ফুলের সৌরভে সুরভিত কলমের কণ্ঠস্বর
গত বছরের অক্টোবর মাসের ঘটনা। আয়ারল্যান্ড এসেছি তখন প্রায় এগারো মাস, অথচ ইংল্যান্ড যাওয়া হয়নি একবারও। লন্ডন থেকে আমার কাজিন (পাভেল ভাইয়া) বারবার বলছে ঘুরে আসতে। পাসপোর্টে ব্রিটেনের মাল্টিপল ভিসা, চাইলেই ঘুরতে যাওয়া যায়। কিন্তু একাজ, ওকাজ করে যাওয়া হচ্ছিল না।
আসলে পড়ালেখা থেকে বিরতী নেয়াটা সমস্যা ছিল না, সমস্যা ছিল অর্থনৈতিক। আমি একাডেমিক টিউটরের যে কাজটা করি সেটায় ছুটি বলে কিছু নেই। হিসেব খুব সহজ - কাজ করলে পকেট ভরবে, না করলে মার যাবে। সেজন্য অফিসিয়াল ছুটির অপেক্ষায় ছিলাম।
অক্টোবরের ২৫ এবং ২৬ উইক এন্ডের পাশাপাশি ২৭ তারিখ ছিল অক্টোবর হলি ডে; আর শুক্রবার আমার তেমন কোন কাজ থাকে না।
ফলে কোন ক্রমে বৃহষ্পতিবারটা ছুটির ভেতর নিতে পারলে বেশ সুন্দর একটা ট্রিপ হয়ে যায়। সুন্দর করে পরিকল্পনা সাজিয়ে আমার সুপারভাইজারকে বলার পর তিনি হেসে সাথে সাথেই সম্মতি দিলেন। তারপর যে ডিপার্টমেন্টের হয়ে আমি কাজ করি, তাদেরও জানালাম একদিন না আসতে পারার কথা। তারাও বিষয়টা মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করলো কারন আমি আয়ারল্যান্ড আসার পর গত একবছর আর কোথাও যাইনি (নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে সামারস্কুলে অংশগ্রহন ছাড়া)। ফলে আমার ইংল্যান্ড ভ্রমনের শেষ বাঁধাটাও দূর হয়ে গেলো।
বৃহষ্পতিবার সকাল সকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসলাম দুপুরের ফেরী ধরে আইরিশ সাগর পাড়ি দিয়ে আয়ারল্যান্ড থেকে ওয়েলস যাবার প্রস্তুতি নিয়ে। এরপর ওয়েলস থেকে ট্রেনে করে ইংল্যান্ড। পরিকল্পনা বেশ গোছানোই ছিল, কিন্তু বিধিবাম অন্য জায়গায়। সেদিন সকাল থেকে প্রচন্ড বৃষ্টি। অনলাইন থেকে চেক করে দেখলাম সকাল এবং দুপুরের ফেরী বাতিল হয়ে গিয়েছে।
রাত নয়টায় ছাড়বে ইউলিসিস, যা পৃথিবীর বৃহত্তম ফেরী। মারাত্মক ঝড় না হলে এই ফেরীর জন্য সাগর পাড়ি দেয়া কোন সমস্যা নয়। অতএব অনলাইনে যাত্রীদের আস্বস্ত করা হলো যাতে সবাই রাতের ফেরী ধরে।
এদিকে তখনও বৃষ্টি হয়েই চলেছে। প্রচন্ড বিরক্ত লাগছিল।
এক হাতে ল্যাপটপ আর অন্য হাতে সুটকেস নিয়ে আমি আটটার দিকে বের হলাম ডাবলিন পোর্টের উদ্দেশ্যে। ফেরীর সামনে বাস থেকে নামার পর আমি স্ববিস্ময়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম। এটা যে ফেরী, সেটা বোঝার কোন সাধ্য নেই। পনেরো তালা বিল্ডিং-এর সমান উঁচু বিসাল আকৃতির দানবটার আটটা তালায় শুধু বাস, ট্রাক, লরি আর কার উঠে। এরপর উপরের তালাগুলোতে মানুষের বসার জন্য স্থান।
