আমাদের অনেকের ধারণা নির্বাচনের মাধ্যমে একটা নতুন ক্ষমতার জন্ম হয়। সাদা কথায় নির্বাচনের মাধ্যমে কেউ ক্ষমতায় আসে। বিদেশী স্বার্থ কাউকে ক্ষমতায় আনে, আনার কাজকে প্রভাবিত করে এটাও আমরা শুনে থাকি। এসব কী করে, কেন ঘটে সেসব নিয়ে কথা বলব এখানে।
তবে গণক্ষমতার ভিত্তি তৈরি, পালটা গণক্ষমতা হিসাবে একে হাজির করা এই আলোচনার বাইরে থেকে গেছে, এখানকার প্রসঙ্গের অংশ করা হয়নি।
বরং নির্বাচন ধারণার উপর জোর পড়েছে বেশি।
নির্বাচনের কারণে কেউ ক্ষমতা পায় না। ক্ষমতার ভিত্তি কাঠামো তৈরি হয় নির্বাচনের অনেক আগে। এরপর নির্বাচন ঐ ক্ষমতা তৈরির শেষ ধাপ, ক্ষমতাকে আইনগত ভিত্তি দেওয়ার ধাপ। কোন নতুন ক্ষমতার ষ্টেক হোল্ডাররা মিলে একমত একটা আন্ডারষ্টান্ডিংয়ে ক্ষমতার ভিত্তি তৈরি করে তবে সেটা মোটাদাগের স্কেচে আঁকা একটা কাঠামো মাত্র।
ওর প্রতিটা ইট, কাঠ, বালি সিমেন্ট কেমন হবে সেটা সেখানে বলার দরকার পরে না, থাকেওনা। এটাকে বলতে পারি আসন্ন নতুন ক্ষমতার ষ্টেক হোল্ডারদের আন্ডারষ্টান্ডিংয়ের ফ্রেমওয়ার্ক। ফ্রেমওয়ার্কে গৃহীত এই সিদ্ধান্ত দৃশ্যমান করার পর জনগণের পপুলার ভোটে তা পাশ করিয়ে আনা হয়। এই শেষ অংশটা দিনের আলোর মত প্রকাশ্য। ফলে নির্বাচনে ক্ষমতা তৈরি হয় বা পাওয়া যায় বলে একটা ভ্রম আমাদের মনে তৈরি হয়।
ক্ষমতার ভিত পাতার পর ক্ষমতা দৃশ্যমান হতে হতে ওর শেষ অধ্যায়টা নির্বাচন – তবে এটাও খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ। কারণ নির্বাচনের আগেই ওটা ক্ষমতা অবশ্যই, ওর ভিত্তিতে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়াও সম্ভব তবে আইনগত ভিত্তিটা তখনও ওর নাই। নির্বাচন ক্ষমতার আইনগত ভিত্তি দেয়; এর মানে হলো, ক্ষমতা হয়ে উঠার এই শেষ অধ্যায় নির্বাচন বাদ রেখে ক্ষমতা দখল করে ওর ব্যবহার চর্চা শুরু করা সম্ভব। যেমন এরশাদের উত্থান, ক্ষমতাসীন হওয়া। আমরা যেটাকে বলতে দেখি ওটা “অনির্বাচিত ক্ষমতা”।
এভাবে বলার মানে ওটা ক্ষমতা নয়, তা কিন্তু নয়? অবশ্যই ওটা সব অর্থে ক্ষমতা। ক্ষমতা মানেই বল প্রয়োগ করার ক্ষমতা; অন্যকে তা মানতে বাধ্য করার ক্ষমতা; তা সবই ওর আছে। এছাড়া বলবার অপেক্ষা রাখে না বাস্তবে এরশাদ তো ক্ষমতাসীন হয়ে হাজির। ওর ক্ষমতার ভিত্তি, কাঠামো তৈরি হয়েছে অনেক আগেই; নতুন সম্ভাব্য ক্ষমতার ষ্টেক হোল্ডাররা মিলে একমত একটা আন্ডারষ্টান্ডিংয়ে তৈরি ক্ষমতার ভিত্তি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করেছিল যখন।
ভিত্তি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির কালে ষ্টেক হোল্ডার নয় বা হতে পারেনি, যোগ্যতা দেখাতে পারেনি যারা যারা, এদের সবার উপর বলপ্রয়োগে নিজেকে নতুন ক্ষমতা বলে মেনে নিতে বাধ্য করা – এসব পর্যায়গুলো পার হয়েই সে ক্ষমতা, একটা বাস্তব হাজির ক্ষমতা।
কেবল শেষ অধ্যায় নির্বাচন – এটা সে পুরণ করে নাই। নির্বাচন এই শেষ অধ্যায়টা পূরণ করা না করার ফারাক হলো, নির্বাচন করা মানে ইতোমধ্যে হয়ে উঠা ক্ষমতার অভিষেক করিয়ে নেয়া, আইনগত ভিত্তি প্রতিষ্টা করা। আগে ফ্রেমওয়ার্কে গৃহীত সিদ্ধান্তে তৈরি হওয়া ক্ষমতা এবার আইনগত বৈধতা পেয়ে যাওয়া।
