মিথিলা বৈশাখীর জীবনে সন্তান আসার পর বুঝতে পারলেন নিজের ভুল। তার আদরের ছোট্ট সোনামণিটি থ্যালাসেমিয়ার মতো কঠিন রোগে আক্রান্ত। সন্তান এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর মিথিলা জেনেছেন নিজেরা একটু সচেতন হলেই তাদের সন্তানকে এই রোগ ছুঁতে পারতো না। তাই আজ মিথিলার প্রচণ্ড আৰেপ। তিনি বলেন, কেউ যদি বিয়ের আগে রক্ত পরীৰার ব্যাপারে সচেতন করতো তবে কিছুতেই এই ভুল করতাম না।
রক্ত পরীৰা করেই বিয়ে করতাম। কিন্তু এখন নিজেদের ভুলের মাসুল আমাদের সন্তানকে দিতে হচ্ছে।
একই পরিণতি এসেছে আজিজুর রহমান ও সাহিদা বেগম দম্পতির জীবনে। বিয়ের দেড় বছর পর তাদের সন্তানের জন্ম হয়। সন্তানটি জন্মের পর থেকেই লিভারের জটিল রোগে আক্রান্ত।
ডাক্তার জানান, মায়ের সমস্যা থাকায় ছেলেটি এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ডাক্তার এই দম্পতিকে বলেন, বিয়ের আগে দুজনের রক্ত পরীৰা করে বিয়ে করলে এই সমস্যা হয়তো এড়ানো যেতো।
সাহিদা বলেন, আগে যদি জানতাম আমাদের কারণে অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে- তবে অবশ্যই বিষয়টি বিবেচনায় নিতাম। কিন্তু তখন তো কেউ
আমাদের এ ব্যাপারে কিছু বলেনি।
মিথিলা ও সাহিদার পরিবারের মতো অনেক পরিবারের স্বাভাবিক জীবন-যাপন বদলে যাচ্ছে শুধু সামান্য একটু সচেতনতার অভাবে।
আধুনিক বিজ্ঞান এখন অনেক দূর এগিয়েছে। বিয়ের আগের কিছু সতর্কতা বাঁচিয়ে দিতে পারে বিয়ের পরে অনেক অনাকাঙিৰত পরিস্থিতি থেকে। সমপ্রতি নিউজ নেটওয়ার্ক আয়োজিত নারী সাংবাদিকদের এডভান্স ফেলোশিপের আওতায় গবেষণা করতে গিয়ে এই তথ্য পাওয়া যায়।
বিয়ের কারণে সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ ও রক্তের মাধ্যমে ও শারীরিক সম্পর্কের কারণে বেশ কিছু সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ হতে পারে। কিছু রোগ আছে যেগুলো শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে ছড়ায়।
এর মধ্যে রয়েছে এইচআইভি/এইডস, হেপাটাইটিস বি ও সি। অন্যান্য কারণে ছড়ানো রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে ডায়াবেটিস, সিজোফ্রেনিয়া, লিউকোমিয়া, অ্যাজমা, যক্ষ্মা প্রভৃতি। সঙ্গীর সমস্যা থেকে সেক্সুয়াল সমস্যাও তৈরি হতে পারে। কোনো কোনো ৰেত্রে বর-কনের স্বাভাবিক প্রোডাক্টিভ ৰমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ডা. আক্তার জাহান মির্জা হাসপাতালের পরিচালক ডা. আনোয়ার হোসেন বলেন, দাম্পত্য জীবনে এসব রোগ এড়াতে চাইলে বিয়ের আগে রক্ত পরীৰা করে বর-কনের সুস্থতা সম্পর্কে জেনে নেয়া জরুরি।
বিয়ের আগে রক্ত পরীৰা সম্পর্কে ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রভাষক ডা. রেজাউর রহমান বলেন, রক্ত পরীৰার বিষয়টি আসলে ম্যারেজ কাউন্সেলিংয়ের অংশ। অনেক রোগ আছে যেগুলো স্বামী থেকে স্ত্রী এবং পরে তা সন্তানদের মধ্যে ছড়ায়। কিছু কিছু অসুখে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ক্যারিয়ার হলে তা সন্তানের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এসব ঝামেলা এড়াতে রক্ত পরীৰা করে বিয়ে করা খুব জরুরি। যেমন আমাদের দেশে থ্যালাসেমিয়ার প্রচুর রোগী আমরা পাই যাদের বাবা-মা দুজনেই এ রোগের বাহক ছিলেন।
বাবা-মা বাহক হলে এই রোগে সন্তান জন্মের পরেই আক্রান্ত হয় এবং তারা ২১ বছরের বেশি বাঁচে না।
