অনেক কিছু করে ফেলার শখ, কিন্তু কোন বিষয়ে নিজের প্রতিভা আছে বা আদৌ কোন বিষয়ে প্রতিভাবান কিনা, সেটাই বের করতে পারি নি এখনো।
১.
বেলা ১০টা ২৫ পঁচিশ বাজে। মনসুর আলি বারান্দায় চেয়ারে বসে আছেন। তার মেজাজ কিছুটা খারাপ। এ সময়ে তার প্রতিদিনই মেজাজ খারাপ থাকে।
তবে আজকের মেজাজ খারাপের কারন একটু অন্য রকমের।
মনসুর আলি নিয়মিত ফজরের আজানের সাথে সাথে ঘুম থেকে উঠেন। ফজরের নামাজ শেষ করে কিছুক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করেন। এরপর কিছুক্ষণ ছাদে হাঁটাহাঁটি করেন তিনি। কোন কোন দিন এসময় তার সাথে থাকে তিথী।
বাপ-মা মরা এ মেয়েটা যতটা না তার পুত্রবধূ, তার চেয়ে বেশি মেয়ে।
নয়টার দিকে নাতনী তিতলির স্কুল। তাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে দোকানে যায় মারুফ। বঙ্গবাজারে তার কাপড়ের দোকান। এরপর তিথীও চলে যায় তার কাজে।
একটা কোচিং সেন্টারের টিচার সে। তিথী চলে যাওয়ার পর বাসাটা পুরো খালি হয়ে যায়, আর সাথে সাথে মনসুর আলির মেজাজ খারাপ হতে থাকে। সংসারের এমন টানাটানি অবস্থা না যে, ঘরের বৌকেও চাকরি করতে হবে। মারুফের সংসারের প্রতি তেমন মনোযোগ নেই। মাসের খরচের টাকাটা দিয়েই সে খালাস।
নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্যই তিথীর চাকরি করা।
আজকে সকালে নাস্তার টেবিলে ছেলেকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছেন মনসুর আলি। এ রকম চলতে দেয়া যায় না। বাসাটা দিন দিন মেসের মত হয়ে যাচ্ছে। সবার মধ্যে ছাড়া ছাড়া ভাব।
নাতনিটা বড় হচ্ছে একরকম বাবা মাকে ছাড়াই। অথচ রেহনুমা বেঁচে থাকতে সবকিছু নিয়মের মধ্যে ছিল। তার মৃত্যু সংসারটাকে কেমন যেন খাপছাড়া করে দিয়েছে।
২.
সেই কবে কোন এক রোজায় রেহনুমা নামের এই বালিকাকে বিয়ে করে ঘরে এনেছিলেন মনসুর আলি। রোজা রমজানের দিনে সাধারনত বিয়েশাদি হয় না।
মেয়ের বাবা বিদেশ চলে যাবে এজন্য তাড়াহুড়ার মধ্যেই বিয়েটা হয়ে গেল। বাসর রাতে সেহরির পর বারান্দায় চাঁদের আলোতে এই অসম্ভব রূপবতী মেয়েকে দেখে মনসুর আলি বিড়বিড় করে গেয়ে উঠেছিলেন,
বর মাল্য খানি তব আনো বহে, তুমি আনো বহে
অবগুন্ঠন-ছায়া ঘুচায়ে দিয়ে,
হের লজ্জিত স্মিত মুখ শুভ আলোকে
বধু কোন আলো লাগলো চোখে
রেহনুমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই মনসুর আলি কখনোই এই আলোর রহস্য উন্মোচন করতে পারেননি।
রূপবতী মেয়েরা সাধারণত শান্তশিষ্ট স্বভাবের হয়। রেহনুমা ছিল তার উল্টো। বিয়ের দুই দিন যেতে না যেতেই তার চঞ্চলতা প্রকাশিত হতে লাগল।
ঈদের আগের রাতে বাড়ির মেয়েছেলেরা কেউ নকশী পিঠা বানাচ্ছে, কেউবা হাতে ঘোরানো কলে সেমাই বানাচ্ছে। সেদিকে তার নজর থাকলে তো। সে চলে গেছে বাচ্চাকাচ্চাদের আতশবাজি পোড়ানো দেখতে। রাতে বাড়িতে পুঁথিপাঠের আসর বসে। পুঁথিপাঠক বশির মিয়া সুর করে টান ধরে,
তারপরে একরাতে স্বপ্নে দেখিলো সুন্দরী।
দীঘির পানিতে আছে এক রাজপুরী। ।
সেইখানে আছে এক রাজপুত্র সুন্দর।
আশেক হইয়াছে তার কমলার উপর। ।
কমলারে পাইতে চায় আপন করিয়া।