এখানে মুল কথা যেদিকে পাঠকের নজর ফেরাতে চাচ্ছি, তা হলো, ক্ষমতা ও ক্ষমতার বৈধতা এক জিনিষ না। যারা ক্ষমতার ভিত পাতার সময় থেকেই ষ্টেক হোল্ডার হতে পারেনি, বা কোনভাবেই ষ্টেক হোল্ডার হওয়ার যোগ্যই নয়, ক্ষমতার ভাত যাদের নাই এরা কেবল এরশাদের ক্ষমতার আইনগত ভিত্তি নাই শুধু এই দিকটা তুলে ধরে খোঁটা দিয়েছিল।
ক্ষমতার ষ্টেক হোল্ডার হবার মোটা দাগে দুইটা পথ আছে। জনগণের ক্ষমতা রূপে বল বা মুরোদ দেখিয়ে নিজেকে হাজির করা। অথবা, রাষ্ট্রের বাইরের ক্ষমতার স্থানীয় পলিটিক্যাল এজেন্ট হওয়া - এর প্রথমটা করার মুরোদ এদের ছিল না। আর দ্বিতীয়টার বেলায় বাছাইয়ে বাদ পড়েছিল। ফলে রাজনৈতিক দল হিসাবে যাদের আমরা চিনি এদের কারও ভাগ্যে ক্ষমতার ভাত জুটে নাই।
ষ্টেকহোল্ডার (stakeholder) কথাটা উপর অনেক ব্যবহার করেছি। আগেই একটু ব্যাখ্যা দিয়ে নিলে ভাল হত, এখন তা করছি। ক্ষমতার করিডোরে হাঁটাচলা করা একাদেমিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের লেখায় প্রায়ই এই শব্দের দেখা মিলে। ক্ষমতার মোকাম আড়তগুলোতে চালু শব্দ এটা।
গ্লোবাল পাওয়ারগুলো স্থানীয় কোন ক্ষমতা ফ্রেমওয়ার্ক এর জন্মকালে নিজেও সামিল থাকে, আছে এই লজ্জার কথা প্রকাশ্যে কিভাবে বলবে এর সমাধান হিসাবে এই শব্দ চালু।
কারণ, গ্লোবাল পাওয়ারগুলো কি করে যুক্তি সাজিয়ে অপর রাষ্ট্রে ক্ষমতা তৈরিতে নিজের সংশ্লিষ্টতাকে জায়েজ দাবী করবে, লেখা ভাষ্যে সে গোপন বিষয় সামনে আনাটা সমস্যা, লজ্জারও বটে। ফলে একটা শব্দ চালু হয়েছে যেটা গ্লোবাল পাওয়ারের সংশ্লিষ্টতা জায়েজ কিনা, কীভাবে জায়েজ সেসব প্রশ্নে নীরব থাকে এবং ঐ সংশ্লিষ্টতা একটা বাস্তবতা যা সত্য অবশ্যই, সেখান থেকে কথা শুরু করে; এই ভাবের মধ্যে নিজের অর্থ সীমাবদ্ধ রাখে।
শব্দটা ধার নেয়া হয়েছে ক্যাসিনা জুয়ার টেবিল থেকে। ক্যাসিনো জুয়ার টেবিলের একএক সাইডে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন যেমনটা আমরা সচরাচর সিনেমায় দেখি সে রকম এক পটভুমিতে, আগেকার দিনে হলে দেখতাম সামনে স্বর্ণমুদ্রা থাক থাক করে সাজিয়ে জুয়ারবাজি ষ্টেক ধরে জুয়ারু দাঁড়িয়ে আছে, যেটা এখন স্বর্ণমুদ্রার বদলে প্লাস্টিকের কয়েন যা আসলে আগে অর্থ জমা দেয়ার প্রমাণচিহ্ন টোকেন। বাজি ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এদেরকে ক্যাসিনোর ভাযায় ষ্টেকহোল্ডার বলা হয়।
ক্যাসিনা জুয়ার টেবিল থেকে ধার নেয়া এই শব্দে অর্থ জমা দেয়া মানে যেন "বিনিয়োগ" স্বার্থ তৈরি হয়েছে ওখানে এমন একটা আলগা ওখানে যোগ করে নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে গ্লোবাল পুঁজির বিনিয়োগ স্বার্থটাকে ষ্টেকহোল্ডার বলে দাবি করা হয়। এতে ষ্টেকহোল্ডার শব্দটার অর্থ রাজনৈতিক স্বার্থ করে বদলে নেয়া হয়েছে। যদিও বাংলাদেশে কারও পুঁজি বিনিয়োগ স্বার্থ থাকলে ওর রাজনৈতিক স্বার্থ বাংলাদেশ আছে একথা আইনগত অর্থে অথবা কোন যুক্তি দিয়ে জায়েজ বলে দাবি করানো যায় না। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা, ষ্টেকহোল্ডার বোর্ড ইত্যাদি নিয়ে যা বলছি তা সবই অনানুষ্ঠানিক, অফ দা রেকর্ড; মেহমানের সাথে চা খেতে খেতে যেমন নানান কথা বলি সেরকম ছলে।
তবু রাষ্ট্র ক্ষমতার ষ্টেকহোল্ডার এরা, আমরা চাই বা না চাই।
