গেরিলা কথাবার্তা
বরাত
শাদাদের দুনিয়ায় নিজেদের নির্ভরশীলতা এবং অপর্যাপ্ত অস্তিত্বের সংকটে ভোগে কালো মানুষ। উপনিবেশের আধিপত্যে দ্বিধা-বিভক্ত আত্মতা এবং হীনমন্যতার সংকট কাটাতে তাই তারা ঔপনিবেশিক প্রভুদের সংস্কৃতিকে ধার করে- এবং তার অংশ হয়ে লীন হতে চেষ্টা করে নিজেকে ভুলে- ফ্রান্সের এককালীন কলোনি বর্তমান অংশ ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপে জন্মগ্রহণ করা লেখক ফ্রান্জ ফেনো তার 'ব্লাক স্কিন, হোয়াইট মাস্কস' কেতাবে এমনটাই পর্যবেক্ষণ করেছেন ১৯৫২ সালে। ফেনোর ইতিহাস থেকে আমাদের ইতিহাসও পৃথক নয়- উপনিবেশিক শাসকশ্রেণীর চরিত্র সব সময় সব জায়গাতেই এক। নিজেদের উৎকৃষ্ট হিশেবে ধরে নিয়ে নেটিভদের আদার এবং নিকৃষ্ট হিশেবে ট্রিট করা এবং অসভ্যদের সভ্য করার বিশ্বময় দায়িত্ব- অপরপক্ষে উপনিবেশের লোকদের ভিতর থেকেই গোলামি মানসিকতাপূর্ণ সুবিধাবাদি শ্রেণীর উদ্ভব- ভৌগলিক উপনিবেশ শেষ হয়ে যাওয়ার পর যারা নিজেরাই প্রভু হয়ে দাঁড়াতে চায় স্ব-গোত্রের উপর। ইংরেজের ভূমিদাসত্ব থেকে মুক্তির এতকাল পরে আমাদের বিচারব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শিরোনামটি ফানোর কেতাব থেকে ধার করেছি- উৎসর্গ আমাদের শাদা হতে চাওয়া বিচারকবৃন্দ- যারা নিজেরা উৎকৃষ্ট ও নাগরিকদের নিকৃষ্ট, অসভ্য ও আদার মনে করে তাদের সাথে তদনুরূপ ব্যবহার করছেন ইদানিং আদালত অবমাননার নামে- যদিও মুখে উপনিবেশবিরোধী ওয়াজ ছেড়েছেন।
১.
আমার জিটক মেসেঞ্জারে বেশ কিছুদিন ধরে একটা স্ট্যাটাস ঝুলছে: 'মিলর্ড!'- একটি জাতীয় দৈনিকের সাবেক সম্পাদক ও একসময়কার সচিব আসাফউদ্দৌলাকে চেম্বার জজ আদালতের নব-নিযুক্ত বিচারপতি শামসুদ্দীন সাহেব কঠিন ভাষায় গালিগালাজ করে যখন 'ঔপনিবেশিক মন-মানসিকতা' ছাড়তে বললেন- তখন আমার বিষম এলো। বিষম আসার খুব স্বাভাবিক কারণ আছে। জনাব শামসুদ্দীন সাহেবরা 'মিলর্ড' নামে একটি সম্বোধন ফরিয়াদি কাম আইনজীবি সকলের কাছ থেকে সোল্লাসে উপভোগ করে থাকেন। দুনিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশ সময় থেকে এখনতক ইতিহাসের যারা খোঁজ-খবর রাখেন তারা জানেন, মিলর্ড শব্দটির ব্যবহার 'ব্রিটিশ সম্ভ্রান্ত বংশীয় ভদ্রলোকে'র প্রতি নিচু বংশীয় ছোটলোক এবং নেটিভদের বাধ্যগত সম্বোধন যার অর্থ 'প্রভো আমার'। মানে হল 'আমি তোমার দাসানুদাস'।
যেই বক্তব্যের জন্য আসাফউদ্দৌলার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল হল এবং উপরোক্ত ভাষ্যে তাকে ঔপনিবেশিক মনমানসিকতা ছাড়তে উপদেশ দেওয়া হল, তাতে তিনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে এবং ইসলাম ধর্মমতে যেখানে আল্লাহ ছাড়া কোন মানুষকে প্রভো মানা হয় না- এই 'দাসানুদাস' শব্দের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং বৃটিশ ভারতের তৎকালীন ভাগ্য-বিধাতা রাণী