এই ব্লগটি নোমান বিন আরমান'র দায়িত্বে প্রবর্তিত। এখানে মাঝেমধ্যে তিনি আসেন। numanbinarmanbd@gmail.com
নোমান বিন আরমান : সুযোগটি হাত ছাড়া করলো ভারত সরকার ও আদালত। একটি অপরাধের দায়মুক্তি যেখানে সম্ভব ছিলো সেটিকে তোয়াক্কা না করে অপরাধকেই প্রতিষ্ঠিত করলো রাম রাজ্যের দেশ। প্রমাণ হলো, ইনসাফ নয়, স্বার্থ আর ক্ষমতাটাই বড়।
বাবরি মসজিদ নিয়ে ভারতের এলাহাবাদ আদালতের রায়ে এমনটাই এখন স্পষ্ট। ‘বিচারে বাণী’ ক্ষমতার দাপটে সন্ত্রস্ত হলো দেশটির আদালতে। এই রায় আবারো দেখালো, জোর যা মুল্লুক তার। সাফ সাফ বলা চলে, বিচারের এমন নতজানুর কোনো দৃষ্টান্ত হয় না।
ভারত বরাবরই ধর্মনিরপেক্ষতার নিশানবর্দার।
এটি তার রাষ্ট্রীয় তকমাও। কিন্তু কেমন নিরপেক্ষ সে এই রায় বিষয়টি আবারো আঙ্গুল দিয়ে দেখালো। একটি প্রতিষ্ঠিত সত্যকে উগ্র কিছু লোকের কারণে অস্বীকার করলো সে দেশের আদালত। বিচারের দিন কি তবে সত্যি সত্যি শেষ হয়ে আসছে!
মুসলমান বলে বাবরি মসজিদের জন্য বেদনা বা অশ্র“ নিবেদন নয়, সত্য ও ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল প্রতিটি মানুষই বাবরি মসজিদের জন্য বেদনা অনুভব করেন বলেই আমাদের বিশ্বাস। কারণ এটিকে স্রেফ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করার সুযোগ নেই।
বাবরি মসজিদ কেবল মুসলমানদেরই ইস্যু এমনটি ভাবাও উচিত নয়। কারণ বাবরি মসজিদ কেবল মসজিদের গন্ডিতে আর নেই। সে এখন নির্যাতিত প্রতীক। যেখানেই কোনো পবিত্র স্থান আক্রান্ত হবে, নির্যাতনের স্বীকার হবে, সেখানেই মূর্ত হয়ে উঠবে বাবরি মসজিদ নির্যাতনের ক্ষতগুলো। মাথা তুলে দাঁড়াবে হিন্দুত্বের আক্রোশে গুঁড়িয়ে যাওয়া এর প্রতিটি ইট।
এই সত্য চিরন্তন। এর কোনো ক্ষয় নেই। পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত বাবরি মসজিদের প্রতিটি ধুলোকণা জানান দিয়ে যাবে, কিছু লোকের আক্রোশের স্বীকার হয়েছিলো তার গুম্বুজগুলো। যতদিন বাবরি মসজিদ তার স্থানে পুনঃপ্রতিষ্ঠা না হবে, ততদিন তার এই জানান দেয়ায় দাঁড়ি পড়বে না।
ভালো তো সেটিই যখন ভুলের প্রায়শ্চিত্ব করা যায়।
একে সুযোগ মনে করে কৃতজ্ঞই হবে বুদ্ধিমান। কিন্তু ভারত সরকার ও আদালতকে এই বিচারে আমাদের কাছে বুদ্ধিমান বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে না কারণ, ভারতের উগ্র হিন্দুরা বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়ে যে অপরাধ করেছে তা তো ক্ষমা করার এখতিয়ার কারো নেই। কিন্তু প্রায়শ্চিত্ব করার সুযোগ ছিলো। অথচ হাতের কাছের এই সুযোগটিই গ্রহণ করলো না দেশটির আদালত।
কারণ, যে দাবীতে এই উগ্র হিন্দুরা একাট্টা হয়েছিলো সেটি তারা হতেই পারে, এই সুযোগ তাদের আছে। একে না করার যুক্তি নেই। কিন্তু তাদের পক্ষে মসজিদ ভাঙার তো কোনো বৈধতা দাঁড় করানো যাবে না। অথচ সে কাজটিই তারা রাষ্ট্রীয় সমর্থনে করেছে। রাষ্ট্রীয় সমর্থন বলছি কারণ, এতো বড় একটি মসজিদ পুরোপুরি মাটিতে মিশিয়ে দেয়া তো সহজ কোনো ব্যাপার নয়, যদি রাষ্ট্র সেটিকে সমর্থন না করে।
এই যে হিন্দুত্ববাদের সমর্থনে ভারতের রাষ্ট্রীয় অপরাধ Ñ সুযোগ পেয়েও তার প্রায়শ্চিত্ব করলো না দেশটি। তখন তাকে আপনি কী করে বুদ্ধিমান রাষ্ট্র বলেন?