গ্লোবাল পুঁজির কারবারী দুনিয়াতে হাজির এই বাস্তবতায় আমি ষ্টেকহোল্ডার শব্দটা একটু বড় করে নিয়ে এখানে ব্যবহার করেছি। ধরে নিয়েছি ক্ষমতার ষ্টেকহোল্ডার বোর্ড যেটা আছে এটা আপাতত এড়ানো যাচ্ছে না তবে ক্ষমতার ঐ ষ্টেকহোল্ডার বোর্ডসভায় নিজেদেরকেও নির্ধারক একজন হিসাবে হাজির করা সম্ভব; জনগণের ক্ষমতা সংহত করে পিছনে নিয়ে এই বলের জোর সেই প্রতিনিধিত্ত্ব, ষ্টেক আদায় সম্ভব; ওখানে ক্ষমতার বোর্ড কতটা নিজের রাষ্ট্রের পক্ষে নেয়া যাবে তা লাঠির জোরে ক্ষমতার ওজন বলে দিবে। সোজা কথায় ষ্টেকহোল্ডার মানেই আমরা কেউ না সবাই ওরা বিদেশী – এমন অর্থ ধরে নেই নাই।
এখানে রাষ্ট্র ক্ষমতার ষ্টেকহোল্ডার কথাটার বাংলায় ঠিক “ভাগীদার” বলে বুঝলে ভুল হবে।
এটা আগে থেকে তৈরি একটা ক্ষমতার ভাগ চাওয়া নয়। ক্ষমতার টেবিলের যেমন প্রতিটা পায়া গুরুত্ত্বপুর্ণ, প্রতিটা পায়া ভার বইছে বলে টেবিলটা ভারসাম্যে দাঁড়িয়ে আছে। এমন গুরুত্ত্বপুর্ণ সবচেয়ে ভারবাহী পায়া হয়ে দাঁড়ানো সম্ভব যা টেবিলের ভারসাম্য নির্ধারক। কোন পায়ার সাব-কন্টাক্টর এজেন্ট নয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আমরা ক্ষমতার ষ্টেকহোল্ডারদের মুলত সাব-কন্টাক্টর রাজনৈতিক এজেন্ট এই ভিত্তিতে তৈরি ক্ষমতা দেখছি।
ফলে সাব-কন্টাক্টর রাজনৈতিক এজেন্টদের নির্বাচন এই অংশটুকই দেখেছি। এতে আসল ষ্টেকহোল্ডারদের ক্ষমতাটাই নির্বাচনের মাধ্যমে আইনগত বৈধতাও হাসিল করে ফেলেছে।
বিমুর্ততায় তত্ত্বকথায় এতক্ষণ কিছু কথা বলেছি, এবার সেসব ছেড়ে সুনির্দিষ্ট উদাহরণের সাথে কথায় যাব। শুরুতে উপরের সারকথাটা একবার ঝালাই করে নেই। ষ্টেকহোল্ডার বোর্ডে ক্ষমতার ফ্রেমওয়ার্ক অর্থাৎ ক্ষমতার ভিত গাড়া আগেই ঘটে বা তৈরি হয়ে যায়, নেয়া এই সিদ্ধান্ত পরে নির্বাচন অধ্যায়ের মাধ্যমে বৈধ করে নেয়া হয়।
ক্ষমতা বৈধ হয়ে যায়। তবে মনে রাখতে হবে, বৈধ করে না নিলেও ওটা ক্ষমতাই।
নির্বাচন নিজে ক্ষমতা নয়, ক্ষমতা হয়ে উঠে হাজির হওয়ার প্রক্রিয়ার শেষে এক আইনগত বৈধতা পাবার অধ্যায় মাত্র।
আর, “বুলেট নয় ব্যালটই ক্ষমতা” অথবা “ভোটের বাক্সে লাথি মার ভাতের খবর বল” - এধরণের দুই শ্লোগান সমাজে অনেকেই বলে থাকেন। মাঝ মাঝে তা জেগে উঠে কিছু খুচরা হৈ চৈ তৈরির চেষ্টা করে।
এই দুই শ্লোগানের ধারণাই ভিত্তিহীন। দুটো শ্লোগানই একই চিন্তার উপর দাঁড়ানো। উভয়ে ধরে নিয়েছে নির্বাচনের ফলে ক্ষমতার জন্ম হয়। অথচ নির্বাচনে কেবল নির্ধারিত হয় আগে থেকে জন্ম নেয়া কোন ক্ষমতা আইনগত ভিত্তি পাবে কী না। কারণ, দুনিয়ায় এমন কোন আইন নাই যা থেকে ক্ষমতার জন্ম হতে পারে।
আইন ক্ষমতার উৎস নয়। ক্ষমতা নিজেই নিজের উৎস; বল খাটানোর মুরোদ।
উপরে বলা সব তত্ত্বকথা এখন উদাহরণে সাজাবো ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পূর্ব-পটভুমিতে। ঐ নির্বাচনকে বুঝতে চাইলে এর আগেই হয়ে থাকা নতুন ক্ষমতার ফ্রেমওয়ার্ক অর্থাৎ ক্ষমতার ভিত গাড়া আগেই কেমনে ঘটে বা তৈরি হয়ে গিয়েছিল সেই ফ্রেমওয়ার্ক এর খবর নিতে হবে। নাহলে ক্ষমতা প্রক্রিয়ার শেষ অধ্যায় কেবল নির্বাচনকে দেখে নতুন ক্ষমতাকে বুঝা ব্যাখ্যা করার হদিস ঠাহর করা যাবে না।