তিনি বলেন, এইচআইভি এবং হেপাটাইসিস বি ও সি রোগের জীবাণু সঙ্গীর মাধ্যমে ছড়ায়। এই রোগ দুটি মারাত্মক। এসব ঝুঁকি থেকে সন্তানকে রৰা করতে বিয়ের আগে অবশ্যই রক্ত পরীৰা করা উচিত।
তবে তিনি বলেন, অন্য রোগের বাহকের জন্য রক্ত পরীৰা যতো সহজ এইচআইভি বাহকের ৰেত্রে নয়।
এই জীবাণুর কথা জানাজানি হলে বাহকের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হতে পারে। তাই অনেকেই এটা প্রকাশ করতে চায় না। ডাক্তারকেও রোগীর গোপনীয়তা রৰা করতে হয়। এৰেত্রে ডাক্তার রোগীকে মোটিভেট করতে পারেন। রোগীকে এর ৰতির দিকটি ভালো করে বোঝালে সে অবশ্যই বোঝে।
একান্তই যদি রোগী না বোঝে তখন ডাক্তারকে আর একজন সুস্থ মানুষের জীবন বাঁচাতে সঠিক পদৰেপ নিতে হবে। অবশ্যই সেই ব্যক্তিকে বাধা দিতে হবে।
দেশে এইচআইভি-এইডস নিয়ে যেসব সংগঠন কাজ করছে তারাই শুধু রক্ত পরীৰার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছে তবু সে সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে কম। এইচআইভি বিষয়ে সচেতনতা প্রসঙ্গে পপুলেশন সার্ভিসেস এন্ড ট্রেনিং সেন্টারের (পিএসটিসি) এইচআইভি এইডস প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর পরেশ চন্দ্র ভৌমিক বলেন, বিয়ের আগে রক্ত পরীৰার জন্য আমাদের সব কিছুর আগে অ্যাওয়ারনেস বিল্ডআপের কাজটি করতে হবে। আমাদের দেশে যদিও এইচআইভি এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম তবে এর টার্গেট গ্রুপটা অনেক বেশি।
তবে আশার কথা এই- এখন মানুষ এই বিষয়টি নিয়ে জানে। তরুণ প্রজন্মের যারা এখন বিয়ে করতে যাচ্ছে তাদের আমরা রক্ত পরীৰা করে বিয়ের ব্যাপারে উৎসাহিত করছি। এইচআইভি টেস্টের ৰেত্রে প্রথম যে সমস্যাটি হয়, অনেকে ধরেই নেয় যে শুধুমাত্র শারীরিক সম্পর্কের কারণে এই রোগ ছড়ায়। তখন তারা আর ডাক্তারের কাছে গিয়ে এই পরীৰা করতে চায় না। তারা যখন জানতে পারে এটি শুধু শারীরিক সম্পর্কের কারণে ছড়ায় না, এর পেছনে রক্ত দেয়া ও নেয়ার সময় সিরিঞ্জের বিষয়টি থাকে- তখন তারা রক্ত পরীৰা করতে উৎসাহিত হয়।
আবার, কেউ এইচআইভি পজিটিভ হলেই যে মারা যাবে এই ভাবনাটিও সঠিক নয়। কখনো কখনো এর সুপ্তকাল ৩ মাস থেকে ২০ বছর পর্যন্ত হতে পারে। অনেক সময় বাহক ঠিকমতো পুষ্টিকর খাবার খেলে ও নিয়মমাফিক চললে দীর্ঘদিন সুস্থ থাকতে পারে। এই বিষয়গুলো যখন ছেলেমেয়েরা জানবে, তারা রক্ত পরীৰা থেকে পিছিয়ে থাকবে না। আমাদের দেশে এইচআইভির ৰেত্রে নারী যৌনকর্মী, ট্রাক ড্রাইভার, প্রবাসী কর্মী এরাই বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
এদের বিয়ে করার আগে অবশ্যই রক্ত পরীৰা করে বিয়ে করতে হবে। আমরা এই বিষয়টি নিয়ে খুব ৰুদ্র পরিসরে হলেও সচেতনতার কাজ করছি।
বাংলাদেশে বিয়ের আগে রক্ত পরীৰার ব্যাপারে সরকারি মহলে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। দেশের টেলিভিশনগুলোয় এ ব্যাপারে কখনো কখনো আলোচনা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। তবে এ ব্যাপারে বিশেষ সচেতনতামূলক কোনো বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে না।
তবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে একটি সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন দেখা যায়। সেখানকার একটি বাংলা টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপনটি ছিল এমন- এক ব্যক্তি তার আত্মীয়ের বিয়ের কথা বলতে কনের বাড়িতে গেছেন। তিনি সেখানে গিয়ে কনের বাবার কাছে বলেন, আমি বিয়েতে কোনো যৌতুক চাই না। শুধু আপনার মেয়ের এক ফোঁটা রক্ত চাই। একথা শুনে মেয়ের বাবা আঁতকে ওঠেন।