কমলার লাইগা তার কান্দিছে হিয়া। ।
মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পুঁথি পাঠ করছে বশির মিয়া। তার চেয়েও বেশি দুলছে রেহনুমার মাথা।
ঈদের দিন বাবা সবাইকে সালামী দিতেন। বাবার সালামী দেয়ার নিয়ম হল, যার যত বয়স তার দ্বিগুণ টাকা সালামী হিসেবে দেয়া হবে। তো ঈদের দিন বাবা সালামী দিয়ে ঈদের নামাজে চলে গেলেন। বয়সের হিসাবে রেহনুমার পাওয়ার কথা ছত্রিশ টাকা। অথচ বাবা তাকে দিয়ে গেছেন পঁয়ত্রিশ টাকা।
একটাকার জন্য তার সেকি ফুঁফিয়ে কান্না।
এই আশ্চর্য চঞ্চলমতি বালিকা কিভাবে মারুফের জন্মের পর এত সংসারি হয়ে গেল মনসুর আলি টেরও পাননি। সে যতদিন বেঁচে ছিল কখনো টের পাওয়ার প্রয়োজনও পড়েনি।
৩.
শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা সেরে বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল তিথীর। আজকে চাঁদ দেখা গেলে কালকে ঈদ।
তিথীর কাছে ঈদ ঈদ মনে হচ্ছে না। ঈদ তার নিঃসঙ্গতা কাটাতে পারে না। বরং ঈদ এলে যেন মারুফের ব্যস্ততা আরো বেড়ে যায়। দোকান বন্ধ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে মধ্যরাত।
তাদের বিয়েটা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ ছিল।
মূলত তার শাশুড়ির আগ্রহের কারনেই বিয়েটা হয়। এই মহিলা কোন কারন ছাড়াই তিথীকে অসম্ভব ভালবাসতেন। কোন কারন ছাড়াই বলাটা ভুল হল মনে হয়। তার শ্বশুর-শাশুড়ির কোন মেয়ে নেই। একারনেই হয়ত বৌ হয়েও বাড়ির মেয়ের মতই আছে সে।
একরকম সুখের সংসারই ছিল তার। কিন্তু গত রোজাতে তার শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর থেকেই কোথায় যেন তালটা কেটে গেছে। তার শ্বশুর কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। মারুফও কাজেকর্মে ব্যস্ত হয়ে গেল। সময় কাটানোর জন্যই তিথী চাকরি নিল।
মেয়েটা স্কুল থেকে ফেরার পর সারাদিন দাদার সাথেই থাকে, কিন্তু তাতে তো আর বাবা-মায়ের অভাব পূরন হয় না। তিথী সেটা ভালোই বুঝতে পারে, কিন্তু তার বুঝতে ইচ্ছে হয় না। দাদার সাথে তার ভালোই ভাব, সময় খারাপ কাটছে বলে মনে হয় না। আপাতত তিথীর সব ভাবনা তার শ্বশুরকে ঘিরে। রোজা আসার পর থেকেই মানুষটা কেমন যেন মনমরা হয়ে আছেন।
তিথী ঠিক করেছে তাকে একটা সারপ্রাইজ দিবে। মারুফের দোকানে তিতলির জন্য একটা লাল বেনারসি শাড়ি পছন্দ করে এসেছে সে। এখন মারুফ সময়মত ফিরলেই হয়।
মারুফ আজকে ইফতারের আগে আগেই ফিরে এসেছে। তিতলির বেনারসি তো এনেছেই, সাথে একটা বক্সে তিথীর জন্য একগাদা বই আর একমুঠো লাল গোলাপ।
ঈদের উপহার হিসেবে বই-লাল গোলাপ ঠিক যায় না, তারপরও তিথী অনেক খুশি। খুশিতে রীতিমত তার চোখে পানি আসার জোগাড়। কোনমতে মাথা নিচু করে চোখের পানি লুকাল সে। এখন কান্নার সময় নেই। তার অনেক কাজ।
তিতলিকে সুন্দর করে সাজাতে হবে। নিজের আনন্দ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হয়। একটা ধাঁধাঁ আছে, কোন জিনিস কাটলে বাড়ে। উত্তর হচ্ছে পুকুর। ধাঁধাটার আরেকটা উত্তর থাকা দরকার ছিল – আনন্দ।
আনন্দ ছড়ালে কমে না বরং বাড়ে।
৪.