১৯৯১ সালের নির্বাচনের পিছনের ক্ষমতার ফ্রেমওয়ার্ক এর এক বিশেষ বৈশিষ্ট আছে। সেটা হলো ক্ষমতার এই ফ্রেমওয়ার্ক কোন ধরণের বড় পরিবর্তন ছাড়াই একই ফ্রেমওয়ার্ক হিসাবে এর পরের ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনের পিছনেও তা বজায় ছিল। সেজন্য কেউ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনকে বুঝতে পিছনের ক্ষমতা প্রক্রিয়ার হদিস পেতে গেলে ১৯৯১ সালেরটা বুঝে নিতে হবে। তবে, ১৯৯১ সালের ঐ বিশেষ বৈশিষ্ট কেন ছিল এরও ব্যাখ্যা পাওয়া দরকার। চেষ্টা করব, ১৯৯১ সালের পিছনের ক্ষমতা প্রক্রিয়ার হদিস নেয়ার সময় সাথে সেটাও ব্যাখ্যা করতে।
দুটা সিনারিও বর্ণনার করবে এখানে পরপর। একটা গ্লোবাল পরিপ্রেক্ষিতে বসে দেখে। অপরটা বাংলাদেশে বসে। আশির দশকের শেষ ভাগে ইরাকের কুয়েত দখলকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্য উত্তপ্ত হয়ে গ্লোবাল ঘটনা-প্রভাব হিসাবে হাজির হয়। বাবা অর্থাৎ সিনিয়র বুশ ইরাকে সামরিক হামলা করে বসেন।
ফেনমেননটকে গ্লোবাল বলছি এজন্য না যে আমেরিকা হামলা করেছে তাই। সত্যিকারভাবে বললে, ওয়ার্ল্ড হিস্টিক্যাল ঘটনাটা ছিল ১৯৭৯ সালের ইরানী বিপ্লব। সেদিকে এখন যাব না। তবে যার লেজ ধরা ঘটনা পরম্পরায় ১৯৯০ সালের বাবা বুশের ইরাক হামলা, ফেনমেননের সুপ্ত গ্লোবাল ভরপুর সম্ভাবনাটার এবার খোলা দৃশ্যমান হয়ে উঠা সেদিক নিয়ে কথা বলব।
বাবা বুশের বোমা হামলায় ইরাকীদের হত্যা দুর্দশা টিভিতে দেখতে এটা ইস্রায়েলের হাতে প্যালেস্টাইনী হত্যা নিপীড়ন দুর্দশার চেয়ে বড় কিছু আলাদা নয়।
ফলে একইভাবে তা আমাদের মানবিক স্বভাবকে ছুয়েছিল নিশ্চয়, তবে যা থেকে বড় জোর ভাবনা আসে দুরের কোন ঘটনা দেখছিলাম। টিভিতে দেখা ইরাকে বোমা হামলার ঘটনা একেবারে নিজের জানলার পাশের কোন ঘটনা এমন অনুভবের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না; এটা আম-কারও নিত্যদিনের নিজের জীবনকে প্রভাবিত করে না।
কিন্তু বাবা বুশের ইরাক হামলা এমন রুটিন কিছু ছিল না। দুনিয়ার যে কোন মহাদেশ কোণের প্রত্যেক সাধারণ জীবন যাপনের জন্য যায় আসে এমন গ্লোবাল প্রভাব এটা নিয়ে এসেছিল।
গ্লোবাল পুঁজির কারবারের দুনিয়ায় সিভিলাইজেশন গড়ে উঠেছে ফসিল ফুয়েলের উপর দাঁড়িয়ে।
সে অর্থে বলা যায় আমরা সবাই ফসিল ফুয়েল কেন্দ্রিক সিভিলাইজেশনের প্রকাশ, মাটির নীচের তেল নির্ভর হয়ে আমাদের জীবনের উৎপাদন পুনরুৎপাদন চলছে। ফলে যুদ্ধের কারণে তেলের দাম ও সরবরাহের এলোমেলো দশা খুব সহজেই দুনিয়ার সব সাধারণ বৈষয়িক জীবনে এলেমেলো দুর্দশার প্রভাব নিয়ে হাজির হয়েছিল। তাতে সে জীবন কোন কমিউনিষ্ট, ইসলামী আমেরিকান ইত্যাদি যারই হোক না কেন কোন ফারাক নাই। এই অতীষ্ট জীবনের ভিলেন কে? স্বভাবতই সবার তাৎক্ষণিক জবাব, আমেরিকা বা বুশের যুদ্ধের সিদ্ধান্ত। তাই চারিদিকে আমেরিকা-বিরোধী ঢেউ উঠতে দেখেছিলাম আমরা।
মিশাইল বা ট্যাঙ্কের মত মিডিয়া এক সমান গুরুত্ত্বপুর্ণ যুদ্ধাস্ত্র। জনমত, গ্লোবাল জনমত নিজের পক্ষে না হোক নিয়ন্ত্রণে রাখা যুদ্ধরত রাষ্ট্রের জন্য খুবই গুরুত্ত্বপুর্ণ। তাই যুদ্ধরত দেশ যুদ্ধের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে শুরুতেই বেরিয়ে পড়া, যুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন রাষ্ট্র শাসককে নিজের নৌকায় তুলে নেওয়ার চেষ্টা করা গুরুত্ত্বপুর্ণ কাজ। বিশেষত প্রত্যেক রাষ্ট্রের নাগরিকই যেখানে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ সেই গণস্বার্থকে উপেক্ষা করে আমেরিকার পক্ষে মৌন সমর্থন জানানো যখন সব রাষ্ট্র শাসকের জন্য কঠিন। কিন্তু তেলের বাড়তি দাম কার পকেট থেকে আসবে, কতক্ষণ আসবে, আদৌ তা সম্ভব কিনা - এগুলো গুরুত্ত্বপুর্ণ প্রশ্ন।
