আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোট গল্পঃ ক্র্যাচ !



অন্য দিনের চেয়ে আজ কিছুটা ভিন্ন দিন আবিরের কাছে। নদীরধারে বসে আজ আবির বেশ উৎফুল্ল মনে জলের দিকে তাকিয়ে আছে। আহাঃ অবশেষে সেই দিনটা তার জীবনে এলো। কতদিন এই জলের দিকে তাকিয়ে ভেবেছে- তার পুরোনো কাঠের ক্র্যাচগুলোর বদলে একজোড়া স্টীলের ক্র্যাচ কিনবে সে । কিন্তু এতগুলো টাকা সে কোথায় পাবে ! বাবা নিরুদ্দেশ, মায়ের সামান্য আয় দিয়ে সংসার চালানো রীতিমত কঠিন।

তার ওপর তার দুই বোনকে বিয়ে দিয়ে অনেক টাকা ধারদেনা হয়েছে মা। তাই তার স্বপ্নটা স্বস্ন হয়েই রয়েছে বহুকাল ধরে...... তবে আজ তার স্বপ্নটা বাস্তব হবে ! পাশের এলাকায় একটা ফোনের দোকানে ফরমায়েশ খাটে আবির । প্রথমে দোকানের মালিক কাজটা দিতে চায়নি তাকে। পরে কি ভেবে কাজটা দিল...বোধয় কিছুটা করূণা হয়েছিল। তবে বেতন মাত্র দু'শ টাকা আর দুপুরে রুটি-কলা।

তারপরও কাজটা পেয়েছে, এতেই খুশি। কতদিন ধরে টাকা জমাচ্ছে সে ! প্রায় বছর হয়ে এলো। মাঝে মাঝে টুকটাক বাজার করে। তা না হলে আরো আগেই ক্র্যাচ কেনার টাকা হয়ে যেত তার। দোকান থেকে ফেরার পথে বেশ অনেক দিন সে ক্র্যাচের দোকানের সামনে দাড়িয়ে থাকত।

থাই গ্লাসে ঘেড় দেওয়া । ভেতরে থরে থরে সাজানো নানান রকম ক্র্যাচ, হুইল চেয়ার। এর মধ্যে সে ক্র্যাচ পছন্দ-ও করে রেখেছে । দোকানের এক সেলস্ ম্যানের কাছে জেনেছে ওই ক্র্যাচ জোড়ার দাম বারশ টাকা ! কি সুন্দর রূপালী ক্র্যাচ ! ভাবতেই আনন্দের শিহরণ বয়ে যায়... আবিরের এখন চৌদ্দ চলছে। খুব ছোট বেলায় একটা রোগে তার ডান পাটা কেটে ফেলতে হয়েছিল।

এখন আর স্কুলে যায় না সে। স্কুলে তাকে সবাই কত কথা যে বলত... ভাবলেই চোখ ভিজে যায় তার ! তারচেয়ে এই-ই ভাল। সারাদিন কাজ করে সময় কেটে যাচ্ছে বেশ। আর সময় পেলেই এই নদীর ধারে বসে জলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সে। এই জায়গাটা তার খুব প্রিয়।

তার যখন খুব কষ্ট কিংবা আনন্দ হয় তখন সে এখানে বসে থাকে আর নদীটার সাথে মনে মনে কথা বলে। তার অনেক কথার সাক্ষি এই নদী। ........ আজ সে দোকান থেকে ছুটি নিয়েছে । সারাদিন বাড়িতেই ছিল। দোকানে গেল কি গেল না এই নিয়ে মা তাকে কোনদিন কৈফিয়ত করেনি।

বিকেলে যখন বের হল ক্র্যাচ কেনার জন্য তখন আকাশে বেশ মেঘ। প্রতিদিনই মেঘ হয় কিন্তু বৃষ্টি হয়না। বর্ষা আসতে এখনো মাস খানিক বাকি। বর্ষায় চলতে তার খুব কষ্ট হয়। কখন পিছলে পড়ে যাবে সেই ভয়টাই বেশি।