মনসুর আলি ছাদে দাঁড়িয়ে আছেন। ঈদের চাঁদ উঠেছে। কাস্তের মত রূপালী চাঁদ। এক রূপালী চাঁদ একদিন তাকে দুহাত ভরে দিয়েছে।
আবার এক রূপালী চাঁদ সব কেড়ে নিয়েছে। চাঁদের সাথে তার ঠিক বনিবনা হচ্ছে না। তিতলি কখন এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে তিনি টের পান নি। টের পেলে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখতে পারতেন তিনি।
“ভাইয়া, চাঁদ কই?”
“ওই যে, বড় তারাটার নিচে দেখ।
” মনসুর আলি আকাশের দিকে তাকিয়েই জবাব দিলেন।
“চাঁদের বুড়ি কই, ভাইয়া?”
“বুড়ির ছেলেরা বুড়িকে শাড়ি কিনে দেয় নি তো। এজন্য বুড়ি মন খারাপ করে লুকিয়ে আছে। ”
“তাহলে আমার শাড়িটা বুড়িকে দিয়ে দেই?”
মনসুর আলি তিতলির দিকে তাকালেন। লাল বেনারসি পরে লাল টুকটুকে বউ সেজেছে সে।
শাড়ি কায়দা করতে গিয়ে কিছুটা অসুবিধায় আছে সে। মাথায় ইয়া বড় ঘোমটা। নাকে নাকফুল। তিতলির নাক ফোঁড়ানো হয়নি। নাক না ফুঁড়িয়ে নাকফুল কিভাবে পরেছে কে জানে।
তার মুখভর্তি পান। পান নিয়েও বেকায়দাজনক পরিস্থিতি। পানের পিক ফেলা যাচ্ছে না। পিক ফেলতে গেলে পান সহ বেরিয়ে আসছে। সব বেকায়দা সামলে তার মুখে মিটিমিটি হাসি।
মনসুর আলি নাতনির অবস্থা দেখে হো হো করে হেসে ফেললেন। তিনি ঠিক করলেন, এবার ঈদে সবাইকে সালামী দিবেন। যার যত বয়স তার দ্বিগুণ টাকা সালামী হিসেবে দেয়া হবে। তিতলি পাবে আঠারো টাকা। তার ছেলে পাবে বাষট্টি টাকা।
তিথী কত পাবে বুঝতে পারছেন না। তার বয়সটা জেনে নিতে হবে। বুড়িটা বেঁচে থাকলে তাকে দিতে হত একশ দুই টাকা। মনসুর আলি ইচ্ছা করেই দুই টাকা কম দিতেন। দুই টাকা নিয়ে মান অভিমান চলত।
মান ভাঙ্গানোর জন্য জীবনানন্দ বাবুর ডাক পড়ত।
মেঘের বুরুজ ভেঙে অস্তচাঁদ দিয়েছিল উঁকি
সে কোন্ বালিকা একা অন্তঃপুরে এল অধোমুখী!
পাথারের পারে মোর প্রাসাদের আঙিনার পরে
দাঁড়াল সে- বাসররাত্রির বধু-মোর তরে, যেন মোর তরে!
এরমধ্যে তিথী এসে তিতলির পাশে দাঁড়িয়েছে। তারমুখ হাসি হাসি। কাউকে খুশী করতে পারার হাসি। রূপালী চাঁদ দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে।
তিন নিঃসঙ্গ মানুষের হাসি মিলিয়ে যাচ্ছে না। নিচে ছেলেপেলেরা আতশবাজি পোড়াচ্ছে। চারদিকে খুশির আমেজ। এই আমেজে মিশে যেতে পারলে মন্দ হয় না। ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।