আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঘুনে খাওয়া দিন

বরফ - শীতল © আরফার রাজী [arfar_razi@yahoo.com]
ঘুনে খাওয়া দিন প্রায় আধাঘন্টা পার হয়েছে, এখনো হলের গেটেই দাঁড়িয়ে আছি। মতিঝিল যাবো, কোনো রিক্সাই পাচ্ছি না। কম করে হলেও একশো রিক্সাকে জিজ্ঞেস করেছি- যেন আমাকে তারা দেখেই নি- এমন ভাব করে চলে গেল। মাঝে মাঝে মাথাটা ঠিক রাখতে খুব সমস্যা হয়। তবে এখন জোর করেই মাথা ঠান্ডা রাখতে হচ্ছে।

হাঁটা ধরলাম শেষ পর্যন্ত। দোয়েল চত্বর পেড়িয়ে মৎস্য ভবনের মোড়ে এসে থামলাম। সকাল সাড়ে দশটার মতো বাজে। আবহাওয়াটাও চমৎকার। হাঁটার ক্লান্তিটা তাই খুব একটা ভর করে নি।

হাঁটতে হাঁটতে কর্মচঞ্চল মানুষের ব্যস্ততা দেখতে খুব একটা খারাপ লাগে না। রাস্তায় বেরুলেই আমার মানুষ দেখতে খুব ভালো লাগে। মানুষের ব্যস্ততা, অথবা ফুটপাতের উপড় বসে থাকা উদাসী কিশোরীর ভাবলেশহীন দৃষ্টি, অথবা ভিক্ষা চাইতে আসা ভিক্ষুকের মায়া চেহারা, অথবা দেহের প্রতিটা অংশে ঝড় তুলে অদ্ভুত কোনো চাহনি দিয়ে ঠিক পাশ দিয়ে হনহন করে হেঁটে যাওয়া কোনো কর্পোরেট তরুণী – সবই। আজ দিনটাই কেমন জানি ফ্যাকাশে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে প্রেস ক্লাবের সামনে এসে কন্ডাক্টরের চোখ ফাঁকি দিয়ে একটা মতিঝিলগামী কাঊন্টার বাসে বিনা টিকিটেই উঠে পড়লাম।

বাসের ভেতরটা মোটামুটি ফাঁকা। দু’এক জন পেছন দিকে বসে আছে। হঠাৎ মনে হলো – বাস টি বোধ হয় মেরামতের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা না হলে এই সময়ে বাস ফাঁকা থাকার কথা না। হঠাৎ করেই কন্ডাক্টরের সাথে চোখাচোখি হলো। আশ্চর্য, আমায় সে কিছুই বললো না, অথচ আরো অনেকে যারা বাসে উঠতে চাচ্ছিল, তাদের কি অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করলো।

শাপলা চত্বরের কিছু আগে জ্যাম এ থাকাকালীন অবস্থায় টুক করে বাস থেকে নেমে পড়লাম। অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু মানুষ দেখতে পাচ্ছি আজ, অনেক দূর থেকেও যাদের আমি আলাদা করতে পারছি; অদ্ভুত দৃষ্টিতে অনেক দূর থেকেও আমার দিকে তাকিয়ে আছে – যেন এই ব্যস্ততম শহরের মধ্যে তাদের ব্যস্ততা কেবলি আমাকে নিয়ে – আমি যেন এক রহস্য! ভাবছি আজ একটু হাউসে যাবো। রাস্তা পার হয়ে পেট্রোল পাম্পটা ক্রস করেই আমার ঠিকানা। অনেকদিন যাওয়া হয় না সেখানে। কেনাবেচা করা যায় কিনা দেখব।

বাজারটাও অত ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারছি না এখনো। দৌড়ে লিফটে উঠলাম। লিফটম্যান চাচা সবসময়ই ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলেও আজ কেমন জানি মনমরা লাগছে তাকে। ১৪ তলায় উঠে লিফট থেকে বের হবার সময় উনার দিকে তাকিয়ে বললাম, - চাচা, কেমন আছেন? মন খারাপ? আমার কথার জবাব না দিয়েই লিফটের দরজা বন্ধ করে দিলেন চাচা। কোনো কারনে উনি অনেক বিষন্ন, বোঝা যাচ্ছে।

বিষন্নতা এক দুরারোগ্য ব্যাধি, যেটি কিনা অসংখ্য শাখা-প্রশাখা বের করে গ্রাস করতে চেষ্টা করে প্রতিনিয়ত। হাউসে ঢোকার পরই অনেক সোরগোল শুনতে পেলাম। কোনার টেবিলে দেখলাম আতাউর সাহেবকে বসে থাকতে – আমাকে দেখেই ঐ অদ্ভুত দৃষ্টি, যে দৃষ্টি দেখতে দেখতে পুরোটা রাস্তাই পার করে এসেছি মাত্র। - গুড মর্নিং, আতাউর সাহেব। কোনো জবাব নেই।