একটা সুপার মার্কেট, দুটা সিনেমা হল, বার, ক্যাসিনো, রেস্টুরেন্ট সহ এ যেন একটা ছোটখাটো শহর! পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফেরী সে এমনি এমনি হয়নি, সেটা আর বোঝার বাকি ছিলনা।
ফেরীতে উঠে দেখি বৃষ্টি তখনও হচ্ছে। সাগর উত্তাল। তবে ক্যাপ্টেন জানালো সে আশা করছে আনন্দময় ভ্রমন হবে! যাইহোক, কিছু সময় পর ফেরী ছেড়ে দিল। বাহিরে তাকিয়ে দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার।
একটু একটু করে তখন ডাবলিন শহরের আলোগুলো দূরে সরে যাচ্ছে। আমরা ক্রমেই আইরিশ সাগরের ভেতরে প্রবেশ করছিলাম। খানিক পর মোবাইলের সিগনালও চলে গেলো। বুঝলাম, এখন আমরা ডাঙ্গা থেকে বহু দূরে। চারদিকে কেবল পানি আর পানি।
ভয়ঙ্কর সুন্দর উত্তাল সাগরের উপর দিয়ে সেদিন পানি কেটে চলছিল ইউলিসিস - পৃথিবীর বৃহত্তম ফেরী।
ওয়েলসের হলিহেডে পৌছাতে লাগলো সাড়ে তিন ঘন্টা। রাত সাড়ে বারোটায় হলিহেড পোর্টে নেমে ইমিগ্রেশনের লোক খুঁজে পেলাম না একজনও। ফলে পাসপোর্টে সিল না নিয়েই বের হয়ে এলাম পোর্ট থেকে। রেল স্টেশনটা লাগোয়া।
স্টেশনে গিয়ে খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলাম ট্রেন সম্পর্কে। একটা মানুষেরও নামগন্ধ নেই! মনেমনে ভাবলাম এই তবে বৃটেন? হোক ওয়েলস, তবুতো যুক্তরাজ্যেরই একটা দেশ। অথচ অবস্থাতো বাংলাদেশের থেকে খুব একটা উন্নত নয়; অন্তত ম্যানেজমেন্টের দিক দিয়ে।
কিছু করার ছিলনা তখন। তাই স্টেশনের প্লাটফর্মে হাটছিলাম আর আশেপাশের লেখাগুলো পড়ছিলাম।
ওয়েলেস হচ্ছে যে চারটা দেশ নিয়ে যুক্তরাজ্য গঠিত, তার একটি। যদিও ওদের ভাষা ওয়েলশ, তবে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডের শাসন থেকে ইংরেজীর প্রভাব ব্যপক হতে থাকে। ওয়েলসের প্রিন্স লিওয়েলেন দ্যা গ্রেটকে পরাজীত ও হত্যা করার মধ্য দিয়ে ওয়েলসে ইংরেজ শাসনের সূচনা করে এডওয়ার্ড। এরপর থেকে ওদের নিজস্ব ভাষা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু গত এক দশক ধরে জাতীয়তাবোধের পুনর্জাগরনের মাধ্যমে ওয়েলসে যেসব পরিবর্তন হয়েছে তার মধ্যে ভাষাকে পুনপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা অন্যতম।
