বোতলজাত পানির ক্ষতিকর দিক নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে উদ্বেগ বাড়ছে। নিত্য নতুন গবেষণায় বেরিয়ে আসছে, বোতলজাত পানি কোনমতেই নিরাপদ ট্যাপের পানির চেয়ে স্বাস্থ্যকর নয়, বরং ক্ষতির পরিমাণ তাতে অনেক বেশি। কারণ যেসব উপাদান দিয়ে প্লাস্টিকের বোতল তৈরি হয়, তা পানিতে এমন কিছু রাসায়নিক উপাদান ছড়িয়ে দেয়, যা পানকারীর স্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
প্লাস্টিক থেকে পানিতে ছড়িয়ে পড়া রাসায়নিক পদার্থকে বিজ্ঞানীরা মানবদেহের হরমোন বা প্রাণরস বিপর্যয়কারী উপাদান বলছেন। কারণ এসব রাসায়নিক পদার্থ মানবদেহে প্রবেশের পর হরমোনের স্বাভাবিক কাজে বাধা দেয়।
পাশাপাশি মুটিয়ে যাওয়া, অকালে যৌবনের চিহ্ন দেহে ফুটে ওঠা, উর্বরতা বা সন্তান জন্মদানের হার কমে যাওয়া, স্তন ক্যান্সার, প্রোস্ট্রেট ক্যান্সার, জরায়ু ক্যান্সার, হাইপারঅ্যাকটিভ শিশু, অটিজম, হৃদরোগও এসব রাসায়নিক পদার্থের কারণে হচ্ছে বলে গবেষকরা দাবি করছেন। বিজ্ঞানীরা এসব রাসায়নিক পদার্থের নাম দিয়েছেন 'এন্ডোক্রাইন ডিজরাপ্টটার্স'। এন্ডোক্রাইন হচ্ছে দেহের এমন একটি গ্রন্থি যা থেকে নির্গত রস রক্তের মাধ্যমে আমাদের টিস্যুতে পৌঁছে। তারা বলেছেন, প্লাস্টিকের ক্ষতিকর উপাদান পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে দেহে ঢোকার পর তা প্রাকৃতিক এস্ট্রোজেনের মতই আচরণ করে। এতে দেহের হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জসিমউদ্দীন আহমেদ বলেন, তাপ লাগলে বোতলের পানিতে খুব দ্রুত রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। এ পানি মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে।
চটকদার বিজ্ঞাপনের মোড়কে মিনারেল ওয়াটার হিসেবে বিশ্বে যে পানি বাজারজাত হচ্ছে, তার খনিজ মান নিয়ে শুধু পশ্চিমা বিশ্বেই নয়, আমাদের দেশেও প্রশ্ন উঠেছে অনেক আগে। হালে শুধু বোতলজাত পানির মান নয়, এ পানির রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া ও প্লাস্টিক বোতল ও কন্টেইনারের পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিক নিয়েও হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হচ্ছে।
পরিবেশবাদীরা প্লাস্টিক বোতল ও কন্টেইনারের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে নানা উপাত্ত দিচ্ছেন আর গবেষকরা বোতলজাত পানির রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করছেন।
দ্বিমুখী এ গবেষণার ফলে যেসব তথ্য বেরিয়ে আসছে, তা বিলিয়ন ডলারের এ পানি শিল্পের ভবিষ্যতকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের বুন্ডানন শহর ২০০৯ সালের জুলাই মাসের শুরুতেই বোতলজাত পানির বিপণন চূড়ান্তভাবেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এলাকাবাসীর চাপে ব্যবসায়ীরাও বোতলজাত পানি বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শহর কর্তৃপক্ষ বিপুল উদ্যমে এখন নিরাপদ ট্যাপের পানি সরবরাহ করছে।
আমেরিকার ন্যাচারেল রিসোর্সেস ডিফেন্স কাউন্সিল চার বছর ধরে দেশটির এক হাজার ব্রান্ডের বোতলজাত পানি নিয়ে গবেষণার পর সরকারকে জানিয়েছে, বোতলজাত পানি কোন মতেই ট্যাপের পানির চেয়ে স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ নয়।
তারা তাদের গবেষণায় বেশ কিছু বোতলজাত পানিতে ব্যাকটেরিয়া দূষক যেমন পেয়েছেন, তেমনি কিছু ব্রান্ডের পানিতে শিল্পজাত দ্রাবক, প্লাস্টিক থেকে নির্গত রাসায়নিক উপাদানের (ট্রাইহেলোমিথেনস নামে পরিচিত এ রাসায়নিক উপাদানটি পানিতে মেশানো ক্লোরিন ও অর্গানিক উপাদানের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় উৎপন্ন এক প্রকার উপজাত) মতো ক্ষতিকর সিনথেটিক জৈব রাসায়নিক পদার্থ শনাক্ত করেছেন। কিছু বোতলে তা আর্সেনিকের মত অজৈব দূষকও খুঁজে পেয়েছেন।
নানা ধরনের প্লাস্টিক দিয়ে এসব তথাকথিত মিনারেল ওয়াটারের বোতল তৈরি হয়। এসব প্লাস্টিকের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে পলিএথিলিন টেরেফথালেট বা পিইটি। এ প্লাস্টিক তৈরির মূল উপাদান হচ্ছে খনিজ তেল।
