আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এনবিআর কর্মকর্তার বাড়তি আয় বছরে তিন লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা, কর্মচারীর ৫০ হাজার থেকে এক লাখ

সাহিত্যের কথা বলা হবে!!!

পুরস্কার দেওয়ার কথা কর আদায় ও কর ফাঁকি উদ্ঘাটনে বিশেষ অবদান রাখার জন্য। এ পুরস্কার প্রতিবছর পেয়ে যাচ্ছেন গাড়িচালক, নৈশ প্রহরী, এমনকি ঝাড়ুদারও। অথচ করসংক্রান্ত কাজে তাঁদের কোনো ভূমিকা নেই। পুরস্কারের জন্য তাঁদের একমাত্র যোগ্যতা_তাঁরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দুটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। এনবিআরের অন্য অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোয়ও এ ধরনের পুরস্কার প্রথা চালু থাকলেও সেগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে।

কিন্তু সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স সেল (সিআইসি) ও লার্জ ট্যাক্সপেয়ার্স ইউনিট (এলটিইউ) এনবিআরের এ দুটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে পুরস্কারের ব্যাপারে কোনো নীতিমালা নেই। প্রতিবছর বাজেটে পুরস্কার বাবদ যে টাকা বরাদ্দ করে সরকার, তার পুরোটাই ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে নেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে ঝাড়ুদার_বাদ পড়েন না কেউই। পুরস্কার প্রথা প্রবর্তনের পর থেকে এখন পর্যন্ত এ বাবদ বরাদ্দের একটি টাকাও ফেরত যাওয়ার নজির নেই। এনবিআরের ওই দুটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে এভাবে পুরস্কারের নামে প্রায় আড়াই কোটি টাকা হরিলুট হচ্ছে প্রতিবছর।

এতে বেতন-ভাতার বাইরেও একেকজন কর্মকর্তার বাড়তি আয় দাঁড়ায় বছরে তিন থেকে ২০ লাখ টাকা। কর্মচারীর বেলায় তা হয় ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। পুরস্কারের তালিকায় ঝাড়ুদার, নৈশ প্রহরী, গাড়িচালকসহ চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের নাম থাকায় এনবিআরের অন্য অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মাঝে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। কারণ, কর আদায় বা কর ফাঁকি উদ্ঘাটনে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কার্যত তেমন কোনো অসাধারণ ভূমিকা থাকে না। এ ছাড়া পুরস্কারসংক্রান্ত আদেশ আমলে না এনে কমিশনার পদমর্যাদার দুই প্রতিষ্ঠানের দুই প্রধানের নাম প্রতিবছর পুরস্কারের তালিকায় স্থান পাওয়ার বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

পুরস্কার বাবদ খরচ হওয়া অর্থের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে তা ফেরতযোগ্য বলে ইতিমধ্যে মন্তব্য করেছে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) অফিস। সিআইসি ও এলটিইউতে গণহারে পুরস্কার পাওয়ার রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ পুরস্কারের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। প্রয়োগ নেই এ-সংক্রান্ত আদেশের সংশ্লিষ্ট বিধিবিধানেরও। এমনকি পুরস্কারসহ যেকোনো সরকারি অর্থ ব্যয়ে নীতিমালা, বিধিমালা বা এ-সংক্রান্ত আদেশ অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক হলেও এ ক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না। ফলে নির্বিঘ্নে নিজেদের নাম নিজেরাই সুপারিশ করে নামমাত্র অনুমোদনের পর নির্বাহী আদেশে সবাই মিলে গণহারে পুরস্কৃত হচ্ছেন।

আরো জানা গেছে, এনবিআরের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান_কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগে একই ধরনের পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনের অধীনে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, বিধিমালা বা আদেশ মানা হয়। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল আহমেদ আতাউল হাকিম কালের কণ্ঠকে বলেন, পুরস্কার খাতসহ সরকারি যেকোনো অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা বাঞ্ছনীয়। নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন থাকতে হবে। আর সরকারি কোনো অর্থ খরচের ব্যাপারে বিধিমালা প্রণয়নের কথা যদি সংশ্লিষ্ট আইনে বলা থাকে, তাহলে অবশ্যই সেটা করেই অর্থ ব্যয় করা অত্যাবশ্যক। অন্যথায় সরকারি অর্থ ব্যয়ের আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা আবশ্যক। অন্যথায় অন্যান্যের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৪ সাল থেকে সিআইসি ও ২০০৭ সাল থেকে এলটিইউর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পুরস্কার প্রথা প্রবর্তন করা হয়। এ দুই অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের মূল কার্যক্রম দ্য ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিনেন্স ১৯৮৪-এর অধীনে পরিচালিত হয়। এ অধ্যাদেশে কর ফাঁকি উদ্ঘাটন ও কর আদায়ে বিশেষ অবদানের জন্য কর্মীদের পুরস্কার প্রদান করতে বিধিমালা প্রণয়নের কথা বলা আছে।