এই প্রশ্ন সামলাতে, বাংলাদেশের মত দেশগুলো সাময়িক সমাধান হিসাবে তা জনগণের উপর পাচার করবে হয়ত, যেটা একসময় সারা অর্থনীতির গতি স্লথ করবে। ফলে জীবনও। এক সমাধানহীন সমস্যার আবর্তে সকলে।
এখানে আমার মুল কথা হলো, দেশে দেশে আমেরিকা বিরোধী জনমত আমেরিকার গ্লোবাল স্বার্থের জন্য বড় ধরণের পোটেনশিয়াল থ্রেট। যা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আমেরিকার ষ্টেকহোল্ডার হয়ে থাকার শর্ত নড়বড়ে করে দিতে পারে।
ফলে এটা মোকাবিলায় পররাষ্ট্র বিভাগকে কিছু একটা করতে বেরিয়ে পরেছিল।
এই সিনেরিওর কথা এখানেই আপাতত থামিয়ে রেখে বাংলাদেশ সিনারিওতে যাব। বাংলাদেশের দিক থেকে সময়টা ছিল ১৯৮২ সাল থেকে চলে আসা এরশাদের শাসন, এর শেষ দিক। এই শাসন ক্ষমতার ষ্টেকহোল্ডার কনষ্ট্রাকশন কেমন ছিল এনিয়ে বিস্তারিতে যাব না, সংক্ষেপ শিরোনামে বলব।
আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক নিজের বিশেষ সংস্কার কর্মসুচী ১৯৮০-৮১ সাল থেকেই বাংলাদেশে ডেসপারেটলি বাস্তবায়নের এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
বাস্তবায়ন কাজে উপস্থিত কোন রাজনৈতিক দল সাথে থাকলে কর্মসুচী এদিক সেদিক বদল করতে হতে পারে, স্লথ হতে পারে ইত্যাদি – কিন্তু সেটুকু সহ্য করতেও তাঁরা রাজি ছিল না। আওয়ামী লীগ বিএনপি ধরণের দল এই কর্মসুচী ক্যারিয়ার হতে পারে এমন আস্থা তাদের ছিল না। ফলে সেবার লোকাল রাজনৈতিক এজেন্ট হিসাবে নড়বড়ে রাজনৈতিক দল বাদ দিয়ে এরশাদের নেতৃত্ত্বে একটা সামরিক কোটারীকে বেছে নেয় তাঁরা। আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক নিজেদের গঠনগত ম্যান্ডেট, আইনে নিজেরই সদস্যদেশের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নিজেকে জড়াতে পারে না। সেখানে ক্ষমতার ভিত গড়তে ষ্টেকহোল্ডারের ভুমিকায় হাজির হওয়া অনেক নিষিদ্ধ ও রিস্কি পথ।
এসব ক্ষেত্রে সাধারণত বড় মুরুব্বী যেমন আমেরিকান পররাষ্ট্র বিভাগকে লিভার বা যাতাকাঠি হিসাবে ব্যবহার করে থাকে তাঁরা। ফলে সেটা ছিল আনডকুমেন্টেড একটা জয়েন্ট এফোর্ট; জিয়া হত্যার মত ডার্টি কাজ এর পলিটিক্যাল দায়দায়িত্ত্ব পররাষ্ট্র বিভাগের আর এরপর কায়েম হওয়া এরশাদের সরকারের হাতে - কী করতে হবে সে কর্মসুচী তুলে দিয়ে গাইড করে সরকার চালানোর দায়িত্ত্ব আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক এর; এই ছিল কাজের ভাগাভাগির দিক। তবু এতটা প্রত্যক্ষ ভুমিকায় নেমে কাজ করা আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক এর রুটিন ফাংশনাল পদ্ধতি নয়; তবে বাংলাদেশে ঐবারই একবার এভাবে তাদের ভুমিকা দেখা গিয়েছিল। এর কারণ নিয়ে আমার অনেক আগের একটা পোষ্টে কিছু আলোচনা আছে।
এখানে আমার মুল কথা বাংলাদেশ থেকে কোন ধরণের ‘রাজনৈতিক’ ষ্টেকহোল্ডার এরশাদ আমলের ক্ষমতার ফ্রেকওয়ার্কের মধ্যে ছিল না।