ভিক্টোরিয়ার শোকের কালো গাউন পরে স্বাধীনতার এতকাল পরেও বিচারকদের বিচারকার্য পরিচালনার ঘটনার ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার নিয়েও ঐতিহাসিক প্রশ্ন তুলেছেন। আমার এই 'উত্তর-ঔপনিবেশিক বিচারকবৃন্দ'- যাদের উল্লেখিত ভৎসনার সুরে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে 'ঔপনিবেশিক ভাবধারা' এবং 'সামন্তপ্রথা' থেকে আগত যে কোন গোলামি মনোভাবপ্রসূত আচার- সম্বোধন এবং অ-নাচারের বিরুদ্ধে তাদের 'বিপ্লবী' এবং 'জেহাদি' মনোভাব বিদ্যমান- উল্টা দেখা যাচ্ছে- ব্রিটিশ লর্ডদের প্রতি সাধারণ ছোট লোকদের বাধ্যগতভাবে করা এই সম্বোধনটি, এমনকি এইসব গোলামির পোশাক তাঁরা সগৌরবে উপভোগ করেন শুধু তাই নয় বরং এই একই ঔদ্যত্যে এবং অহংকারে তারা এইসব সম্বোধনের অনুপস্থিতিতে এবং এইসবের বিষয়ে কোন সমালোচনাতেও যথেষ্ট অপমান এবং 'অবমাননা' বোধ করেন। এবং কোনরূপ আইনের তোয়াক্কা না করেই নির্লজ্জভাবে তার জন্য 'কঠিন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি' দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। সত্যিকারের ঔপনিবেশিকবিরোধী মন বটেন। বোঝা কঠিন নয়- উপনিবেশিক শক্তি ও তার এদেশীয় প্রতিনিধি লুটেরা জমিদারদের বিরুদ্ধে তিতুমির-শরিয়তুল্লা সহ কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানুষের লাঠির প্রতিরোধ সফল হলেও উপনিবেশিক মনের ভিতরে বসে থাকা এইসব ঠুটু লর্ডদের বিরুদ্ধে আমাদের আরো নিরন্তর বিস্তর লড়াইয়ের প্রয়োজন আছে।
এই আত্মম্ভরিতাপূর্ণ ও ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের বিচার-ব্যবস্থায় বিচারকদের এই গোলামির পোশাক শুধু নয় পুরো ব্যবস্থাটাই খোল নলচে পালটাতে না পারলে আমাদের জন্য একটি মানবিক সমাজের চিন্তা বহুত দূর।
২.
ভারতের নর্মদা নদীতে বিতর্কিত বাঁধ বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখার দায়ে আদালত অবমাননায় কনভিকটেড হবার পর ভারতীয় লেখিকা অরুন্ধতি রায় বিচার ব্যবস্থার এই কিম্ভূত লর্ডশিপের বিষয়টিরে 'জুরিস্টোক্রেসি' অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন যে কোন একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের মতই এটি বিপদজনক। অবশ্যই, আদালতের এই নতুন অভিজাততন্ত্রের বিষয়টি এর মধ্যেই একাডেমিশিয়ানদেরও বিস্তর নজরে এসেছে- যার কারণে এমন প্রশ্নও হাজির হয়েছে যে, বিচারকগণ কি আমাদের স্বাধীনতা হাইজ্যাক করে নিচ্ছেন? যেমন ধরুন এ সংক্রান্ত একটি স্টাডির শিরোনাম হলো, ফ্রম ডেমোক্রোস টু জুরিস্টোক্রেসি- মানে, গণতন্ত্র থেকে বিচারবিভাগীয় অভিজাততন্ত্র। বিষয়টি গুরুত্বতো বটেই- কারণ এই জায়গায় এসে আইন, প্রতিষ্ঠান, ন্যায়বিচারের ধারণা গুবলেট পাকতে পারে- যদি কোনরকম অস্পষ্টতা ও অতিভক্তিতে নিমজ্জিত হওয়ার ইচ্ছে থাকে এর কোনটির প্রতি।
৩.