০ দুই ০
রামের জন্মভূমির একটি অপ্রমাণিত দাবি তুলে শহীদ করা হলো বাবরি মসজিদকে। হিন্দুত্ববাদের এই অপরাধে বিশ্বমুসলিম পেলো শাহাদাতের ঋণ। আমি জানি না, এই ঋণ কীভাবে শোধ হবে। আর হিন্দুত্ববাদ কীভাবে তার অপরাধ ঘুচাবে।
দু’পক্ষের জন্যই আমার সমান বেদনা ও মমতা জাগে। চোখে অশ্র“ জমে। মানুষ কতটা মনুষ্যত্ব হারালে পবিত্র স্থানে হামলে পড়তে পারে, আমার জানা নেই। জানা নেই, কতদিন সেই পশুত্বকে সহ্য করা যেতে পারে! বিচারের রায় দেয়ার তারিখ যখন ঘোষণা হলো, তখন মনে হয়েছিলো, ভারত এই অপরাধ ঘুচাতে যাচ্ছে। তার মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটেছে।
আর একারণেই রায় দেয়ার উদ্যোগ সে নিয়েছে। কিন্তু এইভাবে অপরাধকেই প্রতিষ্ঠা করবে জানলে দেশটির প্রতি এতো আশা রাখতাম না। বিশেষত রায় দেয়ার ঘোষিত তারিখটি পেছানোয় ভারতের প্রতি আশাটা আরো নিবদ্ধ হয়েছিলো বেশি করে। এবং ৩০ সেপ্টেম্বর রায় দেয়ার দিনকে ঘিরে ১ লাখ ৯০ হাজার সদস্যের নিরাপত্তা বলয় গড়ায় মনের আশাটি খুব প্রবলভাবে জেগে উঠেছিলো। কারণ এতে করে মনে হচ্ছিলো সম্ভাব্য রায়ে উগ্র হিন্দুরা নৈরাজ্য চালাতে পারে ভেবেই এই বিশাল বাহিনীর নিরাপত্তার দরকার মনে করেছে ভারত।
কারণ মুসলমানরা হতাশ হওয়ার মতো রায়ের সম্ভাবনা থাকলে তো এই রকমের নিরাপত্তার দরকার ছিলো না। মুসলমানদের এই শক্তি ও শিক্ষা নেই যে সে বর্বরতায় মাতে, হাত হিংস্র করে। এর ক্ষমতা ও শিক্ষা তো ভারতের উগ্র হিন্দুদেরই আছে। এর প্রমাণও তারা সফলভাবে দিয়েছে। এই রকমের যাতে কিছু তারা করতে না পারে রায়কে ঘিরে ভারতের নেয়া নিরাপত্তায় সেটিই মনে হয়েছিলো।
কিন্তু যে রায় এলো তাতে উগ্র হিন্দুদেরই জয় হলো। জয় হলো অপ্রমাণিত একটি দাবির। আদালতের রায়ে প্রতিষ্ঠা পেলো উগ্রহিন্দুত্ববাদ ও রাষ্ট্রীয় অপরাধের। এমন রায়ের জন্য তারিখ পেছানো আর নিরাপত্তার দরকার পড়েছিলো?