যদিও ১৯৮১ সাল থেকেই কামাল হোসেন বহুবার চেষ্টা করেছিলেন অন্তত একটা সব-কন্ট্রাক্ট পেতে, যেটা সর্বশেষ ১৯৮৬ সালের স্বল্পস্থায়ী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এক গর্ভস্রাব হয়ে শেষ হয়ে যায়। ওদিকে কঠোর দমন নিপীড়নের ভিতর দিয়ে আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক এর প্রশাসনিক সংস্কার কর্মসুচী সদর্পে চলতে পেরেছিল। এতা এমনই দুর্দমনীয় ছিল যে ঐ সময়ের ক্ষমতার ফ্রেমওয়ার্ক যে ক্ষমতারূপ নিয়ে হাজির হয়েছিল সেই ক্ষমতাকে বৈধ করিয়ে নিতেও তাঁরা চিন্তিত ছিল না। এমন কোন এজেন্ডার বদলে সংস্কার কর্মসুচীকে দ্রুত শেষ করা ছিল ওদের কাছে মুখ্য বিষয়।
কিন্তু সব হিসাবে উলটা পালটা করে দেয় ১৯৯০ সালে বুশের ইরাক হামলা, নতুন গ্লোবাল পরিস্থিতি।
তেলের দামকে কেন্দ্র করে সব জিনিষপত্রের দামে বিপর্যস্ত ক্ষুব্ধ বাংলাদেশের মানুষ, চারিদিকে আমেরিকা বিরোধী জনমত – এই পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্র বিভাগ এরশাদের কাছে জনগণের ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে দাবি বা প্রস্তাব রাখলে এরশাদ নিজের সমস্যা হিসাবে আওয়ামী-বিএনপি জোটের কথা তুলে ধরেছিল। জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে এরা পুরা পরিস্থিতি এমন এলোমেলো করে তুলতে পারে যার উপর নিজেদেরসহ তা সবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে - স্মরণ করিয়ে ছিল।
এখানে তাহলে আমরা দেখছি, আগে ১৯৮২ সালের ক্ষমতা কাঠামো এবার টলমলে অকেজো হয়ে পড়ছিল; আর, এক নতুন ক্ষমতা ফ্রেমওয়ার্কের প্রয়োজন হাজির হয়েছিল। যা থেকে নতুন ক্ষমতা কাঠামোর দিশা দেখা যায়।
পররাষ্ট্র বিভাগ পরিস্থিতির সামগ্রিক বিবেচনায় সকলের কাছে নতুন এক ক্ষমতা ফ্রেমওয়ার্ক প্রস্তাব হাজির করেন এভাবেঃ ইরাক যুদ্ধ থিতু হওয়া পর্যন্ত জনগণের ক্ষোভ সামলানোর কাজে আওয়ামী-বিএনপি এরশাদকে সহযোগিতা দিবে, নিজেরা এই ক্ষোভকে এরশাদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের চেষ্টা করবে না।
যুদ্ধ থিতু হলে সংস্কার কর্মসুচী যতদুর যা হয়েছে একে মেনে নিয়ে সবাইকে তা আগিয়ে নিতে হবে – এই ব্রডার আন্ডারষ্টান্ডিংয়ের মধ্যে খোলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে যে জিতে আসবে সে সরকার গঠন করবে, আমেরিকার সাথে কাজ করবে।
এভাবে আওয়ামী-বিএনপি বলে ক্ষমতার ফ্রেম বড় করে দেওয়া ছাড়া কোন পাওয়ার ব্রোকারি আমেরিকার সম্ভব ছিল না। কারণ, এদের যে কাউকে বাইরে রেখে দিলে সে জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে পুরা পরিস্থিতি ওদের সবার জন্যই খারাপ করে তুলবে। এই অর্থে এই দুই দল তখন থেকে ষ্টেকহোল্ডার বলে স্বীকার করে নেয়া হলো।
এখন সমস্যা দেখা দিল, এরশাদের নেতৃত্ত্বে যে সামরিক কোটারি এতদিন রাজত্ত্ব করে গেছে এদের কী হবে? পুরানো ক্ষমতা কাঠামোয় তখনো তারা আছে, অভ্যস্তও বটে; এটা যেচে ভাঙ্গতে তাঁরা রাজি হবে কেন? রাজনীতিবিদদেরও ভয় ছিল ঐ সামরিক কোটারির কারণে নতুন ক্ষমতা কাঠামো খাড়া হতেই পারবে কী না। কাজেই এরশাদের নেতৃত্ত্বে সামরিক কোটারিকেই ক্ষমতার ষ্টেকহোল্ডার বোর্ডের থেকে নামিয়ে বাইরে রাখার দরকার অনুভুত হয়। কিন্তু কী করে?