অতিভক্তি বিষয়ে সতর্ক হওয়ার কথা বলেছি উপরে।
কারণ আইন, রাষ্ট্র, সংবিধান এইসব জিনিশ তার পাত্রপাত্রিদের কাছ থেকে আনুগত্য আশা করে- ভক্তি নয়। এইটা হল এক দিককার প্রত্যাশা- বিপরীতে আমরা যারা নাগরিক বা এইসবের পাত্রপাত্রি- আমাদের কাজ পর্যালোচনা- তার ভিতরে নিজেদের অবস্থান চিহ্নিত করা ও তার সাথে আমাদের স্বাধীনতার যেটুক অংশ শেয়ার করতে রাজি আছি সেইসব স্বার্থের বিষয়-আশয় নিয়ে দর কষাকষি- আলোচনা- সমালোচনা ও যদ্দুর সম্ভব নায্য হিস্যা বুঝে নেওয়ার লক্ষ্যে তৎপরতা চালানো। তাই, ভক্তিরে বাদ দিয়ে- শাদা কথায় 'আইন' জিনিশটা কী- এর হদিস খুঁজতে গেলে বৃটিশ আইনতাত্ত্বিক অষ্টিনের দেওয়া এর শাদামাটা ও জংলি সংজ্ঞাটাই পাঠযোগ্য হয়। অষ্টিনের মোদ্দাকথা হলো, বলপ্রয়োগের ক্ষমতাই আইন তৈরী করে, এহেন ক্ষমতা সম্পন্ন সভারেন যা বলে তাই আইন, শুধু তাই নয়, আইন কেবল তার হয়ে কথা বলে এবং আইন এর বাস্তবায়নও হয় বলপ্রয়োগের মাধ্যমে। এমনকি, এই বলপ্রয়োগের ক্ষমতাই হল আইনের বৈধতার নির্ণায়ক।
সোজা কথায়, জোর যার, মুলুক তার। এখন, এমন একটি আইন বা বিচারব্যবস্থায় যেখানে 'আইন' বলপ্রয়োগের শক্তির স্বপক্ষে কথা বলে, আদালতও তেমনি বলবে তাই স্বাভাবিক। এই কৌতুহলকর ব্যাপারটি একজন রাজনীতিবিদ যথেষ্ট উদ্বেগের সাথে যদিও বলেন- মোদ্দাকথা কিন্তু তাই- এমনকি এই সত্য কথাটিও তিনি জানেন। আর জানেন বলেই আবার আশা প্রকাশ করেন, আমরাও একদিন ক্ষমতায় আসবো, তখন- আমাদেরও পক্ষে কথা বলবে আদালত।
আমরা অবশ্যই ভীন্ন প্রশ্ন রাখব, বিচারব্যবস্থা বা আইনের এই প্রশ্নহীন একনায়কতন্ত্র আমরা মেনে নেব কিনা।
৪.