রায় ঘোষণার পর কোথাও কোনো গোলযোগ না হওয়ায় একটি বিষয় টার্গেট করে প্রচার করা হচ্ছে যে, দুপক্ষে সহনশীল মনোভাবের কারণে এই শান্ত পরিস্থিতি বজায় থেকেছে। শান্তি থাকুক, এটি সকলেই চায়।
এই রায়ে হিন্দুদের অশান্ত হওয়ার কিছু আছে কি। রায়টি যদি সত্যের পক্ষে হতো, ক্ষমতার দাপটে সন্ত্রস্ত না হতো তবে কি বাবুরা এই রকমের শান্ত থাকতেন! নিশ্চয় না।
শান্ত যে থাকতেন না এ তাদের প্রতিক্রিয়ায়ই বোঝা যায়, তারা জানিয়েছেন, এই রায়ে তারা সন্তুষ্ট ঠিক, তবে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। কেনো, যে রায়ে তুষ্ট আছেন, সেটি নিয়ে আপিল করবেন কেনো। এই কেনোর ভেতরেই লুকিয়ে আছে আগের প্রশ্নের উত্তরটি।
আদালতের রায়ে জমিটিকে তিনভাগে বণ্টন করা হয়েছে, দুভাগ হিন্দুদের। আর এক অংশ মুসলমানদের। এই এক অংশও কেনো মুসলমানদের দেয়া হলো, সেটি খারিজ করতেই ‘সন্তুষ্ট’ রায় নিয়ে আপিল করবেন হিন্দুরা। মনে একটি প্রশ্ন উঁকি দিলো, এই এক অংশ দেয়ায়ই পরিস্থিতি শান্ত রাখতে ১ লাখ ৯০ হাজার সদ্যের বিশাল বাহিনীকে নিরাপত্তার জন্যে প্রস্তুত রাখতে হয়েছে। যদি দুভাগ দেয়া হতো মুসলমানদের তাহলে পরিস্থিতি শান্ত রাখতে কত লাখ নিরাপত্তাবাহিনীর দরকার হতো?
নিজেকে যতই ধর্মনিরপেক্ষ বলুক ভারত যে আগাগোড়াই হিন্দুত্ববাদে ঢাকা সেটি কোনোভাবেই গোপন রাখা যায় না।
তাদের রাজনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি, বিচার সব কিছুর ভেতরের হিন্দুত্ববাদ মূর্তির মতোই এখন নগ্নভাবে প্রকাশ পায়। এ থেকে ভারতের মুক্তির আপাতত কোনো লক্ষণ নেই। তাই এদের কাছে নির্যাতিত বাবরি মসজিদ কখনো শ্রদ্ধা পাবে না। তাদের রামই সেখানে আরাম করার সুযোগ পাবেন। হোক না তা কল্পিত।
কিংবা অপ্রমাণিত।
বাবরি মসজিদ : ঘটনাপঞ্জি
১৫২৮ : মুঘল সম্রাট বাবর প্রতিষ্ঠা করেন বাবরি মসজিদ।
১৮৫৩ : অযোধ্যার বিতর্কিত স্থানটিকে কেন্দ্র করে প্রথম সা¤প্রদায়িক সংঘাত।
১৮৫৯ : বিতর্কিত স্থানটিকে ব্রিটিশ সরকার বেড়া দিয়ে ঘিরে দেয়। দুইভাগে ভাগ করা হয় গোটা জায়গা।
ভেতরের অংশ মুসলমানদের ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। বাইরের অংশ বরাদ্দ থাকে হিন্দুদের ব্যবহারের জন্য।
১৮৮৫ : মহন্ত রঘুরীর দাস ‘রামজন্মভূমি’ স্থানে সামিয়ানা টানানোর অনুমতি চাইলে ফয়জাবাদ জেলা আদালত রঘুবীর দাসের আবেদন নাকচ করে দেন।
১৯৪৯ : বাবরি মসজিদের ভেতরে রামের মূর্তি পাওয়া যায়। মুসলমানদের বক্তব্য, হিন্দুরাই মসজিদের ভেতরে এই মূর্তি রেখে দিয়েছিলো।
সরকার জমিটিকে বিতর্কিত ঘোষণা করে তালা দিয়ে দেয়।
১৯৫০, ১৮ জানুয়ারি : গোপালসিঙ বিশারদ ‘দেবস্থানের’ ভেতরে মূর্তি পূজোর অনুমতি চান। কোর্ট সম্মতি দেন।
