আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মেয়ে হওয়া, মা হওয়া

জীবন গঠনে নিজেস্ব প্রতিক্রিয়ার দায় বেশি, ঘটে যাওয়া ঘটনার ভূমিকা সামান্য।

এপ্রিলের শুরু আমার রিসেপশনে যে রিমা আসতে পারবে না ভাবি নি একদম। ওর মত হাসিখুশী, নাচুনে বুড়ি, যে ঢোলের বাড়ি হওয়ার আগেই নাচতে নেমে যায়, সে রকম মানুষ আমি কমই দেখেছি! ওর বিয়ে হয়েছে আমার বিয়ের কয়েক মাস আগে। বিয়ের আগে এখানে শুধু মেয়েদের একটা অনুষ্ঠান হয়, যেটাকে বলা হয় হেনস নাইট। হেনস নাইটে কনে সব মেয়েদের সাথে যতটা পারে মজা করে নেয়, হাজার হোক বিয়ের পরেই শুরু হবে বন্দী দশা!!! রিমার হেনস নাইটে যাওয়ার জন্য যখন তৈরি হচ্ছি, তখন রিমার ফোন--আমি যেন ওর জন্য একটা সুন্দর শাড়ি নিয়ে যাই।

লেবানিজ মেয়ে শাড়ি দিয়ে কি করবে? না বুঝলেও নিয়ে নিলাম! গিয়ে বুঝলাম আসল ঘটনা বড়ই জটিল! সেদিন রিমা আটটা ভিন্ন গানের সাথে নাচল। প্রতিটা গানের সাথে এক একটা নতুন পোশাক! ওয়েস্টার্ন ইভিনিং ড্রেস থেকে শুরু করে শাড়ি! এক একটা নতুন গান শুরু হয় আর ও নতুন পোশাক পরে ঘরে ঢুকে। সব আরবি ঢিশটিক ঢিশটিক টাইপের গান, তাল ছাড়া কিচ্ছু বুঝি নি। শুধু একটা গানই হিন্দী ছিল, 'শাভা শাভা'! পুরুষালী গলায় শাভা শুরু হতেই শাড়ি পরে রিমা মহা নাটকীয় ভঙ্গীতে ঘরে ঢুকে আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাকে টেনে নামিয়ে দিল ড্যান্স ফ্লোরের মাঝখানে! আমি বাংলাদেশী মেয়ে, ইন্ডিয়ার কাছাকাছি দেশ থেকে এসেছি, অতএব আমি নিশ্চয়ই বিয়ের নাচে রাণী আর ঐশ্বরিয়ার চেয়ে কম যাব না! সে দিন রিমাকে ভীষণ হতাশ করলাম এবং ওর দৃঢ় ধারণা জন্মে গেল যে বাঙালীরা মজা করতে জানে না! কখনও বলিউডের নাচ মনযোগ দিয়ে দেখি নি, এমনকি জাতিগতভাবে আমরা কখনও বিয়েতে নাচি না, নাচ-টাচকে ধর্ম কর্ম করা মানুষেরা ভালো চোখেও দেখি না, আর 'শুধু মেয়েদের আনন্দানুষ্ঠান' বলে আমাদের বাঙালী সংস্কৃতিতে কিছু নেই--এত সব আবিষ্কারেই রিমা হতাশ! রিমা আর ওর মা আমি বিদায় নেয়ার আগে পই পই করে বলে দিল আমি যেন নিজের বিয়েতে ওদের অবশ্যই দাওয়াত দেই। ইন্ডিয়ার পাশের দেশটায় মানুষেরা কেম্নে বিয়ে করে দেখবে! বিয়েতে মজা করতে না পারলে মজা শিখিয়ে দিয়ে আসবে! রিসেপশনের দিন অনেক মানুষের ভিড়ে যখন রিমার মুখটা খুঁজে পেলাম না, তখন তাই খুব অবাক হলাম।