বৈশ্বিক বিচার ব্যবস্থায় মোটামোটি দুই ধরনের বিচার-পদ্ধতি চালু আছে। কমন ল ভিত্তিক রাষ্ট্রগুলোতে এডভার্সারিয়াল সিস্টেম চালু আছে- আর অন্যগুলোতে ইনকুইজিটরি সিস্টেম। আমাদের বিচারব্যবস্থায় প্রথমটি, মানে এডভার্সারিয়াল সিস্টেম-এ বিচারকার্য পরিচালিত হয়। যার মূল বৈশিষ্ট্য হলো বাদি এবং বিবাদি উভয়পক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী আইনজীবিরা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষের দরবারে- যার মধ্যে আছে জুরিবোর্ড এবং জজ- তাদের স্ব-স্ব- আইনি অবস্থান তুলে ধরবে। খেয়াল করতে হবে, এই সিস্টেমের মূল বৈশিষ্টই হলো বিচারকরা ঠুটো জগন্নাথ- নিরপেক্ষ- নিষ্ক্রিয় থাকবেন- আইনজীবীগণ আইনের যে বিশেষ পয়েন্টগুলো উল্লেখ করে বিপক্ষ আইনজীবীর সাথে যুক্তি-তর্ক করবেন- বিচারক সেইসব পয়েন্টের ভিত্তিতেই আইনের বইগুলো বা কোডগুলো ঘেঁটে বিচার করে দেখবেন কে অধিকতর আইনি অবস্থানে আছেন এবং তার জন্য কোডে কী প্রতিকার বা শাস্তি দেওয়া আছে- তার নিজের কোন তাড়াহুড়ো বা আসামীকে জেরা করার দায়িত্ব নেই।
তার জন্যই দেখা যায় একটা সামান্য বিসিএস দিয়েই এতদিন মেজিস্ট্রেট হিশেবে দ্বায়িত্ব পালন করতে পারত একজন জজ- আইন বিষয়ক বিস্তর পড়াশোনা তার না থাকলেও বা এই বিষয়ে তিনি মোটামোটি মুর্খ হলেও চলে- অথবা বছরের পর বছর পড়ে থাকে একটি মামলার মিমাংশা। এই বিষয়টিরে সামনে আনলাম দুটি কারণে। এক হল এই এডভার্সারিয়াল সিস্টেমকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সুবিধাবাদি আইনব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য ও একাধিপত্য- যেখানে আইনকে নিয়ে ব্যবসাটাই মূখ্য- জাস্টিস বহুত দূর- অন্যদিকে ঠুটো জগন্নাথ এই বিচারকবৃন্দ আদালতের শোপিস হিশেবেই বেঁচে আছেন- অদ্ভূত একুরিয়ামের ভিতরে- সাধারণ মানুষের ধরা-ছোয়া-এবং সমালোচনার বাহিরে- অকাজের কাজী হিশেবে। তবে, বাংলাদেশে সম্প্রতি কয়েকটি মামলায়, বিশেষ করে আদালত অবমাননার মামলাগুলোতে- যেমন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা এবং সাবেক সচিব আসাফউদ্দৌলার বিরুদ্ধে মামলায় এই মহামান্য কাজীদের ব্যতিক্রম ব্যাপার দেখা গেছে। মাহমুদুর রহমানের মামলায় বাদি ছিল একজন আইনজীবী- আর আসাফউদ্দৌলার মামলাটা ছিল সু-মটো, মানে হাইকোর্ট নিজেই বাদী।