ঘার ঘুরিয়ে আমি পেছনের দেয়ালের প্রজেক্টরের স্ক্রীনে বাজারের লেনদেন বোঝার চেষ্টা করছি। হঠাৎ আতাউর সাহেবের কন্ঠ। - আপনি এখানে? - হ্যাঁ। অনেক দিন পর আসলাম আজ হাউসে। গত মাসে অনার্স শেষ করলাম।

মাস্টার্স এর ক্লাস শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত ভাবছি এখানেই সময় দিব কয়েকটা দিন। এক রহস্যময় হাসি উপহার দিলেন আতাউর সাহেব, যা দেখলেই কেমন জানি গা শিউরে উঠে। উনার সামনে থেকে উঠে সারি করে ফেলে রাখা চেয়ারের সারির একেবারে পেছনের দিকটায় গিয়ে প্রজেক্টরের স্ক্রীনে মুখ দিয়ে বসলাম। মিনিটে মিনিটেই সংখ্যা পরিবর্তিত হচ্ছে। একটা ছন্দ খোঁজার চেষ্টা করছি, পারছি না।

হঠাৎ মনে হলো গতকালকের সন্ধ্যার আড্ডার কথাটা। খুব মজা হয়েছিল কাল। পরীক্ষা শেষ উপলক্ষ্যে কার্জন চত্বরে বারবিকিউ নাইট। চারটা মুরগীর ব্যবস্থা করেছিলাম আমরা। ভোজনপর্বের পর রাস্তায় শুয়ে শুয়ে গলা ছেড়ে গান।

ক’দিন পর সবাই কোথায় না জানি হারিয়ে যাবো সবার কাছ থেকে। - স্যার, নাস্তা নেন। মিলনের কথা শুনে হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেলাম। অবশ্য আমাকে না, আমার সামনের একজনকে নাস্তা দিল মিলন। মিলন এখানে কাজ করে।

অবাক হয়ে দেখলাম, আমাকে নাস্তা দেয়া হয় নি। এখানে যত ক্লায়েন্ট আসে, সবাইকে নাস্তা দেয়ার কথা। এমন না যে, মিলন আমায় চেনে না। কেবল আমি আর আতাউর সাহেব ছাড়া হলভর্তি সবাই নাস্তা খাচ্ছে। ঠোঁটের কোণায় অদ্ভুত এক হাসি দিয়ে আতাউর সাহেব তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।

কাউকে আর কিছুই জিজ্ঞেস করলাম না। উঠে বের হলাম হাউস থেকে। বিল্ডিং থেকে বের হয়ে দেখি বাইরে কড়া রোদ। দুপুর হয়ে এসেছে। পেটে অবশ্য খুব একটা ক্ষুধা নেই।

যাই, হলে চলে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করা যাবে চিন্তা করলাম। গিজগিজ করা মানুষের সাথে এক লোকাল গাড়ির দরজায় কোন রকমে পা’টা দিয়েই ঝুলে রইলাম। খুব কষ্ট হয়েছে বাসে উঠতে। সামনে প্রচুর জ্যাম। আস্তে আস্তে এগুচ্ছে বাস।

প্রেস ক্লাবের মোড়ে আর নামলাম না। ঝুলতে ভালোই লাগছে। শাহবাগ সিগন্যাল গিয়ে নেমে পড়লাম বাস থেকে। সূর্য তেঁতিয়ে উঠছে। তারপরও খুব একটা গরম কেন জানি লাগছে না।

হাঁটতে ভালোই লাগছে। ফার্স্ট ইয়ার এ থাকতে তো কেবলি হেঁটেই বেরিয়েছি। রাত নেই, দিন নেই শুধু হাঁটা আর হাঁটা। চানখাঁরপুল, ঢাকা মেডিক্যাল, টি এস সি, শাহবাগ, নীলক্ষেত, পলাশী – শুধুই হেঁটেছি। মানুষ কি অদ্ভুত! কোন একটা কাজে বেরুলে আর হাঁটতে ইচ্ছে করে না, রিক্সা নেয়া লাগে; তা না হলে ক্লান্তি ভর করে বসে।

আর কাজ না থাকলে সারাদিন হাঁটলেও ক্লান্তি এসে ভর করে না, বরং বিভিন্ন রকম দর্শন নিয়ে চিন্তা করতে করতে সময়ের পরিক্রমা ধরাই যায় না। কখন যে টি এস সি চলে এলাম, টেরই পাই নি। মনটা এমনিতেই ভাল হয়ে যায় এখানে এলে। সুখী মানুষদের মিলনমেলা যেন! এতদিন ইউনিভার্সিটিতে পার করলেও নিজের কখনো সৌভাগ্য হয় নি বিশেষ কাঊকে নিয়ে এখানে এসে বসার; অথচ দিনের পর দিন এত্তগুলো হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখতে দেখতে কখনো ক্লান্তিও চলে আসে নি। এখানেও আবার কিছু কিছু ঐ অদ্ভুত মানুষের দেখা পাচ্ছি, যাদের মাথাব্যাথা বোধ হয় কেবলি আমি।