কারণ জানলাম কিছুদিন পরে…... রিমা প্রেগনেন্ট!!! ইউনিভার্সিটিতে আমার কাছের বান্ধবীদের মধ্যে প্রথম মা হয়েছে জাহিদা। সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে পাকনামি করে। আর রিমা, আমার বিয়ের মাত্র কয়েক মাস আগে বিয়ে করে, হজ্জ করে এসে দিব্যি প্রেগনেন্ট হয়ে গেল! শুনেই মনে হলো, বাহ, এক্কেবারে সময় মত! মে এর শুরু ইউনিভার্সিটির বুকশপে হঠাৎই দেখা মারভেতের সাথে। কেমন আছে জিজ্ঞাসা করতে হুট করেই বললো কথাটা। দশদিন হলো মারভেতের মিসক্যারিজ হয়েছে।

খুব হতভম্ব হয়ে গেলাম শুনে। এরকম ক্ষেত্রে কি বলতে হয় আমি বুঝি না। মারভেত অবশ্য ইমোশন প্রকাশ করার মত মেয়ে না, ও বলে গেল ও আসলে ভ্রুনের সাথে অ্যাটাচড হওয়ার আগেই মিসক্যারিজ হয়েছে। ও টের পাওয়ার মাত্র তিন দিন পরে। মিসক্যারিজ হওয়ার পর যখন ও হাউমাউ করে কাঁদছিল আর সবাই শুকনো মুখে বলছিল, আরেকটা বাবু হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার, তখন ও নাকি মাথা নেড়ে বলেছিল, আমি তো বাবুর জন্য কাঁদছি না, ব্যাথায় কাঁদছি! ও হাসির সাথে মিশিয়ে টিশিয়ে বলে গেল পুরাটা ঘটনা, কিন্তু ভীষণ খারাপ লাগা নিয়ে আমি বাসায় ফিরলাম সেদিন।

আগস্টের শুরু পিএইচডি, চাকরি, বাসা বদল নিয়ে মাথা খারাপ অবস্থা। হঠাৎই ফেইসবুকে মারভেতের খোঁচাখুঁচি শুরু হলো। রিমার বাচ্চা হবে আগস্টের শেষে। তার আগেই রিমাকে একটা সারপ্রাইজ বেবি শাওয়ার দিতে হবে! বেবি শাওয়ারের দিন হবু মায়ের জন্য অনেক রান্না বান্নার আয়োজন হয়, হবু মাকে নিয়ে নানা রকমের গেইমস খেলা হয়, তারপর হবু মা'কে নতুন বাবুর গিফটে ভাসিয়ে দেয়া হয়। আইডিয়াটা শুনে বেশ ভালো লাগল।

'সেলিব্রেশন অফ বার্থ! রিমাকে দেখলাম অ-নে-ক দিন পর। প্রেগনেন্ট হওয়ার পর এই প্রথম! সেই রিমা, যে ছটফট করে লাফিয়ে বেড়াতো তার ৫'৭'' লেবানীজ শরীর নিয়ে এখন মা হয় হয় অবস্থা! যে ঘরে থাকলে সবার চোখ ওর দিকে থাকবেই! ভাবছিলাম সেই রিমা বুঝি বদলে গিয়েছে, কিসের কি! ও ওর বিশাল পেট নিয়ে ঘরে ঢুকে, প্রথমে প্রচন্ড অবাক হলো, তারপর সামলে উঠেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো আমাদের! তারপর সেই আগের মতই চিল্লাচিল্লি, ওকে না জানিয়ে এত কিছু কেন করা হলো, ও তো মজাগুলো মিস করে ফেললো! এরকম সারপ্রাইজ পার্টির আয়োজন করার সময়ই তো অর্ধেক মজা শেষ হয়ে যায়! দেখে খুব ভাল্লাগলো, প্রেগনেন্সি ওকে কাবু করতে পারে নি একদম। চাকরি থেকে ছুটি নিয়েছে মাত্র দুই সপ্তাহ। এই দুই সপ্তাহেই হাঁপিয়ে উঠেছে রীতিমত। ও তো ঘরে বসে থাকার মেয়ে না! কবে যে পেটের বাবু বের হবে আর ও ছুটিয়ে বেড়াবে বাবুটাকে! ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি আমাদের দেশে প্রেগনেন্ট মেয়েরা প্রেগনেন্সিটা ঢেকে রাখার প্রানপনে চেষ্টা করে।