কিন্তু উভয় মামলায়ই আপিল বিভাগের সম্মিলিত বেঞ্চ নিজেই যেভাবে আসামীকে ডিগ্রি পাশ আইনজীবীর চেয়েও জঘন্য উপায়ে জেরা করে নিজের তথাকথিত অবমাননার শোধ তোলার চেষ্টা করলেন- তাতে প্রশ্ন তো আসেই যে- এটি কি এডভার্সারিয়াল সিস্টেমের সেই ঠুটো জগন্নাথ বিচারক- আমাদের বিচারকরা হঠাৎ এমন ক্ষমতা এবং পুরো ব্যবস্থায় বিপ্লব অনুভব করা শুরু করল কোন দরদের জায়গা থেকে। আদালত যখন জেরা করেন, মাহমুদুর রহমানের সাংবাদিকতার ডিক্রি আছে কিনা এমন বিষয়ে- এবং ভয়াবহরকম তৎপর হন অভিযুক্তকে অপরাধী প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে- তখন নাগরিক অধিকারের জায়গা থেকে এই দরদের জায়গাটা বুঝা ফরজ হয়ে যায়। এই ফরজ কাজটার তাগিদেই- হাইকোর্ট যখন অনধিকার জেরা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের একজন নাগরিকের সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করে বে-আইনি মন্তব্য করেন- যথা ‘এডিটর ইন চান্স’- মাহমুদুর রহমানের প্রতি করা শ্লেষ-মন্তব্য- তখন এই বিশেষ ধরণের হাইকোর্টকে আমরা সংবিধানবলে কোন উপায়ে কনভিক্ট এবং ইমপিচ করবো তাও খুঁজে দেখার দরকার আছে। কারণ হাইকোর্টসহ যে কোন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ঘোষিতভাবে জনগণের ইচ্ছে এবং গণতান্ত্রিক অধিকার এর রক্ষাকবচ- এবং যতক্ষণ তা নিশ্চিত না করছে- হাইকোর্ট জনগণ থেকেও এই রক্ষাকবচ পাওয়ার অধিকারী না। বিদ্যমান ব্যবস্থার সমালোচনার পাশাপাশি বিদ্যমান সংবিধান ও আইনি ব্যবস্থায় যেইসব নাগরিক অধিকার এর প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করা হয়েছে- তার ব্যাপারে খোঁজ খবর রাখা এবং সচেতন থাকা আমাদের নাগরিক কর্তব্য।
ন্যায়বিচার বহুত দূর- কিন্তু বিদ্যমান আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও সংবিধানপ্রদত্ত নাগরিক অধিকারই যদি খোদ বিচারদাতা এজ এন ইনস্টিটউশন লঙ্ঘন করে- সেই ইনস্টিটউশনের প্রতি আমাদের জগদ্দল ভয় থাকবে- এবং তার দ্বারা সুষ্ঠু আইনের প্রয়োগ বা জাস্টিস কোনটাই সম্ভব নয়। আরো প্রশ্ন আছে- আইনের কিছু সুপ্রতিষ্ঠিত মেক্সিম আছে- তার মধ্যে একটি হলো অভিযুক্তের মামলার বিষয়বস্তুর সাথে বিচারক নিজের ইন্টারেষ্ট যদি কোনভাবে জড়িত থাকে- তাহলে সেই মামলা সেই কোর্টে চলবে না। এই মেক্সিমও মানার প্রয়োজন বোধ করেনি আদালত এইসব মামলার ক্ষেত্রে- দেখা গেল এখানে ফরিয়াদি এবং বিচারক একই। এমনকি আমাদের সংবিধানে যেইসব বিষয়ের মামলার রায়ে আপিলের অধিকার দিয়েছে তার মধ্যে আদালত অবমাননার মামলা অন্যতম। কিন্তু দেখা গেল আপিল বিভাগই যেহেতু এই মামলার ফায়সালা করেছে- তাদের রায়ে কোন আপিলের সুযোগই থাকল না।
অতএব, আইন এবং অ-আইনের এই ভজঘটের মধ্যে উচ্চ আদালতের জগদ্দল ইচ্ছেটাই প্রধান হয়ে রইল।
৫.
