নির্মাণের অনুমতি চাওয়া হলেও জেলা আদালত তা খারিজ করে দেয়। এতে হিন্দুদের আইনগত লড়াই প্রায় ফুরিয়ে যায়। ১৯৩৪ সালে আরেক দফা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মসজিদটির চারপাশের দেয়াল ও একটি গম্বুজ ভেঙে ফেলা হয়। বৃটিশরা তা নির্মাণ করে।
পরে মসজিদ ও তৎসংলগ্ন কবরস্থানকে ওয়াকফ হিসেবে রেজিস্ট্রি করা হয়। ওই সময় মুসলিমদের ওপর চালানো নির্যাতন ১৯৪৯ সালে লিপিবদ্ধ করেন ওয়াকফ পরিদর্শক মোহাম্মদ ইব্রাহিম। তিনি জানান, ‘মসজিদে যাতায়াতকারী মুসল্লিদের নানাভাবে উত্ত্যক্ত করা হতো। ছুড়ে মারা হতো জুতা ও পাথর। মুসলিমরা প্রাণভয়ে টু শব্দটিও করত না।
এরপর ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর গভীর রাতে একদল হিন্দু সঙ্গোপনে রাম ও সীতার মূর্তি মসজিদের ভেতর প্রতিষ্ঠা করে। বলা হয়, মসজিদ প্রহরারত পুলিশ তখন ঘুমিয়ে ছিল। সকালে ৫-৬ হাজার হিন্দু বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে মসজিদে ঢুকতে গেলে পুলিশ তাদের কোনোমতে ঠেকাতে সক্ষম হয়। স্থায়ীভাবে মসজিদের গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। ’
চার দফা মামলা
গোপাল সিং বিশারদ : ১৯৫০ সালের ১৬ জানুয়ারি গোপাল সিং বিশারদ নামে এক ব্যক্তি প্রথম মামলা করেন।
তিনি মারা যাওয়ার পর মামলার বর্তমান বাদি তার ছেলে রাজেন্দ্র সিং। মামলার আর্জি ছিল, কোনো বাধাবিঘœ ছাড়াই ওই স্থাপনায় শুধু হিন্দুদের প্রবেশাধিকার থাকবে এবং ভেতরের রাম-সিতা মূর্তি কেউ অপসারণ করতে পারবে না এবং মসজিদের দরজা চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে।
নির্মোহি আখড়া : ১৯৫৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর মোহান্ত রঘুনাথ দাসের মাধ্যমে মামলা করে নির্মোহি আখড়া। রঘুনাথও বর্তমানে প্রয়াত। মামলার আর্জিতে বলা হয়, ওই জমির দায়দায়িত্ব উত্তরাধিকার সূত্রে নির্মোহি আখড়ার মোহান্ত রঘুনাথকে দেয়া হোক।
সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড : ১৯৬১ সালের ১৮ ডিসেম্বর উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কেন্দ্রীয় সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডে সেক্রেটারিসহ ১০ জন মামলা করেন। তারা আর্জিতে জানান, ওই স্থাপনা অবশ্যই মসজিদ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে এবং সংলগ্ন জমি থাকবে মুসলিমদের করবস্থান। আর মালিকানা দিতে হবে ওয়াকফ বোর্ডকে।
আগরওয়াল : এরপর ১৯৮৯ সালের ১ জুলাই দেবতা রামের পক্ষে এলাহাবাদ হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি দিওকি নন্দন আগরওয়াল মামলা করেন। তিনি দাবি জানান, জমি ও স্থাপনা দেবতা রামের।
সেখানে প্রবেশ ও হস্তক্ষেপ করতে ওয়াকফ বোর্ডের বিরুদ্ধে ‘ইনজাংশন’ জারি করা হোক। আর বাবরি মসজিদের কাঠামো ভেঙে ফেলা হোক।
বাবরি মসজিদ ধ্বংস
এদিকে ১৯৪৯ সালে মসিজদের ভেতরে রামের মূর্তির রাখার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওয়াহরলাল নেহরু মূর্তিগুলো সরানোর জন্য নির্দেশ দিলেও দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে তা অমান্য করেন। অন্যদিকে ১৯৮৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মসজিদের তালা খোলার জন্য জোর আন্দোলন শুরু করে। এরপর ১৯৮৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী খোলার নির্দেশ দেন।
এতে মসজিদটি সব হিন্দুর জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। এটি অনেকটাই মন্দিরে পরিণত হয়। এ ঘোষণার আগ পর্যন্ত সেখানে প্রতিষ্ঠিত মূর্তিগুলোর সামনে একজন পূজারী ব্রাহ্মণ কেবল একবার বার্ষিক পূজাপর্ব সম্পন্ন করতে পারতেন। ১৯৮৯ সালে সাধারণ নির্বাচনের আগে মসজিদের সামনে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুমতি দেয়া হলে জাতিগত বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। এর মধ্যেই বিজেপি নেতা এল কে আদভানি অযোধ্যার উদ্দেশে এক হাজার কিলোমিটার পথ ভ্রমণের এক রথযাত্রার উদ্বোধন করেন।
এরপর বিজেপি ও আরএসএস বা করসেবকদের নেতৃত্বে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ মসজিদ ভাঙা হয় ।
লিবারহান তদন্ত কমিশন
মসজিদটি ধ্বংসের ১০ দিন পর ১৬ ডিসেম্বর গঠিত লিবারহান কমিশন ১৬ বছর পর ২০০৯ সালের ৩০ জুন তার রিপোর্ট দেয়। গণমাধ্যমে নভেম্বরে ওই রিপোর্টের বিষয়বস্তু ফাঁস হয়ে যায়। এতে দেখা যায়, ঘটনার সঙ্গে তৎকালীন ভারতীয় সরকার ও প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা এবং কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা ঘনিষ্ঠভাবে ঘটনার সঙ্গে জড়িত। মসজিদ ভাঙার দিন বিজেপি নেতা এল কে আদভানি ও অন্যরা বিনয় কাতিয়ার বাসায় মিলিত হন।
সেখান থেকে তারা যান মসজিদ প্রাঙ্গণে স্থাপিত পূজা বেদীতে। আদভানি, মুরলি মনোহর যোশী ও কাতিয়া ২০ মিনিট ধরে ধ্বংসের প্রস্তুতি খতিয়ে দেখেন। পরে যোশী ও আদভানি ২০০ মিটার দূরে রাম কথাকুঞ্জে অবস্থান নেন। ওই কুঞ্জে একটি উঁচু বেদীও তৈরি করা হয় তাদের জন্য। করসেবকরা দুপুরে মসজিদ ভাঙতে গেলে কেউই তাদের বাধা দেয়নি।
এ সময় আদভানির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ অফিসার অঞ্জু গুপ্তা লিবারহান কমিশনকে জানান, আদভানি ও যোশীর বক্তব্য ছিল উত্তেজনাকর। রিপোর্টে বলা হয়, ‘রাম কথাকুঞ্জে ওই ঘটনার হোতারা অবস্থান করছিলেন। তারা চাইলে খুব সহজেই করসেবকদের নিবৃত্ত করতে পারতেন। ’ একইভাবে উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংও নানাভাবে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করেন। বিজেপি নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ীকেও দায়ী করা হয় ওই রিপোর্টে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।