ছোটবেলায় তো বুঝতেই পারতাম না কেউ প্রেগনেন্ট হলে, বড়রা শুধু চোখে চোখে কথা বলতো। প্রেগনেন্ট মেয়েটা গায়ে বড় ওড়না জড়িয়ে থাকতো জুবু থুবু হয়ে। বাসার ছেলেরাও নিশ্চয়ই জানতো যে একটা প্রেগনেন্ট মেয়ে আছে, কিন্তু কোন ভাবে যদি প্রেগনেন্সির স্বীকৃতি দিতো জোরে সোরে, সেটা 'এই অবস্থার' কথা বলেই হোক, আর যেভাবেই হোক, তাতেই মহা লজ্জার ব্যাপার হয়ে যেত! এজন্যই আরও রিমাকে দেখে মন ভরে গেল। কি আত্মবিশ্বাসের সাথে হেঁটে বেড়াচ্ছে পিঠ সোজা করে! আর না-হওয়া বাবুকে নিয়ে কি যে উৎসাহ! আল্ট্রান্সোগ্রাফীতে যখন বাবুকে দেখলো, তখন নাকি বাবু আঙ্গুল চুষছিল! শুধু কি তাই, একবার পিট করে চোখের পাতাও ফেললো! হাই তুললো! মেয়ে পেটে থাকতেই এত কিছু শিখে গিয়েছে, বের হয়েই তো হাঁটা শুরু করে দিবে! আমরা যেহেতু খালা হবো, তাই আমাদের ও না-হওয়া মেয়েটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। ওর নাম আয়েশা।

আয়েশা বেশির ভাগ সময়ে গুটিশুটি মেরে পাথালি হয়ে শুয়ে থাকে। ওর মাথাটা থাকে রিমার বাঁ দিকে। আর ওর গুটুশ গুটুশ হাঁটুগুলো থাকে ডানদিকে। মাঝে মাঝে্ই সে হাঁটুগুলো নাড়ায়। মাঝে মাঝে আবার ওর হেঁচকিও ওঠা শুরু করে! রাতে হঠাৎ করে রিমার ঘুম ভেঙে যায় আয়েশার হেঁচকিতে, হিক্কুপ, হিক্কুপ, হিক্কুপ করে একটু পর পর রিমাকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিতে থাকে! আমরা সবাই উপর থেকে হাতড়ে আয়েশাকে এক গাদা ভালোবাসা দিয়ে, আর আয়েশার জন্য বুক ভরা ভালোবাসা নিয়ে বাসায় ফিরলাম সেদিনের মত।

সেপ্টেম্বরের শুরু ২/৯/২০১০ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম রাতে, হঠাৎ এসএমএসের শব্দে পাতলা ঘুম ভাংলো। দেখব না দেখব না করেও মারভেতের নাম দেখে এসএমএস খুলে আধো আধো ঘুম নিয়ে পড়লাম। একবার, দুইবার, বার বার পড়লাম…... "Funeral prayer for Aicha, the daughter of Mohamed and Rima will be held tomorrow at Rockwood Cemetery…" ------------------------------ ঘটনাটা কিভাবে হয়েছে কেউ জানে না। রিমা সারা প্রেগনেন্সিতে অসুস্থ হয় নি একদম। শেষের ক'টা দিন একটু শরীর খারাপ লাগছিল।