বেশ কিছুদিন আগে আদালতের সমন জারির পর হাজিরা না দেওয়ার অজুহাতে একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান গ্রেফতার হল- সেই রাতে ঢাকার পুলিশ কমিশনার শহিদুল হকের ফতওয়াসহ প্রেসনোটস জারি হল- যে বা যারা এর প্রতিবাদ-বিক্ষোভে অংশ নেবে, এমনকি এর বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতি দেবে তারা আদালত অবমাননায় অভিযুক্ত হবেন। আদালত অবমাননা বিষয়ে পুলিশ কমিশনারের এই ফতওয়া বেশ ভাবিয়ে দেওয়ার মত। তাহলে- উচ্চ আদালতের সাথে সাথে সাথে প্রশাসনও এই টার্মটির ক্ষমতা ও রাজনৈতিক ব্যবহার বুঝে গেছেন এবং সরকার যে কোন বিরুদ্ধ মতামত দমনের অস্ত্র হিশেবে এই পরিভাষার ব্যবহার শুরু করেছে। যে কোন রকমের সমাবেশ, মিছিল, মিটিং, এমনকি মানব বন্ধনের মত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পর্যন্ত দমন করার উদ্দেশ্যে- এই পুলিশ কমিশনার সাহেব মিডিয়ায় মাস্তানির ভঙ্গিতে আইন-শৃঙ্খলা ও ট্রাফিক পরিস্থিতির তত্ত্ব বিলোয় ইদানীং- যার মধ্যে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ তত্ত্ব ছিল আদালত অবমাননা।
দেখা যাচ্ছে- আইন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আদালত, সরকার- সবাই একই ঔপনিবেশিক ভাষায় কথা বলছে- যেন এটি একটি ঔপনিবেশিক সরকার বা জরুরী অবস্থা- যে কোন রকম কথা বলা অপরাধ। এটি কি অন্য এক জরুরী অবস্থা? তাহলে এক-এগারর অগণতান্ত্রিক রেজিমের জরুরী অবস্থার সাথে এই গণতন্ত্রের লেবাসধারী জরুরী অবস্থার ভেদ বা প্রভেদও গুরুত্বপূণ পর্যালোচনার দাবী রাখে বৈকি।
৬.
বতমান পপুলার ধারণায় সংসদ হচ্ছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চিহ্ন, আদালত সংসদের বানানো বিধিবদ্ধ আইনগুলোর প্রয়োগ নিশ্চিত করে মাত্র। পঞ্চম সংশোধনী মামলায় বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে চলে এসেছে এখন- তা হলো- আইন বানানোর অথরিটি কার? সংসদ না আদালতের? সংসদকে কি আদালত কোন নিদেশ দিতে পারে- বা সংসদ কি আদালতের নিদেশনা মানতে বাধ্য? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এইরকমটি না হওয়ারই কথা। কারণ সংসদ সদস্যগণ আইন বানানোতে সম্পূণ স্বাধীন- শুধুমাত্র জনগণের অধীন।
তাহলে পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়টি অর্থহীনই হয়ে গেল। যার প্রয়োগ সংসদের ইচ্ছের অধীন- সেইরকম একটি রায় আদালত প্রদান করে একই সাথে নিজের এবং সংসদের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করল। অনুরূপ সপ্তম সংশোধনী মামলার রায় এবং যদি কেউ চতর্কে সংশোধনীর বিরুদ্ধেও মামলা করে- তার ফলাফল একই হতে বাধ্য।
৭.
সেক্যুলার রাষ্ট্রের ধর্মাকাঙ্ক্ষা ও তার সমূহ বিপদ নিয়ে বহুত বাতচিত হয়েছে। উচ্চ আদালতের উপরোক্ত কার্যক্রম এবং আরো কিছু ঘটনায় সম্প্রতি তার ফেনোমেননগুলো প্রকটভাবে প্রকাশিত বাংলাদেশে।
বিশেষত শহীদ মিনারের 'পবিত্র বেদি' নির্ণয় থেকে শুরু করে ১৯৭২ সালের মুসাবেদা সংবিধান-আইন-আদালত ইত্যাদির তথাকথিত 'পবিত্রতা' ও 'অবমাননা' নির্ণয়ে উচ্চ আদালত এর বিষ্ময়কর তৎপরতায়। হাইকোর্ট এক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করছে। সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচে বেশি তৎপর এখন হাইকোর্ট। নাগরিক অবস্থান থেকে এই বিস্ময়কর তৎপরতা গভীর পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার দাবী রাখে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।