স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশ ছেড়ে বিদেশে অনেকে পাড়ি জমাতে শুরু করেন। সে সময়ে অধিকাংশই উচ্চ শিক্ষার জন্য যেতেন বিদেশে। উচ্চবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েরা-ই এ সময়ে দেশ ছেড়ে অন্যদেশে পাড়ি জমাতেন। তাদের অধিকাংশ ফিরেও আসতেন শেকড়ের টানে। গত শতাব্দীর আশির দশকে দেশত্যাগের একটা হিড়িক পড়ে যায়, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে যাবার হিড়িক।
মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল শ্রম-বাজারে প্রবেশের মাধ্যমে দেশে দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকের ব্যাপক কর্ম-সংস্হান ঘটতে থাকে। বিশাল এই শ্রম-বাজারকে ঘিরে রাতারাতি জন্ম হয় আদম ব্যাপারি নামক এক দুঃস্বপ্নের নায়কশ্রেণীর। এদের হাতে কতো মানুষ সর্বস্ব খুইয়েছে তা সকলেই কমবেশি অবগত আছেন। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এরা এখনও তাদের কুকর্ম সদর্পে চালিয়ে যাচ্ছে।
আমি একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করি।
সেই সুবাদে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে কাজ করার সুযোগ ঘটেছে আমার। বিগত জানুয়ারিতে আমি সৌদি আরবে কাজে যোগদান করেছি। যদিও এদেশে শুক্রবার সরকারি ছুটির দিন তবুও কোম্পানিটি আমায় সাপ্তাহে শনি-রবি দু’দিন ছুটি দেয়। বন্ধের দিনগুলোতে খুঁজে ফিরি, যদি কাউকে পেয়ে যাই 'বন্ধু কিংবা প্রিয় স্বজন!' এমনি পথ চলায় অনেকের সাথে মিতালি গড়ে উঠেছে, উঠছে। আমি এদের সাথে মিশতে গিয়ে এমন কতগুলো বিষয় খুঁজে পেয়েছি যা আমাকে খুবই মর্মাহত করেছে।
ঘুরে ফিরে সেই আদমব্যাপারি আর সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, এদেশে বাংলাদেশী দূতাবাসে কর্মরতদের অসহযোগিতা,সমন্বয়হীনতার ছবি-ই উঠে আসছে। সোনার হরিণ ধরার স্বপ্নে বিভোর একজন অদক্ষ শ্রমিক যখন আদমের পাল্লায় পড়ে তখন তাকে বোঝানো হয়, 'মিয়া সিটি কর্পোরেশন এর জব!
বাংলাদেশে কোনদিন দেখেছেন সিটি কর্পোরেশন এর লোক কাজ করে? ৬ ঘণ্টা ডিউটি, ওভার টাইম, মেডিক্যাল, বাসা..আর কি চান!'সহজ সরল লোকগুলো লোভে পড়ে সর্বস্ব বিক্রি করে টাকা তুলে দেয় আদম ব্যাপারির হাতে। ৫/৬ লাখ টাকা খরচ করে আসার প্রথম রাতেই তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়। তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নেয়া হয়। উল্লেখ্য, এখানে পাসপোর্ট নিয়োগকর্তার কাছে-ই থাকে।
শ্রমিককে যেটা দেয়া হয় সেটা হলো আবাসিক অনুমোদন। এদের ভাষায় 'আকামা'। গাদাগাদি করে যেখানে থাকতে দেয়া হয় সে স্হানও মানসম্মত নয়। তাদের আবাসিক অনুমোদন 'আকামা'র একটি ফটোকপি দেয়া হয় যাতে পালিয়ে কোথাও যেতে না পারে। অবাক হবার কিছু নেই, এটাই হয়ে থাকে।
নিয়োগকর্তা অত্যন্ত স্বচ্ছ। যা কিছু শর্তে ছিলো সবই দিয়ে থাকে। ভুলটা করি আমরা। তাই মেনে নেয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। প্রচণ্ড গরমে কিংবা অসহ্য শীতে হলুদ পোশাক পরা ঝাড়ু হাতে চারপাশে যাদের দেখি - বিশ্বাস করুন এরা সবাই বাঙালি।
মাস শেষে এরা যা বেতন পায় তা বাংলাদেশী টাকায় ৫ থেকে ৮ হাজারের বেশি নয়। স্বপ্ন ভঙ্গে এরা মুষড়ে পড়ে। ৫ লাখ টাকা দেনা। মাসে খাবার খরচ বাদ দিলে কত থাকে ! দেশে কি পাঠাবে! এরা তখন দলে দলে পালায় যাদের যাবার যায়গা নেই তারা দিনরাত কঠিন পরিশ্রম করে।