তারপরও পথ চলতে হয় এভাবেই..... এক পা-এ ! না না আড়াই পায়ে...তারতো ক্র্যাচসহ আড়াইটি পা ! মাঝে মাঝে রাস্তার ছেলেগুলো তাকে আড়াই পায়া বলে ক্ষ্যাপায় আর হেসে লুটোপুটি খায় । খুব কষ্ট পায় আবির ! তবুও এভাবেই চলছে নিষ্ঠুর দিনগুলো...... আবির যখন ক্র্যাচের দোকানটাতে পৌঁছাল তখন সূর্য প্রায় ডুবি ডুবি । গোধূলীর আলো এসে আছড়ে পড়েছে থাই গ্লাসের ওপর । কিযে ভাল লাগছে তার ! পছন্দের ক্র্যাচজোড়া কিনে দাম মেটালো । দোকানি ফিক্সড্ প্রাইস হওয়া স্বত্তেও তার কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা কম রাখল।

কতদিন দেখেছে ছেলেটাকে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। হয়তো সেজন্যই মায়া হয়েছে তার ! আবির ঠিক করল টাকাটা দিয়ে মা'র জন্য মিষ্টি কিনে নেবে । ....... দোকান থেকে বের হয়ে কিছুদূর যেতেই ঝুম বৃষ্টি । চায়ের দোকানের ছাওনির নিচে দাঁড়িয়ে কোনমতে মাথাটা বাঁচালো। আজ বৃষ্টিটাকে তার একটু-ও ভয় লাগছে না।

বরং নতুন উদ্দম বিরাজ করছে মনে। আহাঃ কতদিন পর তার স্বপ্নটা পূরণ হলো। মনে মনে ঠিক করল এবার তার বোনেদের বাড়িতে বেড়িয়ে আসবে । বৃষ্টি কমতে কমতে বেশ সন্ধা হয়ে গেল । রাস্তাটাও খানিকটা অন্ধকার আর নির্জন ।

বৃষ্টির কারণে রাস্তায় লোকজন কম । চারিদিকে তেমন কোন সাড়া শব্দ নেই শুধু তার ক্র্যাচ ফেলার ঠুক ঠুক শব্দ ছাড়া । মহা আনন্দে বাড়ি যাচ্ছে আবির নতুন আর স্বপ্নের ক্র্যাচে ভর করে !... তার পাশ কাটিয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে চলে গেল তিনটা ছেলে । সামনে কিছুদূর গিয়েই ওরা ফিরে তাকিয়ে আবির কে ডাকল- ''ওই ল্যাংড়া দাড়া। '' আবির থমকে দাড়িয়ে পেছন ঘুড়ে তাকালো ।

ওরা কাছে এসে বলল- '' কি আছে বাইর কর্ । '' পকেট হাতড়ে পঞ্চাশটা টাকা ওরা নিয়ে নিল । আবির ভয়ে কাঁপতে লাগল ! ''শালা ফকির। এই টাকায়তো কিছুই হইবো না । ওই- আরো থাকলে বাইর কর্ ।

'' ওরা আর কোন টাকা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিল হঠাৎ ওদের একজনের চোখ পড়ল আবিরের ক্র্যাচের দিকে । '' মনে হইতাছে নতুন মাল। চল্ এইডা নিয়া বেইচ্যা দেই...'' আবির কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেগুলো এক ঝটকায় ওর দু'হাতে ভর করে ধরে থাকা ক্র্যাচ দু'টো নিয়ে নিল । নিচে পড়ে গেল আবির ! ছেলেগুলো হো হো করে হেসে চলে গেল ওদের পথে । ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক আবির অন্ধকারে ওদের চলে যাওয়া পথের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ! আবার ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি শুরু হলো ।

এতকক্ষনে সংবিৎ ফিরে পেল সে । তার এতদিনের স্বস্ন মাত্র কয়েক মিনিটে ছিনিয়ে নিয়ে গেল দুষ্কৃতিকারীরা ! মানুষের অনেক বড় বড় স্বস্ন থাকে কিন্তু ছোট্ট আবিরের কাছে এক জোড়া রূপালী ক্র্যাচ অনেক বড় সোনালী একটা স্বপ্ন ! চিৎকার করে কেঁদে ওঠল আবির ! কিন্তু তার কান্না কেউ শুনতে পেল না, বৃষ্টির শব্দে ঢাকা পড়ে গেল ! একটা...দুটো...তিনটা...হাজার হাজার বৃষ্টি ঝরে পড়তে লাগল অন্ধকারে......... ঊর্মি খান তারিখঃ ২৯ মে, ২০১০ লেখার সময়ঃ বিকেল ৪ টা থেকে সন্ধা ৬ টা ৩০ মিনিট ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।