গবেষকরা বলেছেন, বোতলজাত পানিতে যে মাত্রায় ক্লোরিন মেশানো হয়, তাতে পানির অপকারি ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি উপকারি ব্যাকটেরিয়াও মারা যায়। আর এটার চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে, মানবদেহের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমশ দুর্বল বা অকার্যকর হয়ে যাওয়া। গবেষকরা এটাও বলেছেন, গ্লাস তৈরির জন্য কাচ তৈরিকালে যে পরিমাণ ক্ষতিকর পদার্থ নির্গত হয়, সমপরিমাণ প্লাস্টিক তৈরিতে তার চেয়ে একশ' গুণ বেশি ক্ষতিকর পদার্থ নির্গত হয়। সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে, এসব প্লাস্টিক মাটিতে মিশে যেতে হাজার বছর লাগবে। এনআরডিসির গবেষকরা এটাও বলেছেন, পানিতে বিদ্যমান কিছু মাইক্রো-অর্গানিজম মানব স্বাস্থ্যের জন্য খুব একটা বিপজ্জনক নয়।
কিন্তু বোতলজাত হবার পর তা সত্যি বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারে।
আরেকটি গবেষণায় পশ্চিমা বিশ্বের বিখ্যাত বোতলজাত পানি নেলজিনে 'বিসফেনল এ' (বিপিএ) শনাক্ত করেছেন। এটা এমন একটি সিনথেটিক ক্যামিকেল যা মানব দেহের স্বতঃনির্গত হরমোন ম্যানেজিং সিস্টেমে বাধা সৃষ্টি করে। 'এনভায়রনমেন্ট ক্যালিফোর্নিয়া রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি সেন্টার' এই বিপিএ-এর উপর পরিচালিত ১৩০টি গবেষণার ফল পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, 'ব্রেস্ট ক্যান্সার, জরায়ুর ক্যান্সার, অকালে গর্ভপাতের ঝুঁকি, টেস্টাটেরন (পুরুষের শুক্রাশয়ে উৎপন্ন হরমোন) লেভেল কমে যাওয়ার সঙ্গে বিপিএ সম্পর্কিত। তারা বলেছেন, বিপিএ-এর কারণে শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
পিতামাতাদের এটা মনে রাখা উচিত বেবি-বোতল ও পেয়ালাতে যে প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়, তাতে বিপিএ রয়েছে। '
সম্প্রতি ডিসকভারি নিউজের একটি আর্টিকেলে দাবি করা হয়েছে, জার্মান বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন প্লাস্টিক বোতলে যে পিইটি রাসায়নিক থাকে, তা পানিতে মিশে দেহে হরমোন বিঘ্নকারী ক্যামিকেলে পরিণত হয়। ফ্রাঙ্কফুর্টের গোথে ইউনিভার্সিটির ইকোটক্সিকোলজিস্ট ও শীর্ষ গবেষক মার্টিন ওয়েগনার বলেছেন, 'প্লাস্টিকে যেসব রাসায়নিক উপাদান রয়েছে, তার সব কটির ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনো জানতেই পারেননি। ' মার্টিন ওয়েগনারের গবেষণার ফলের সমর্থনে নিউ ইয়র্কের ইউনিভার্সিটি অব রোচেস্টার স্কুল অব মেডিসিন অ্যান্ড ডেন্টিস্ট্রির ইপিডোমিনোলজিস্ট শান্না সোয়ান বলেছেন, 'আমরা তো এটাই দেখতে পাচ্ছি, প্লাস্টিক বোতলের কফিনে আরেকটি পেরেক ঠুকে দেয়া হচ্ছে। '
প্লাস্টিক বোতল গ্লোবাল ভিলেজ বা ভূবনগাঁয়ে 'থ্রোঅ্যাওয়ে কালচার' বা ছুঁড়ে ফেলার সংস্কৃতি চালু করেছে।
আমরা এখন মিনারেল ওয়াটার পান করে তা ছুঁড়ে ফেলছি। কিন্তু বিজ্ঞানীদের গবেষণা এটাই প্রমাণ করছে প্লাস্টিক বোতলও আমাদেরকে জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলছে অকাল মৃত্যুর দরজার দিকে।
প্লাস্টিক বোতলের ক্ষতিকর দিকটিও মোটেও উপেক্ষার নয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মার্কিনীরা প্রতি বছর ২৯ বিলিয়ন পানির বোতল ডাস্টবিনে ফেলে। এই সংখ্যক বোতল বানাতে ১৫ লাখ ব্যারেল তেল লাগে, যা দিয়ে এক লাখ মোটর গাড়ি এক বছর চালানো যায়।
আর ১৫ লাখ ব্যারেল তেল থেকে প্লাস্টিক বানাতে বায়ুতে মিশে ২৫ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড। এসব বোতল অপসারণ করতেও সরকারকে গুনতে হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, প্লাস্টিক বোতলজাত পানি নিয়ে গুটি কয়েক গবেষণার মাধ্যমে হয়তো এ পৃথিবীকে রক্ষা করা যাবে না, কিন্তু রক্ষার সূচনা হয়ে গেছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।