কিন্তু আজ পর্যন্ত এ বিধিমালা তৈরি হয়নি। তবুও কর বিভাগের সাধারণ পুরস্কার ঘোষণার সময় ১৯৮০ সালের দ্য ইনকাম ট্যাক্স (রিওয়ার্ড অর্ডার) অনুসরণ করা হয়। কিন্তু সিআইসি ও এলটিইউ কর্তৃপক্ষ তা অনুসরণ করে না। ১৯৮০ সালের আদেশ অনুসরণ না করার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, আদেশটি কার্যকর করা হলে বিধিমোতাবেক পুরস্কার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন কমিশনার পদবির কর্মকর্তারা। সে সঙ্গে একজন কর্মকর্তা এক বছরে তাঁর ২৪ মাসের মূল বেতনের বেশি অর্থ পুরস্কার হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন না।

সিআইসির মহাপরিচালক (ডিজি) ও এলটিইউ'র প্রধান দুজনই কমিশনার পদবির কর্মকর্তা। কোনো বছরই পুরস্কার পাওয়া থেকে বাদ পড়েননি এ দুজন। আর অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিবছর পুরস্কারের টাকা হিসেবে ২৪ মাসের মূল বেতনের বেশিই গ্রহণ করছেন বলে নথিপত্রে দেখা গেছে। এনবিআর চেয়ারম্যান ড. নাসিরউদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, পুরস্কার প্রদানে যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে, প্রয়োজনে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। এলটিইউ ও সিআইসির পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা প্রণয়ন না করা অথবা ১৯৮০ সালের আদেশ অনুসরণ না করার বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে বলেন, পুরস্কারসহ অন্যান্য বিষয় আরো সুনির্দিষ্ট ও যুগোপযোগী করতে বিধিবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এর খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছে। তবে এলটিইউ ও সিআইসিতে কমিশনার পদবির কর্মকর্তারা পুরস্কার পান বলে এক প্রশ্নের জবাবে স্বীকার করেন ড. নাসির। সিআইসির ডিজি মো. আলাউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, পুরস্কারের ব্যাপারে একটি নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর আলোকে আগামীতে পুরস্কার দেওয়া হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। তিনি জানান, বর্তমানে সিআইসি কর্তৃপক্ষ পুরস্কারের তালিকা তৈরি করে এনবিআরে পাঠায়।

এনবিআরের অনুমোদনের পর পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম চূড়ান্ত করা হয়। তিনি আরো জানান, ডিজিসহ সিআইসিতে কর্মরত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম (১৬-১৭ জন) পুরস্কারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এলটিইউ কমিশনার আবদুর রাজ্জাকও একই ধরনের তথ্য জানিয়ে বলেন, তিনিও মনে করেন, পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি বিধিমালা প্রণয়ন জরুরি। ঝাড়ুদার থেকে কমিশনার_সবাই পুরস্কার পান কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, টিমের সদস্য হিসেবে ৮০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সবাইকেই পুরস্কার দেওয়া হয়। ২০০৮-০৯ অর্থবছরের পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকা ঘেঁটে দেখা যায়, এলটিইউর তৎকালীন কর কমিশনার মো. আলাউদ্দিন পুরস্কার পেয়েছেন পাঁচ লাখ টাকা, ঝাড়ুদার মোহাম্মদ আলী পেয়েছেন ২০ হাজার, নৈশপ্রহরী মো. আমিনুল ইসলাম ২০ হাজার, চারজন ড্রাইভার_মো. আবদুল ওয়াহিদ ও মো. ফারুক আহমদ ২৪ হাজার টাকা করে, মো. শাহ আলম ২১ হাজার এবং মো. আবু হানিফ ২৩ হাজার টাকা পেয়েছেন।