তখন সেই ব্যক্তি কনের বাবাকে বুঝিয়ে বলেন যে, মেয়ে ও ছেলে দুজনেই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয় তবে বিয়ের পর তাদের যে সন্তান আসবে সে নিশ্চিতভাবেই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হবে। আপনি কি চান আপনার একটু ভুলের কারণে আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়-ক। একথা শুনে মেয়ের বাবা বলেন, তাহলে সবার আগে রক্ত পরীৰা, এরপর অন্য কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা। বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়ার বাহক ছেলেমেয়েদের সচেতনতার জন্য এ ধরনের প্রচারণা চোখে পড়ে না।
আমাদের দেশে বিয়ের আগে রক্ত পরীৰার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।
বিয়ের অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে এটি নিয়ে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি এখনো তৈরিই হয়নি।
এ প্রসঙ্গে লেখক ও গবেষক ড. তপন বাগচী বলেন, আমাদের সনাতন চিন্তাধারার এই সমাজে একজনের কাছে রক্ত পরীৰা করতে চেয়ে বিয়ের সম্বন্ধ করতে গেলে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। তাই এ ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ আগে নিতে হবে। জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হলেই শুধু রক্ত পরীৰা করে বিয়ে দেয়া বা বিয়ে করা সম্ভব। আর কোনো ছেলেমেয়ে যদি প্রেম করে বিয়ে করে তারা তো কোনো অবস্থাতেই রক্ত পরীৰা করতে রাজি হবে না।
প্রেম তো হৃদয় থেকে আসে। এখানে পরীৰা-নিরীৰার কোনো সুযোগ নেই।
তবে ড. তপন বাগচী পরীৰা পদ্ধতি নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমাদের দেশে সামান্য রক্তের পরীৰাটি ঠিকমতো হয় না। একেক সময় একেক জায়গায় একেক ধরনের রেজাল্ট আসে।
রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের ৰেত্রেও পরীৰায় ভুল হয়। যদি সরকারিভাবে রক্ত পরীৰা করে বিয়ের জন্য প্রচারণা চালানো হয় তবে ভালো ফল আসবে। তবে এই প্রচারণা চালানোর সঙ্গে সঙ্গে রক্ত সম্পর্কিত বিভিন্ন অসামঞ্জস্যতা দূর করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিয়ের আগে রক্ত পরীৰার বিষয়টি এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই কোনো জুটি যদি বিয়ের আগে রক্ত পরীৰা করতে চায় তবে তাদের ব্যক্তি উদ্যোগেই করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ডা. রেজা বলেন, দেশে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের পরীৰা সরকারি হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি আইসিডিডিআরবি, পপুলার, ইবনে সিনা, ল্যাবএইড- এসব হাসপাতালে করা যায়। থ্যালাসেমিয়া রোগের জন্য রক্ত পরীৰা সরকারি হাসপাতালগুলোতে করা যায়। তবে এইচআইভি টেস্টের জন্য যেতে হবে নির্দিষ্ট জায়গায়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের নির্বাহী পরিচালক নীলুফার বানু বলেন, ছেলেমেয়ের বিয়ে দেয়ার সময় সবার আগে বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। তারা সচেতন না হলে কোনোভাবেই মেয়ের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরি করা সম্ভব নয়।
View this link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।