১৫৫০, ২৪ এপ্রিল : উত্তর প্রদেশ সরকার স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে আদালতে আপিল করে।
১৯৫০ : জনৈক রামচন্দ্র পরমসংস ফের একটি মামলা করেন।
আবার প্রত্যাহারও করেন।
১৯৫৯ : নির্মোহী আখড়া জমির স্বত্ব চেয়ে মামলা করে।
১৯৬১, ১৮ ডিসেম্বর : উত্তর প্রদেশে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড মসজিদ এবং সংলগ্ন জমির স্বত্ব চেয়ে মামলা দায়ের করে।
১৯৮৯ : বিশ্বহিন্দু পরিষদের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট দেওকিনন্দ আগরওয়ালা আরো একটি মামলা দায়ের করেন।
১৯৯০ : বিশ্বহিন্দু পরিষদের সদস্যরা বাবরি মসজিদে প্রথম আক্রমণ করে।
এবং তার আংশিক ক্ষতি করে। প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রসেখর আলোচনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
১৯৯২, ৬ ডিসেম্বর : বাবরি মসজিদটি পুরোপুরি ধংস করে হিন্দু পরিষদের সদস্যরা। দেশজুড়ে চলে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা। ২০০০ এরও বেশি মানুষ নিহত।
মসজিদ ভাঙার ছয় মাস পর গঠন হয় লিবারহান্স কমিশন।
১৯৯৬, জুলাই : এলাহাবাদ হাইকোর্ট সব মামলাকে সংগঠিত করেন।
২০০২ : বিতর্কিত স্থানে মন্দির ছিলো কি না তা দেখার জন্য ভারতের পুরাতত্তবিভাগকে হাইকোর্টের নির্দেশ।
২০০২, এপ্রিল : হাইকোর্টের তিন বিচারক শুনানি শুরু করেন।
২০০৩, জানুয়ারি : পুরাতত্তবিভাগের অনুসন্ধান শুরু।
২০০৩, আগস্ট : পুরাতত্ত্ব বিভাগের দাবি, মসজিদের নিচে মন্দিরের নিদর্শন মিলেছে। বিতর্ক দানা বাঁধে।
২০০৯, জুন : বাবরি মসজিদ ভাঙার ১৭ বছর পর শুরু হয় তদন্ত। ৪৮ বার পিছিয়েছে এই তদন্ত।
২০১০, ২৬ জুলাই : লক্ষেèৗ বেঞ্চ ২৪ সেপ্টেম্বর রায় দানের ঘোষণা করেন।
২০১০ : ১৭ সেপ্টেম্বর : মামলার রায় পিছিয়ে দিতে আরসি ত্রিপাঠির পেশ করা আর্জিটি খারিজ করে দেন হাইকোর্ট।
২০১০, ২১ সেপ্টেম্বর : ত্রিপাঠির আরজি মেনে রায় এক সপ্তাহ স্থগিত করার নির্দেশ দেন সুপ্রিমকোর্ট।
২০১০, ২৩ সেপ্টেম্বর : বিচারপতি অরভি রবীন্দ্র ও এইচএল গোখলের মতপার্থক্য দেখা দেয়।
২০১০, ২৮ সেপ্টেম্বর : ত্রিপাঠির আবেদন খারিজ করে দিয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর মামলার রায়ের দিন চূড়ান্ত করেন সুপ্রিমকোর্ট।
২০১০, ৩০ সেপ্টেম্বর : এলাহাবাদ হাইকোর্টের ৮ হাজার ৯ শ পৃষ্ঠার রায়।
হিন্দুরা সন্তুষ্ট। মুসলমানরা হতাশ। রায় নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। দু’ পক্ষর সুপ্রিমকোর্টে আপিলের সিদ্ধান্ত।
সূত্র : যুগান্তর, ২ অক্টোবর ২০১০।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।