ওয়েলস এখন বাই লিঙ্গুয়াল দেশ। প্রথম ভাষা সর্বত্র ওয়েলশ এবং সাথে ইংরেজী। তবে অফিস, শিক্ষা বা কাজের ক্ষেত্রে ইংরেজীই প্রধান কারন ওয়েলসের মানুষ নিজেরাই তাদের ভাষা পারে না। এজন্য সরকার ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহন করেছে তাদের ভাষাকে আবার জনপ্রিয় করার জন্য। ওয়েলস কি করে গড়ে উঠে, স্বাধীনতা হারায়, ইংল্যান্ডের সাথে মিলে ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস গড়ে তোলে, আবার স্বায়ত্বশাসন পায়, সাংবিধানিক রাষ্ট্রে পরিনত হয় ইত্যাদি এই অফিসিয়াল লিঙ্ক থেকে আগ্রহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন।
যাইহোক প্লাটফর্মে হাটতে হাটতেই ট্রেন চলে আসলো। ঘড়িতে তখন একটা। মনটা বেশ ভালো হয়ে গেলো। তার পর ট্রেনের চেহারা দেখেতো রীতিমত আনন্দে আত্মহারা। ইংল্যান্ডের সবচেয়ে নাম করা ট্রেন - ভার্জিন ট্রেনস।
পরবর্তিতে জেনে ছিলাম এই ট্রেন ইংল্যান্ডকে স্কটল্যান্ড এবং ওয়েলসের সাথে সংযুক্ত করে রেখেছে। আমাদের দেশে যেমন আন্তঃনগর সার্ভিস থাকে, এখানে আন্তঃদেশ! ট্রেনের ভেতরের চিত্র আরো আরো মনমুগ্ধকর। ট্রেন ভাবতেই যেন আমার বাধছিল। এ যে প্লেন! ছাড়ার পর খানিক সময় ঝাকিটা অনুভব করেছি, তার পর একটু স্পিড বাড়লেই সব কোথায় গায়েব হয়ে গেলো! মনে হচ্ছিল যেন শুন্যে উড়ে চলেছে ট্রেন। পরে ক্যাপ্টেন জানিয়েছিল, ২০০ কিলোমিটার বেগে আমরা ওয়েলস থেকে ইংল্যান্ডের বার্মিংহামের দিকে ছুটে গিয়েছি।
বার্মিংহামে যখন পৌছাই তখন রাত তিনটার বেশি। বার্মিংহাম হচ্ছে ইংল্যান্ডের অন্যতম বড় জাংসন। শুধু জাংসন হিসেবেই নয়, শহর হিসেবেও এটা বেশ নাম করা। এই শহরটা লন্ডনের পর পুরো ব্রিটিশ আইলস তথা ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এবং আয়ারল্যান্ড (নর্দার্ন ও রিপাবলিক)-এর মধ্যে সর্ববৃহৎ। শুধু তাই নয়, পুরো ইউরোপে এটি ১২তম বৃহৎ শহর।
অথচ বৃটেনের বাহিরের মানুষ শহরটাকে তুলনামুলক কমই চেনে। লিভারপুল, ম্যানচেস্টার বা গ্লাসগো যতটা পরিচিত, বার্মিংহাম মানুষের কাছে ততটা পরিচিত নয়। যাইহোক, বার্মিংহাম নিউ স্টেশনে নেমে একজন এ্যাটেন্ডেন্টকে পেলাম যার সাহায্যে পরবর্তি ট্রেনের খোঁজ নিয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে ওয়েটিং রুমে বসলাম। তখনও বৃষ্টি ফোটাফোটা হচ্ছে। আবহাওয়াটা অদ্ভুত।
কেমন যেন একটা মায়ার জাল বিছিয়ে রেখেছে চার দিকে। স্টেশনের ভেতরে বিলবোর্ডে এ্যাডগুলো দেখে সময় কাটানোর চেষ্টা করছিলাম। খানিক পরেই ট্রেন চলে এলো। এবারও ভার্জিন ট্রেন। দ্রুত সুটকেস এবং ল্যাপটপ নিয়ে ট্রেনে উঠে বসলাম।