যারা পালালো তাদের বরণেও আমরা বাঙালিরা ।
নানান প্রলোভন দেখিয়ে যত রকমের অনৈতিক কাজে এদের লিপ্ত করা হয়। কাঁচা টাকা আসে। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার ঘ্রাণে এরা মাতাল। চুরি, ডাকাতি, হত্যা, ধর্ষণ, দেহ- ব্যবসা কোন্ কাজে বাঙালি নেই? বাঙালি জাতিকে কত খারাপ একটা জাতি হিসেবে এরা মনে করে তা দেখতে হলে একবার সৌদি আরব আসুন। আমি লজ্জায় ঘৃণায় রোজ কুঁকড়ে যাই।
২/১ টি ব্যাতিক্রম ছাড়া সকল নিয়োগকর্তা শ্রম আইন মেনে চলেন। কোথাও অনৈতিক কিছু এরা করে না। সরকারি কিংবা বেসরকারি পরিসংখ্যানে বলে, এদেশে ২৫ লাখ বাঙালি কর্মরত।
এ যাবত সৌদি আরব থেকে দেশে পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রাই সর্বোচ্চ স্হানে আছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত বর্তমানে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে অত্যন্ত ভালো অবস্হানে আছে।
এর অন্যতম কারণ হচ্ছে তারা অদক্ষ শ্রমিক প্রেরণকে নিরুৎসাহিত করে। তাদের বৈদেশিক-নীতি, পররাষ্ট্রনীতি অত্যন্ত জোরালো। ভারত, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য দেশগুলো অনেক আগে থেকে পেশাদার শ্রমিক, পেশাজীবী ডাক্তার, প্রকৌশলী, নার্স, করিগরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের পাঠানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে।
শ্রমবাজার ছাড়াও সৌদি আরবে রয়েছে বাংলাদেশী পণ্য - যেমন সিরামিক্স, গার্মেন্টস, হস্তশিল্প, চামড়াজাত পণ্য, পাটজাত পণ্যের বিশাল বাজার। এই বিশাল বাজার ভারত ও চীন দখল করে নিচ্ছে।
সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের শীতল সম্পর্কের সূচণা হয় বিগত তত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে। যা এখনও কাটেনি। ফলশ্রুতিতে এখানে কর্মরত বাংগালীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের আপাততঃ কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা গ্রহনের পর সৌদি আরবে সফর করে গেছেন। তখন অনেক আশার কথা শোনা যাচ্ছিল।
বাস্তবে শ্রমিক সমস্যার কোন সমাধান না হলেও হয়রানি বন্ধ করেছে এদেশের সরকার। যেহেতু দৃষ্টি ভঙ্গী একদিনে বদলানো সম্ভব নয় তাই বাংগালী “আলী বাবা”হেন-তেন খোঁচা গুলো মুখ বন্ধ করে সইতে হচ্ছে। এছাড়াও নিয়োগকর্তার কাছ থেকে কোন বাংগালী তার চাকুরী পরিবর্তনের সুযোগ পাচ্ছেনা। অনেক ক্ষেত্রে নিয়োগ কর্তা সেই সুযোগটির অপব্যবহার করছে। ফলশ্রুতিতে ভাল বেতনে অন্যত্র কাজ করার সম্ভাবনা থাকলেও সুযোগটা হাত ছাড়া হচ্ছে।
দেশ হারাচ্ছ বৈদিশিক মূদ্রা।
বৈধ ভাবে থাকার মেয়াদ উর্ত্তীর্ণ বা ইতিমধ্যে অবৈধ হয়ে যাওয়া,পালিয়ে আসার সংখ্যাও কয়েক লাখ। এরা অনেকে বাড়ী ফিরে যেতে চায়। কিন্তু তারা জানেনা কি করে ফিরবে। দূতাবাসের কর্মরতদের কাছে হয়ত এর ব্যখ্যা আছে।
আমি আজ পর্যন্ত শুনিনি এসব অসহায়দের জন্য কেউ কথা বলেছে। নির্বাচিত এবং গণতানত্রিক এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রবাসীরা অধীর প্রতিক্ষা নিয়ে দিন গুনছে। আশায় বুক বেধে আছে। সরকারের সময়োপযোগী হস্তক্ষেপে দুইটি ভাতৃ প্রতিম দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। নতুন কর্ম সংস্হানের সুযোগ ঘটবে এমনটি ই আজকের প্রত্যাশা।
লেখক : আশির দশকের ছাত্রনেতা, সাংস্কৃতিক কর্মী। সৌদি আরবে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।