লোভ লালসার জন্য নয় বরং লোভ লালসার বিপরিতে নিজেকে উৎসর্গ করতে চাই
বাবরি মসজিদের জমি হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেয়ার রায় দিয়েছে ভারতের এলাহাবাদ হাইকোর্ট
ভারতের কয়েকটি টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে, রায় অনুযায়ী মুসলিমরা পাচ্ছে এক-তৃতীয়াংশ জমি। আর বাকি দুই-তৃতীয়াংশ জমি পাচ্ছে দুটি হিন্দু গোষ্ঠী। বার্তা সংস্থা পিটিআই জানায়, বিতর্কিত জমিটি সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখড়া এবং রাম লালা গোষ্ঠীর মধ্যে ভাগ করে দেয়ার রায় দিয়েছে আদালত। খবর রয়টার্স, পিটিআই, এনডিটিভির।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের তিন বিচারপতি এসইউ খান, সুধীর আগারওয়াল ও ডিভি শর্মার সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে এই রায় ঘোষণা করেন।
বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের অভিমতের ভিত্তিতে দেয়া রায়ে বাবরি মসজিদের ভূমির মালিকানা সমান তিন ভাগে ভাগ করে হিন্দু মহাসভা, মৌহি আখড়া ও সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের বলে ঘোষণা করা হয়। বাবরি মসজিদসহ সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের আওতাধীন মোট ৬৪ একর জমি সমান তিন ভাগে ভাগ করে দেয়া হবে। বিচারক এসইউ খান তার রায়ে বলেন, অযোধ্যার বাবরি মসজিদ মোগল সম্রাট বাবর নির্মাণ করেছিলেন, তবে তা রাম মন্দির ধ্বংস করে নয়।
আদালত এই রায় বাস্তবায়নে আগামী তিন মাসের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। আদালত তিন মাসের মধ্যে বিরোধপূর্ণ এই ভূমি তিন ভাগে ভাগ করে সীমানা চিহ্নিত করার জন্যও সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দেন।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) আন্তর্জাতিক সম্পাদক প্রাভিন তোগাদিয়া। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙায় এ দলটিও নেতৃত্বে ছিল। ওদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের আইনজীবী শংকর প্রসাদ সাংবাদিকদের বলেছেন, স্থানটি রামের জন্মস্থান ছিল বলে রায়ে স্বীকৃতি মিলেছে।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের আইনজীবী জাফরিয়াব জিলানি জানিয়েছেন, তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রায়ের মধ্য দিয়ে আমরা বিতর্ক নিরসনে একধাপ এগিয়েছি। কিন্তু এর বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।
প্রসঙ্গত, ১৬ শতকে নির্মিত বাবরি মসজিদ ভবনটি অযোধ্যার ২ দশমিক ৭ একর জমিতে অবস্থিত। এছাড়াও আশপাশের জমিসহ ৬৪ একর জমি নিয়ে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের দাবি, ১৫২৮ সালে যেখানে বাবরি মসজিদটি নির্মাণ করা হয়, তা হিন্দুদের দেবতা রামের জন্মস্থান।
হিন্দুরা এ জমি অখিল ভারত হিন্দু মহাসভার বলে দাবি করে আসছে। অন্যদিকে মুসলমানদের দাবি, এ জমি সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডের। এ বিরোধের এক পর্যায়ে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর উগ্র হিন্দুরা মসজিদটি ভেঙে ফেলে। এরপর ভারতজুড়ে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রায় ২ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।
উগ্র হিন্দুরা ঐতিহাসিক এ স্থাপনার জায়গায় মন্দির নির্মাণ করতে চায়। আর মুসলমানরা চায় মসজিদটি পুনঃনির্মাণ করতে।
মামলার রায় ঘোষণা উপলক্ষে সারা ভারতে প্রায় দুই লাখ নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন করা হয়। পাশাপাশি বিমানবাহিনীকেও রাখা হয় সতর্ক অবস্থায়। তবে রায়ের পর তাত্ক্ষণিকভাবে সহিংসতার কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী, সাধারণ সম্পাদক রাহুল গান্ধী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি, রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এ রায় মেনে নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তারা দেশবাসীকে সব ধরনের সহিংসতা এড়িয়ে আদালত ও রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানান।
ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা যশোবন্ত সিনহা স্থানীয় টেলিভিশনে বলেন, রায়ে কেউ জেতেনি, কেউ হারেনি। তাই এ রায়কে কারও জয় হিসেবে দেখার কিছু নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অনিল বর্মা বলেন, খুবই বিচক্ষণ রায় হয়েছে।
আদালত দুপক্ষেই ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছে।
বেশ কয়েকটি মুসলিম সংগঠন রায়ে হতাশ হলেও তারাও সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর এই বেঞ্চেরই বাবরি মসজিদ মামলার রায় দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে পারে—এ আশঙ্কায় মামলার রায় পিছিয়ে দেয়ার আবেদন জানিয়ে উত্তরপ্রদেশের অবসরপ্রাপ্ত আমলা রমেশচন্দ্র ত্রিপাঠি সুপ্রিমকোর্টে একটি আবেদন করেন।
সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি আলতামাস কবির ও বিচারপতি একে পট্টনায়েকের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ তার এ আবেদন খারিজ করে তা উপযুক্ত বেঞ্চে দাখিল করার নির্দেশ দেন।
পরে রমেশচন্দ্র আবার সুপ্রিমকোর্টে আবেদন জানালে বিচারপতি আরভি রবীন্দ্রনের নেতৃত্বে গঠিত দুই সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ এ মামলার রায় ঘোষণা পাঁচদিনের জন্য পিছিয়ে দিয়ে ২৮ সেপ্টেম্বর শুনানির দিন ধার্য করেন।
এরপর সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি এসএইচ কাপাডিয়ার নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের একটি ডিভিশন বেঞ্চ গত মঙ্গলবার শুনানি শেষে মামলা পেছানোর আবেদন খারিজ করে দেন। এরপরই এলাহাবাদ হাইকোর্ট থেকে জানিয়ে দেয়া হয়, ৩০ সেপ্টেম্বর বিকাল সাড়ে ৩টায় মামলার রায় দেয়া হবে।
রায় ঘোষণার পর যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সে জন্য ভারতজুড়ে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। দেশটির সরকার ৩২টি স্থানকে স্পর্শকাতর হিসেবে চিহ্নিত করে।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম নিজেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা তদারক করেন। উত্তরপ্রদেশে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সেখানে এক লাখ ৭০ হাজার নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যে কোনো ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা শনাক্ত করার কাজে তত্পর রয়েছে। দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৮টি বিমানঘাঁটিতে মোতায়েন রাখা হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীকে।
এদিকে কর্নাটক সরকার দুদিনের জন্য রাজ্যের সব স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে। পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র জারি করা হয়েছে সতর্কতা। সীমান্তে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। কলকাতার ৪৮টি থানার মধ্যে ১৮টিকে স্পর্শকাতর চিহ্নিত করে সেখানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
প্রতিক্রিয়া : রায়ের পর উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী বলেন, ‘আমরা এটা বলতে পারছি না যে, এটাই চূড়ান্ত রায়।
যে কোনো পক্ষ সুপ্রিমকোর্টে আপিল করতে পারবে। আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আহ্বান জানাচ্ছি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছি। উত্তরপ্রদেশে যিনি শান্তিবিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করবেন, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব। ’
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সিনিয়র নেতা ডি. রাজা বলেন, ‘আদালত বলেছে, বিরোধপূর্ণ ভূমির মালিক উভয়পক্ষ।
এখন ইস্যুটাকে রাস্তায় টেনে আনা ঠিক হবে না। ’
বিজেপির মুখপাত্র নলিন কোহলি বলেন, ‘শান্তির বৃহত্তর স্বার্থে আদালত একটা সমাধান বাতলে দিয়েছে। এতে রামমন্দির নির্মাণের পথ খুলে গেছে। সবপক্ষ এখন সমঝোতায় এলে কাঁটা দূর হয়ে যাবে। ’
হিন্দু জাতীয়তাবাদী গ্রুপ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান মোহন ভগবত বলেন, ‘এটাকে জয় অথবা পরাজয় হিসেবে নেয়া আমাদের জন্য উচিত হবে না।
বরং এটা দেশের স্বার্থে ঐক্য রচনার একটা সুযোগ। ’
মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের অন্যতম সদস্য কামাল ফারুকী বলেন, ‘আইনের শাসন গ্রহণযোগ্য। জাতির স্বার্থে আমরা মসজিদ ও মন্দিরের সহাবস্থান মেনে নিতে পারি। ভারত এখন একটি পরিণত জাতি। আর আমরা এগিয়ে যেতে চাই।
’
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘অযোধ্যায় একটি দুর্দান্ত রামমন্দির নির্মাণের পথ খুলে গেছে। তবে উন্মত্ততা সৃষ্টির সুযোগ নেই। ’
হিন্দু মহাসভার উপদেষ্টা এইচএস জেইন বলেন, ‘আমরা আপিল জানাব। তিন ভাগের এক ভাগ নয়, একটি ধূলিকণাও মুসলমানরা পেলে আমরা তা মানতে পারি না। ’
কংগ্রেস নেতা সত্যব্রত ত্রিবেদী বলেন, ‘কোনো পক্ষের স্পষ্ট বিজয় যেহেতু এ রায়ের মাধ্যমে চিহ্নিত হয়নি, সেহেতু বিবদমান পক্ষগুলোর এটা মেনে নেয়া দরকার, তাদের এখানে একসঙ্গে বসবাস করতে হবে।
আমার মনে হয়, আদালতের বাইরে একটা সমঝোতা হয়ে যেতেও পারে। ’
ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির মতে, ‘দল মনে করছে, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সুপ্রিমকোর্টই একটা সমাধান উপহার দিতে পারে। ’
কেন্দ্রীয় আইন ও বিচারমন্ত্রী এম. ভিরাপা মইলি বলেন, ‘নানাভাবে রায়টিকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। রায়ের পুরো কপি হাতে আসার পর মন্তব্য করার অবস্থা তৈরি হবে। ’
মধ্যপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী উমা ভারতি বলেন, ‘হাইকোর্ট মেনে নিয়েছে জায়গাটিতে রাম জন্মেছিলেন।
এটা আমার জীবনের সবচেয়ে সুখকর মুহূর্ত। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।