ঐ সময়ের একটা গুরুত্ত্বপুর্ণ নতুন ফ্যাক্টরের কথা পাঠককে মনে করিয়ে দেয়া হয় নাই। বাংলাদেশে আমেরিকার পাওয়ার ব্রোকারিতে এর আগে কখনও দুই পার্টিই ক্ষমতার ষ্টেকহোল্ডার বোর্ডে তুলে নেয়া হয়েছে এমনটা হতে দেখা যায় নাই। ১৯৯১ এর প্রাক্কালে পররাষ্ট্র বিভাগ এটা করার কথা ভাবতে পেরেছিল নতুন সেই ফ্যাক্টরের কারণে।
১৯৮৯ সালের সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙ্গে যাওয়া হলো সেই ফ্যাক্টর। এতে কোল্ড ওয়ার যুগের পরিসমাপ্তিতে ব্লক রাজনীতির দিন শেষ হয়ে যায়। পররাষ্ট্র বিভাগ ভাবতে শুরু করে দুনিয়া এবার এক পোলের একা আমেরিকার দুনিয়া হতে যাচ্ছে। এই ভাবনায় ভরসা করে ফরেন পলিসিতে ব্যাপক সাহসী পরিবর্তন আনে। এগুলোর মধ্যে আমাদের আলোচ্য প্রসঙ্গের সাথে প্রাসঙ্গিক এমনি একটা বিষয় হলো, জাতিসংঘের শান্তি মিশন।
আমেরিকার ফরেন পলিসির পরিবর্তনের কারণে এর বড় ছাপ পড়েছিল সেখানে; কোল্ড ওয়ারের পরের জাতিসংঘের মিশন তৎপরতা সম্পূর্ণ ভিন্ন মানে নিয়ে হাজির হয়ে যায়।
আগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে কোন সিদ্ধান্ত আমেরিকা অথবা রাশিয়া কারো বিরুদ্ধে গেলে সে চেষ্টা করত ঐ নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যে অর্থ প্রয়োজন তা না যুগিয়ে সিদ্ধান্তটা অকেজো করে রাখতে। প্রতিষ্ঠান হিসাবে জন্ম থেকেই এটা জাতিসংঘের সীমাবদ্ধতা ছিল। এবার মিশন চালানোর খরচের সিংহভাগ নিজে যেচে বহন করা শুরু করে আমেরিকা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর এটা আমাদের মত দেশের সেনাবাহিনীকে কিনে ফেলে আমেরিকার জন্য নতুন সহজ কর্তৃত্ত্বের সুযোগ হিসাবে হাজির হয়।
এবারে আমেরিকার পছন্দের দেশকে মিশনে পাঠিয়ে সে দেশের সামরিক বাহিনীর উপর কর্তৃত্ত্ব হাসিল রাখা এখন অনেক সহজ।
এই সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশের সামরিক কোটারিকেই ক্ষমতার ষ্টেকহোল্ডার বোর্ডের থেকে নামিয়ে বাইরে রাখার দরকার পুরণ করার সহজ রাস্তা আমেরিকা পেয়ে যায়। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে শান্তি মিশনে সুযোগ দেবার বিনিময়ে ঐ সামরিক কোটারিকে রাজনৈতিক ক্ষমতার বাইরে রাখা হয়।
তবু কাজটা খুব সহজে ঘটানো যায়নি। কারণ এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হন একা এরশাদ, সে অর্থে জাতীয় পার্টি।
কোর কমান্ডার মিটিংয়ে বেতন বাড়ানোর লোভ দেখিয়েও তিনি সারা সামরিক প্রতিষ্ঠানকে নিজের পক্ষে রাখার শেষ চেষ্টা করেছিলেন, পারেননি।
সামরিক সদস্যরা অনুভব করেছিলেন, এরশাদের সামরিক শাসনের জোরে সমাজে অর্থ প্রতিপত্তি ক্ষমতা হয়ত দেখানো যায় কিন্তু টানা নয় বছর ততদিনে সমাজ বেকে বসেছে, সমাজের ড্রয়িং রুমগুলোতে একসাথে বসা কষ্টকর হয়ে গেছে; এক অস্বস্তিকর নীরবতা ঐ আসরে বিরাজ করে। এর তুলনায় মিশন করে আসছি একথায় আমেরিকার কাছে বিক্রি হয়ে গেছি একথা সত্য হলেও মিশনের আয়ের উপর একধরণের সামাজিক বৈধতার ছাপ দিতে সমাজ রাজি হবে।
তাই, নুরুদ্দিনের নেতৃত্ত্বে তাঁরা সবাই এরশাদের হাত ছেড়ে শান্তি মিশনের যাওয়ার প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নেয়। কিন্তু একারণে এরশাদ না আবার কিছু করে বসে ভেবে প্রিএম্পটিভ মেজার হিসাবে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে এরশাদের পদত্যাগ সময়গুলোতে আমরা সেনাদেরকে শহরে বেরিয়ে এসে ক্যাম্প করে থাকতে দেখেছিলাম।
