আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার ‘গায়ক’ হওয়ার দিনরাত্রি



আমার গান গুলো যারা শুনেছেন, সেই সব শ্রোতাদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। আপনাদের ভালবাসা উতসাহে আজ আমি এতদূর আসতে পেরেছি। সেই অকৃত্তিম ভালবাসাই আমাকে এই সফলতা দিয়েছে। আজ আমাকে গায়ক হিসেবে চিনতে পেরেছে। আরও গান শুনার জন্য শ্রোতা রিকোয়েস্ট করছে।

মহান আল্লাহর কাছে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। প্রতিটি সফলতার পিছনে থাকে কিছু কষ্ট, কিছু বেদনার ইতিহাস। সে রকম কিছু কষ্ট ও বেদনার কথাই বলবো আপনাদের। সেই সাথে আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষের মধ্যে এক অসীম সম্ভাবনার বীজ বুনে দিয়েছে। আমাদের উচিত তাকে পরম যত্নে, মমতায় বড় করা।

নিজেকে সফল করা। সফল ব্যক্তির পথ কুসুমাস্তির্ণ নয়। তাকে অনেক বাধা ডেঙ্গুতে হয়। গঞ্জনা সইতে হয়। কলেজ জীবনের ঘটনা।

স্কাউটিং দলের সদস্য। তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর গানটি কোরাস গাইতে হবে। আমাদের রসায়ন স্যারের তত্বাবধানে ফাইনাল মহড়ার দিন, মুল ভোকাল গান শুরু করেছে। আমরা কোরাস করছি। মাঝপথে স্যার হাত তুললেন।

আমরা সবাই চুপ। কি ব্যাপার? স্যার আবার গান শরু করতে বললেন, আবার করলাম, সেই একই অবস্থা কোরাস অংশে গিয়ে থামিয়ে দেয়া। কার কন্ঠ যেন চিকন (বেসুরা)। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে প্রমান হলো আমার কন্ঠই চিকন। গানের সাথে যায় না।

আমাকে গানের গ্রুপ থেকে বাদ দেয়া হলো। এবার শুরু হলো ভরাট কণ্ঠ তৈরী করার কাজ। কুলি করা, গরম জলে গড়গড়া দেয়া, জৈষ্ঠ মধু চিবানো, লবন আদায় এক মহা চেষ্টা। এসময় বন্ধু ফেরদেৌস এগিয়ে এলেন, জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষ্যে তার বাড়িতে রাত্রিবেলা গানের প্রাক্টিসের দাওয়াত দিলেন। আমি মাসুদ, মিজান, তানভীর ভাই এরকম আরো কিছু লোক সন্ধ্যার পরে সুগন্ধা নদী পেরিয়ে অপর পাড়ে ফেরদৌসের বাড়িতে যাই।

ফেরদেৌস জাতীয় স্বর্ণপদক প্রাপ্ত শিল্পি। রেডিওতে গান করেন। কেউ কেউ মিস করলেও আমি প্রায়ই থাকতাম। আমাকে যে গায়ক হতে হবে! ফেরদৌস ভাল নামকরা গায়ক হতে পারে। কিন্তু সে রতন চেনেনা।

কয়দিন পরই সোজাসাপটা বলে দিল আমার দ্বারা নাকি গান সম্ভব নয়। কোন সুরই নাকি আমার গলায় নাই। না পল্লী, না ভাটি, না রক না পপ। রবীন্দ্র, নজরুল, লালন হাচন কোনাটাই আমার দ্বারা সম্ভব নয়। সে পরামর্শ দিল আমি যেনে আবৃত্তি, বক্তৃতা নিয়েই থাকি।

এ পথে হেটে লাভ নেই। এক্ষেত্রে মিজান কিছুটা নমনীয়। জোতস্না রাতে আমরা দুজনে পথে হাটতাম। মিজান ভালো রবীন্দ্র জানে। ওর চেহারায় যেমন মায়া কন্ঠেও তার কিছুটা ছাপ।

ও গাইতো, আমারো পরানো যাহা চায়, ও আমার দেশের মাটি, যখন পরবেনা মোর পায়ের চিহ্ন। ওর কণ্ঠে শুনে শুনে গানগুলো মুখস্ত করে ফেলি। আবার ওর উতসাহেই গাই। ২/১ চরন পরে বলে এইতো দারুন হচ্ছে। আসলে প্রাক্টিস করলে আরো ভালো করতে পারবি।

বন্ধু মাসুদ আমার চেয়ে ভাল গান করে। নচিকেতার দারুন ভক্ত। ছেলে আমার মস্তবড় মস্ত অফিসার, ওর কন্ঠে এক রাতে এ গানটি শুনে রিহাবের আব্বু আম্মু কেদে দিয়েছিলো। ও আর আমি গান করি। নচিকেতার গান।

যখন সময় থমকে দাড়ায়, আমি এক ফেরীওয়ালা ভাই, ২০১ ধর্মতলা, রাজশ্রি। মুলত ও গায়, আমি লয় ধরি। মাঝে মাঝে কবিতার মত বলি। একসাথে ফেরদেৌসের বাড়িতে যাই, কলেজে তানভীর ভাইএর সাথে কফি হাউজের সেই আড্ডাটায় আড্ডা দেই। আর গায়ক হওয়ার চেষ্টায় নিজেকে রপ্ত করি।