ওয়েলসের হলিহেড থেকে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম পর্যন্ত আসতে ট্রেন প্রায় ফাকাই ছিল, কিন্তু বার্মিংহাম থেকে লন্ডন-গামী ট্রেনটা প্রায় ভর্তি। মাত্র একটা শহর আগে - উলভারহ্যাম্টন থেকে যাত্রা শুরু করে এসেছে - তাতেই যেন এক শহর মানুষ নিয়ে এসেছে ট্রেনটা। যতই লন্ডনের দিকে যাচ্ছিলাম ততই অফিসগমী মানুষ উঠতে শুরু করলো ট্রেনে। দেখতে দেখতে আমরা কভেন্টি, রাগবী সহ কত শহর পার হয়ে গেলাম। রাগবী হচ্ছে সেই শহর যে শহরের 'রাগবী স্কুল'-এর ছাত্র উইলিয়াম এলিস ফুটবল খেলতে খেলতে হঠাৎ একবার হাত দিয়ে বল ধরে দৌড় দিয়েছিল।
তারপর ধীরেধীরে অন্যান্য ছাত্ররাও বিষয়টায় মজা পেতে শুরু করে এবং হাত দিয়ে ধরে ফুটবল খেলার একটা ধরনের প্রচলন করে তারা যা পরবর্তিতে এলাকার নামানুসারে রাগবী ফুটবল হিসেবে পরিচিত হয়।
যদিও ট্রেন চলছিল বিদ্যুতের গতিতে, কিন্তু ক্যাপ্টেন জানালো গতি নাকি খুব একটা বাড়াতে পারছে না টেকনিকাল কারনে। পথে সিগনালের কাজ হচ্ছিল। তাই, গতি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছিল না। তবে লন্ডনের কাছাকাছি আসলে স্বাভাবিক গতির থেকে (২০০ কি.মি.) আরো জোরে চালিয়ে মাত্র চার মিনিট লেটে লন্ডন পৌছে দেয় আমাদের।
তারপরও ক্যাপ্টেন বারবার 'সরি' বলছিল। সাধে কি বলে, ইংরেজরা বজ্জাত কিন্তু ভদ্রলোক!
যাইহোক, সাত সকালে এসে লন্ডন ইউস্টন স্টেশনে নামলাম। এই স্টেশনটার মত ডাবলিনেও একটা স্টেশন আছে - নাম ডাবলিন হিউস্টন! ট্রেন স্টেশনেরও যে কাজিন থাকতে পারে সেটা আগে জানতাম না! যাইহোক, ট্রেন থেকে নেমেই দেখি পাভেল ভাইয়া দাড়িয়ে আছে প্লাটফর্মের সামনে। দৌড়ে গিয়ে হাগ করলাম। কত্তদিন পর ভাইয়ার সাথে দেখা।
অদ্ভুত একটা অনুভুতি। এরপর ধীরেধীরে বের হয়ে এলাম স্টেশন থেকে। চোখের সামনে দেখতে পেলাম লন্ডন শহরের আকাশ। খুব সাধারন, মন খারাপ করে দেয়া একটা লুক শহরটার। অথচ কেন জানি এই শহরটাই আমাকে প্রচন্ড ভাবে আকর্ষন করে।
এক অদ্ভুত মায়ায় প্রতি মূহুর্তে হাতছানি দিয়ে ডাকে। দুই হাজার বছর আগে রোমানরা যে শহরটার গোড়াপত্তন করেছিল, মধ্যযুগে ব্রিটিশরা সেই শহরকে বানিয়ে ছিল পৃথিবীর রাজধানী, আর বর্তমান আধুনিক বিশ্বে শহরটা এখনও বিশ্বের অন্যতম স্বপ্ন নগরী।
স্টেশন থেকে টিউব এবং ডিএলআর ধরে আমরা যখন ইস্ট লন্ডনের খোলা প্রান্তরে এসে দাড়ালাম তখন ঝিরিঝিরি ঝরছে লন্ডনের আকাশ। আম্মুর কাছে কত শুনেছি লন্ডনের একঘেয়ে কিন্তু বিরক্তিকর ভালোলাগার এই বৃষ্টির গল্প, সেদিন দেখলামও। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আর মনেমনে ভাবছিলাম, এর থেকে ভালো 'ওয়েলকাম' আর কি হতে পারে!
নিয়াজ
১০ এপ্রিল ২০০৯
ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।