আর ২০০৯-১০ অর্থবছরের এক আদেশে এলটিইউর কমিশনার মো. আলাউদ্দিন পেয়েছেন ছয় লাখ ৫০ হাজার টাকা, ঝাড়ুদার মোহাম্মদ আলী ১৬, নৈশপ্রহরী মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ১০ হাজার এবং ২২ হাজার টাকা করে পেয়েছেন চার জন ড্রাইভার_মো. আবদুল ওয়াহিদ, মো. ফারুক আহম্মদ, মো. শাহ আলম ও মো. আবু হানিফ। অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, গণহারে পুরস্কার দেওয়ার কারণে বেতন-ভাতার বাইরেও এলটিইউর একজন কর্মকর্তা বছরে তিন লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা ও একজন কর্মচারী গড়ে ৫০ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। আর সিআইসির একজন কর্মকর্তা বছরে ১৫ থেকে ২০ লাক টাকা ও একজন কর্মচারী গড়ে এক লাখ টাকা পুরস্কার বাবদ পেয়ে থাকেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে এক কোটি ৪০ লাখ ১৫ হাজার টাকা, ২০০৭-০৮-এ এক কোটি ৩০ লাখ, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে এক কোটি ২৭ লাখ ৮২ হাজার এবং ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে এক কোটি ৩০ লাখ টাকা সিআইসিতে পুরস্কার বাবদ খরচ করা হয়েছে। আর এলটিইউতে পুরস্কারের জন্য খরচ হয়েছে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৯৭ লাখ ৪০ হাজার, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৮৯ লাখ টাকা।

অর্থাৎ সিআইসি ও এলটিইউ_এ দুই প্রতিষ্ঠানে বছরে প্রায় আড়াই কোটি টাকা পুরস্কারের জন্য ব্যয় করা হয়। এ দিকে অর্থমন্ত্রণালয় ও এনবিআরের একাধিক সূত্র অভিযোগ করেছে, সিআইসিতে কর্মরতরা গোয়েন্দা কার্যক্রমে তেমন একটা প্রশিক্ষিত নন। তাই এখানে গোয়েন্দাবৃত্তি নেই বললেই চলে। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তারা প্রতিবেদন সংগ্রহ করে। আর্থিক দুর্নীতির গোয়েন্দা কাজ কিছুটা হলেও ফৌজদারিসংক্রান্ত গোয়েন্দাগিরি একেবারেই অনুপস্থিত।

অর্থাৎ কর ফাঁকি উদ্ঘাটনে কার্যত সিআইসির তেমন কিছুই করার নেই। অন্যদিকে এলটিইউতে প্রতিবছর যে কয়েক হাজার কোটি টাকার কর আদায় হচ্ছে, তার কারণ হলো ব্যাংক-বীমাসহ দেশের সব বড় করদাতাদের ফাইল সেখানে ন্যস্ত করা হয়েছে। এসব ফাইল থেকে অগ্রিম কর হিসেবে বড় অঙ্কের রাজস্ব এমনিতেই জমা হয়। তাছাড়া সিআইসি ও এলটিইউতে পদায়নের পর একজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী মনে মনে নিশ্চিত থাকেন, পুরস্কার হিসাবে বছরশেষে তাঁর জন্য আছে মোটা অঙ্কের টাকা। কাজেই কর আদায়ে বিশেষ অবদান রাখার জন্য তাঁদের তেমন একটা গরজ থাকে না।

সিএজি অফিসের সাম্প্রতিক এক নিরীক্ষা জিজ্ঞাসাপত্রে বলা হয়, 'শুল্ক (কাস্টমস), মূশক (ভ্যাট) ও আয়কর (ইনকামট্যাক্স) বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারী সমন্বয়ে সিআইসির সার্বিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ফলে সিআইসিতে কর্মরতদের পুরস্কার প্রদানের কোনো অবকাশ নেই। কারণ, শুল্ক, মূশক ও আয়কর বিভাগ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীন হলেও এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুরস্কার দেওয়ার জন্য পৃথক নীতিমালা রয়েছে। ফলে সিআইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পুরস্কারের অর্থ প্রাপ্য নন। ফলে এ সেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে অর্থ উত্তোলন করেছেন তা ফেরতযোগ্য।

' জানা গেছে, সিএজি অফিসের আপত্তির জবাবে সিআইসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের কর্মকর্তাদের পুরস্কার প্রদান সম্পূর্ণ আইনানুগ ও বৈধ। সুতরাং এ আপত্তি নিষ্পত্তিযোগ্য বলে মন্তব্য করেন সিআইসির ডিজি। বিষয়টি তিন মাস যাবৎ অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.