ডাসের পেছনে এক কোণায় গিয়ে বসলাম। সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে হলো খুব। পরক্ষনেই তানির নিষেধাজ্ঞার কথা মনে পড়ে গেল। ধরালাম না আর। তানির সাথে দেখা হ্য় না অনেকদিন।

আজ সারাদিন কথাও হয় নি। মাঝে মাঝে তাকে অস্থিরতায় রাখতে বেশ মজা পাই আমি। তাই আজ মোবাইল নিয়েই বের হই নি। সারাদিন নিশ্চই অনেকবার ফোন করতে করতে অস্থির হয়ে আছে। থাকুক, আমাকে তো সে কম কষ্ট দেয় নি।

পড়ন্ত বিকেল। মাথাটা প্রচন্ড মাত্রায় ঝিম ঝিম করছে। কেবলি বাসার কথা মনে হচ্ছে, আর মনে হচ্ছে তানির কথা। দুপুরে খাই নি বলে এরকম হচ্ছে? নাহ্, ক্ষুধাও তো লাগে নি একদম। হাঁটতে হাঁটতে হলের সামনে আসলাম।

মাথাটা এখনও ঝিম ঝিম করছে। যাই, বরং মেডিক্যালের সামনের চা দোকান থেকে চা খেয়ে আসি। - মামা, চা দাও তো এককাপ। মেডিক্যালের সামনে আমি। রাস্তার বিপরীতে চায়ের দোকান।

আমার কথা শুনেও চা-দোকানী না শুনার ভান করছে। মেজাজটা খুব খারাপ হয় তখনই, যখন ভালোভাবে বলার পরও কথা কেউ না শুনে। মাথার ঝিমঝিমানির সাথে সাথে দপদপানিও শুরু হলো, সামনের সব কেমন জানি ঝাপসা লাগছে। অদ্ভুত কোন হাত যেন প্রচন্ড শক্তিতে আমায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও, জানি না কোথায়। হুট করে এক জটলার মুখে এসে সম্বিৎ ফিরে পেলাম।

আরে, এখানে দেখি সবাই। আমার সব বন্ধুরা এখানে কি করছে? আনোয়ার, শামীম, অমি, সোহান, আলম - সবাই এখানে কেন? ওদের দিকে চেয়েই আমি হেসে দিলাম - কেউ কোন জবাব দিল না। সবার মুখই কেমন যেন গম্ভীর এবং শান্ত। জটলা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। সামনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গের কলাপসিবল গেইট।

গেটের সামনের একেবারে ডান দিকের কোণায় দেখলাম একেবারে শূণ্য দৃষ্টিতে আমার মা-বোন ভেতরের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের পানি শুকিয়ে ছোপ ছোপ দাগ হয়ে আছে মুখের বিভিন্ন অংশে। যেন জনম জনম কেটে যাচ্ছে ভেতরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। কারো মুখে কোন কথা নেই। গেটের একেবারে বাম দিকে ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকা অবস্থায় দেখলাম তানিকে।

তার কেবলি চোখ দু'টো দেখতে পাচ্ছি। কি যা মায়া! কান্না ভেজা নয়নে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভেতরের দিকে। খুব থমথমে পরিবেশ, বাতাসটা খুব ভারী। গুনগুন করে মাঝে মাঝে কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আজ সন্ধ্যাটা কেমন জানি খুব বিষন্ন, আকাশটাও বোধ হয় খানিকবাদে অঝোরে কাঁদবে।

একমাস আগে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে ওপারে চলে যাওয়া আতাউর সাহেবকেও দেখলাম এদিকটাতে ঘুরাঘুরি করতে। সবার চোখেই অশ্রুর শুকিয়ে যাওয়া দাগ, কেউ বা আবার অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে, কেউ কেউ আবার ব্যস্ত হাসপাতালওয়ালাদের সাথে তর্ক-বিতর্কে, সাঁই সাঁই করে পেছনের রাস্তায় গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, রাস্তার ওপাশের চা-ওয়ালারা চা বানাচ্ছে কাপের পর কাপ; নিরবতার পাশাপাশি ব্যস্ততা। আর সবচাইতে বেশী ভাবলেশহীন বোধ হয় কেবলি এই আমি – কলাপসিবল গেটের ভেতরে পড়ে থাকা আমারই নিথর দেহ। বি. দ্র. : আজকের দিনের পত্র-পত্রিকার প্রধান খবর . . . . . . . . . . . . শহীদুল্লাহ হলের ভেতর পুলিশী গোলাগুলিতে নিহত হলো নিরীহ ছাত্র. . . . . . . . . . . . . . . . . গতকাল রাতে বিনা অজুহাতে হলের ভেতর পুলিশী তৎপরতায় সাধারণ ছাত্রদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের ফলে এ মর্মান্তিক দূর্ঘটনা ঘটে. . . . . . . . . . . . .. (ছবি : ইন্টারনেট)
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।