২০০১ এর নির্বাচনের আগে প্রশিকা আমাদের নাট্যসংস্থায় কিছু ইনস্ট্রুমেন্ট, কিছু টাকা পয়সা দেয়। পরোক্ষভাবে বিএনপি জামাতের বিরুদ্ধে প্রচারণার জন্য। আমরা নাটিকা করি, কিছু প্যারোডি গান করি। নির্বাচনের আগে আগে সেই গানগুলো গ্রামের হাট বাজার স্কুল কলেজগুলোতে গিয়ে গাই। আমি সেই দলের সদস্য।

প্রতিদিন প্রাক্টিসে যাই। তবলাবাদক শাহীন এর কাছ থেকে তবলা শিখি। ফেরদেৌস এর কাছ থেকে হারমোনিয়াম শিখি। হিমুর কাছ থেকে বাশি। আমি যে টুকু পারি তার চেয়ে উতসাহ বেশী।

আমার সারেগামা শুনে সবাই মুখ চেপে হাসে। তবলা বাজানো দেখে বাহাবা দেয়, বাশি বাজানো শুনে কোন গানের সুর তা নতে চায়! এমএমসিতে যখন কাজ করি তখন প্রায়দিনই কিছু না কিছু করতে হতো। গল্প বলা, আবৃ্ত্তি, অভিনয়, গান। ১ম দিন গানের অনুরোধ এসেছিল, বন্ধু মাসুদ কি মনে করে বলল না ও কবিতা বলুক!!!!! হায়রে বন্ধু!!! এমএমসির শেষের দিকে একটি গান গেয়েছিলাম, আমি আর বরিশালের বাবলু, শবনাজ নাইমের গরম জুটি-এখন আর চলেনা তেমন, সাব্বিরের ঠ্যাং ভাইংগা দিলে দেশের সুনাম বাড়বে না। এ গানে যুগান্তরের বেলায়েত হোসেন বাবলুর সুনাম বাড়লেও আমারটা যে বাড়েনি তা নিজেই বুঝতে পারি।

সবার যখন এত অসহযোগিতা, সিদ্ধান্ত নিলাম। গান ছেড়ে দিব। এবং সত্যি সত্যি গায়ক হওয়ার আশা ছেড়ে দিলাম। আগে যে করেো সাথে সুর মিলাতাম, সেটা বন্ধ করেছি। তবে গুনগুনানি বন্ধ হয়নি।

বাথরুমেরটাও ছাড়তে পারেনি। এরকম করেই চলে আসছিল বাকি সময়টুকু। যারা কষ্ট করে এ পর্যন্ত পড়েছেন তারা এতক্ষনে বিরক্ত হয়েছেন। এর পরেও কি করে গায়ক হয়েছি? নিশ্চয় চাপাবাজি করছি। গুল মারছি।

না, যদি বিশ্বাস না হয় তা হলে আপনাকে আমি একটা ঠিকানা দিতে পারি, সে ঠিকানায় গিয়ে আপনি যাচাই করতে পারেন আমি সত্যিই একজন গায়ক হয়েছি কিনা। তার আগে ঘটনাটি শুনুন। মোবাইল যুগে মেয়েদের সাথে কথা বলা কোন ব্যাপারই না। সে রকম এক মেয়ের সাথে কিছুদিন ধরে কথা হচ্ছে। একথা ও কথা বহু কথা।

রাত যত বেশি হয় কথা তত বাড়তে থাকে। একসময় গানের কথা ওঠে, ও প্রান্ত থেকে গান শুনানো হয়, ভিতর বলে আসো তুমি বাহির বলে, পৃথিবীর যত সুখ, মনকাদে সারা বেলা, বৃষ্টি ঝড়ে যায় . . . . আমাকে প্রতিদিন রিকোয়েস্ট করে। আমি না বলি। কিন্তু তার পীড়াপীড়িতে, অভিমান ভাঙাতে একটা গান গাইলাম, মৌসুমি ভৌমিকের গান, আমি শুনেছি সে দিন তুমি, সাগরের তীর ধরে বহুদুর বহুদুর হেটে এসেছো, আমি কখনো যাইনি জলে, কখনো ভাসিনি নীলে, কখনো রাখিনি চোখ ডানা মেলা গাং চিলে, আবার যেদিন তুমি সমুদ্র স্নানে যাবে আমাকেও সাথে নিও, নেবে তো আমায়। আমি গাইলাম সত্যিকারের অর্থেই চেষ্টা করেছি ভাল করে গাওয়ার।

অন্তত মান ইজ্জতটুকু যেন বাচে। গান শেষ হলো। ভয় চুপ মেরে আছি। ও কি বলে, কি মন্তব্য করে! পাঠক, আপনাদের দু:খের কথা শুনিয়েছি, এবার শুনুন সে চরম মুহুর্তটুকুর কথা, যেন আমি নিজেকেই বিশ্সাস করতে পারিনা। নাকি স্বপ্ন দেখছি! ও পাশ থেকে মিহি মায়বী শব্দে আমাকে বলে চলে, অসাধারণ, অসাধারণ! তুমি কেন এতদিন মিথ্যা বলেছো।

তুমি এতসুন্দর গান করো! এত সুন্দর! এই প্রথম, গায়ক হিসাবে আমার স্বীকৃতি। এই প্রথম কেউ আমাকে বললো, প্লিজ আর একটা গান করুন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.