এটা এরশাদের ক্ষমতা ছেড়ে দেবার পক্ষে তাদের সম্মতি পতাকা তুলে ধরাও বটে।
ওদিকে এরশাদের বিকল্প নতুন ক্ষমতা ক্রমশ আমরা দৃশ্যমান হতে দেখেছিলাম। এরপর শেষ পর্ব নির্বাচন, আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি যে জিতে তাকে বৈধ হিসাবে বরণ করে নেয়া। আর তারপর থেকে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যেই জিতে গৃহীত সেই ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যেই তাদের ক্ষমতা চর্চা সীমা।
পাট বুনা ছেড়ে পাটকল বন্ধ করে আমাদেরকে কেন দর্জি হতে হবে, অথবা দর্জিই যদিই হলাম তবে আমেরিকার বাজারে ঢুকতে কোটার নিয়ন্ত্রণ থাকবে কেন - ইত্যাদি এসব নিয়ে নতুন ক্ষমতা কাঠামোর লীগ, বিএনপি এরশাদ কারই প্রশ্ন তুলে সীমা অতিক্রম করার সুযোগ নাই।
বড় জোর একটা দেন দরবার আবদার করতে পারে। চ্যালেঞ্জ করতে পারে না। অথচ রাজনীতিতে বাকচাতুরীগুলো চলতে থাকে। আওয়ামী লীগ আদমজী বন্ধ হবার জন্য বিএনপিকে দায়ী করে, বিএনপি বাংলাদেশের অর্থনীতি গড়ার মুল কারিগর মনে করে সাইফুর রহমানকে, ভ্যাট সিষ্টেম চালুর আইডিয়া সাইফুরের মনে করে। এরশাদ উপজেলা ব্যবস্থা তাঁর স্বপ্ন, কৃতিত্ত্ব বলে দাবি করে ইত্যাদি।
উপরে ১৯৮২ সালের এরশাদের ক্যু করা, আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক এর রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোতে সরাসরি সংশ্লিষ্টতা, কিংমেকার ভুমিকার কথা বলেছি। এটা আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক এর ভুমিকা বাংলাদেশে নতুন ক্ষমতা তৈরির দিক থেকে তোলা কথা। কিন্তু গ্লোবাল ইকনমির দিক থেকে ঐ সময়টা ছিল আসলে আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক এর নতুন তত্ত্ব, - “এক্সপোর্ট অরিয়েন্টেড ইকনমি” নামে ঝাপিয়ে পরারও সময়। এই গ্লোবাল প্রোগ্রামে আমাদের মত দেশের অর্থনীতি ঢেলে সাজাতে বাধ্য করা হয়েছিল। এটা ছিল কনসেশনাল লোন পাবার পুর্বশর্ত, আর এই সুযোগের ভোক্তা বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিকে রপ্তানীমুখী করে সাজানোর কর্তৃত্ত্ব নেয়ার সময় ছিল সেটা।
তাই আমদের পাট ছেড়ে দর্জি হওয়া, কোটার জন্য কান্নাকাটি করা, আদমজী বন্ধ করা ইত্যাদি। ভ্যাট সিষ্টেম আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক এর দুনিয়াব্যাপী প্রোগ্রাম; সাইফুরের মাথার বুদ্ধি হওয়ার তো কোন কারণ নাই এবং এটা দুনিয়াব্যাপী প্রোগ্রাম কেবল বাংলাদেশের নয়। বিশ্বব্যাঙ্কের প্রোগ্রাম কোন একটা দেশের দিকে তাকিয়ে তৈরি ও কার্যকর করা হয়ও না। আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক এর কোন ধরণের লোনের কী শর্ত এভাবে তা হাজির করা থাকে। এরপর যেসব দেশ এই লোন নিবে এদের সবার উপর ঐ শর্তের কারণে বাধ্যতামুলকভাবে তা প্রযোজ্য হবে।
আর এরশাদের উপজেলার কথা আর কী বলব ইত্যাদি।
এগুলো হলো দল তিনটার গলার জোরে একে অপরের চেয়ে ভাল প্রমাণের রাজনীতি, “উন্নয়নের রাজনীতি"”। আর এখান থেকে এরা সরে আসলে কার বাক্সে লাশ নাই, ব্যক্তিগত কেচ্ছা কেলেঙ্কারি এইসব আমাদের রাজনীতি হবে এটাই তো স্বাভাবিক।
আমার গত পোষ্টে Click This Link প্রসঙ্গক্রমে নিক “ইচ্ছেফড়িং” এর এক প্রশ্নের প্রেক্ষিতে এই পোষ্ট লেখা লিখলাম। “ইচ্ছেফড়িং” এর সেই উস্কানিকে ধন্যবাদ জানাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।