তখন গেল ডাক্তারের কাছে। একজন ইন্টার্ন ডাক্তারের ডিউটি ছিল সেদিন। ডাক্তার অনেক্ষন ধরে কোন হার্টবিট পাচ্ছিল না। রিমা যখন খুব চিন্তায় পড়ে গেল, তখন ডাক্তার স্ক্রীনের দিকে দেখালো ওকে, ওই যে দেখো বাবুর হার্টবিট! উল্টো হয়ে আছে তো, তাই পেতে এত দেরি হলো! রিমার শরীর পরের দুই দিন একটু বেশিই খারাপ হয়ে গেল। প্রেশার খুব হাই।

আবারও গেল ডাক্তারের কাছে। এবার অন্য ডাক্তার। সেদিনের মত ওই দিনও ডাক্তার কিছুতেই হার্টবীট খুঁজে পাচ্ছে না। রিমা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল স্ক্রীনের দিকে। একটু যদি কিছু দেখা যায়! হঠাৎই দেখলো ও সেদিনের দেখা দাগগুলো, স্ক্রীনে নাচছে রিমার বুকে পানি এনে।

উল্লসিত হয়ে চিৎকার করে ডাক্তারকে দেখালো। ডাক্তার ওর দিকে অদ্ভূত চোখে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললো, 'এটা তোমার হার্টবীট, জরায়ুতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ' রিমা, যেই রিমার গলার আওয়াজ আধা মাইল দূর থেকে শোনা যায়, ও হঠাৎই খুব চুপ হয়ে গেল। আস্তে করে বললো, 'কিন্তু আমি তো গত কয়েক দিন ধরে টের পাচ্ছিলাম, আয়েশা আমার পেটে নড়ছিল সারাক্ষন…...' ডাক্তার ওর মাথায় হাত রেখে বললো, 'আয়শা নড়ছিল না, আয়শার দেহ পানিতে ভাসছিল, সেই ভাসাটাকেই তুমি ভুল বুঝেছো। …' ডাক্তাররা চাচ্ছিলো রিমার পেট কেটে মৃত ভ্রুনটাকে বের করে ফেলতে।

রিমা কিছুতেই রাজি হলো না। আয়েশার যেভাবে আসার কথা ছিল সেভাবেই আসবে আয়েশা। রিমার নিজের কষ্ট কম হওয়ার জন্য আয়েশার ভাই বোনদের পৃথিবীতে আসার পথ সরু করতে যাবে কেন ও? সুদীর্ঘ লেবারের পর রিমার বুকে আসল আয়েশা। প্রানহীন আয়েশা। আমি রিমার মুখোমুখি হতে পারি নি আজও।

এই ঘটনার সপ্তাহ খানেক আগে, আগস্টের চব্বিশ তারিখ রিমা একটা গণ-ইমেইল করেছিল, রমজানে দোআ কবুল নিয়ে। রমজানে সব দোআ কবুল হয়, তাই যারা বাবু চায়, তাদের দোআও আল্লাহ কবুল করবেন। ওই ইমেইলটা বার বার পড়লাম। তারপর সবটুকু সাহস সঞ্চয় করে ওটারই একটা রিপ্লাই দিলাম। রিমাও জবাব দিয়েছিল সাথে সাথেই।

জবাবটা আমার চেয়ে অনেক গুণ সাহসী। বলেছিল, 'আমি দোআ করেছিলাম আল্লাহ যেন আয়েশাকে বেহেস্তে নেয়। আল্লাহ যে এভাবে আমার দোআ কবুল করবে আমি আগে বুঝি নি। লেবারের কষ্টের কিচ্ছু আমার মনে নেই, কিন্তু মানসিক কষ্টটুকু কাটিয়ে উঠতে পারছি না। মোহাম্মদের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না, বেচারা খুব বড় ধাক্কা খেয়েছে।

আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন। তিনি আমার ভালো ছাড়া খারাপ করেন নি কখনও, এবারও জানি আমার জন্য ভালোটাই করেছেন তিনি। কিন্তু তুমি যখন মা হবে, তখন হয়তো বুঝবে আমার ফীলিংসের কিছুটা... আমার আর মোহাম্মদের জন্য দোআ করো, এটা ছাড়া আর কিছুই চাওয়ার নেই আমার এখন…...'

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.