গতকাল চলে গেলেন বহুমাত্রিক সাহিত্য প্রতিভা আবদুল মান্নান সৈয়দ। বয়স হয়েছিলো ৬৭ বছর। ১৯৪৩ সালের ৩ আগস্ট জন্মেছিলেন পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলায়। দেশ ভাগের ডামাডোলে তাঁর পরিবার চলে আসে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে। এক সময় ৫১ গ্রীণ রোডে তাঁর পিতা বাড়ী করেন।
এখানেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কেটেছে তাঁর।
পড়া শোনা করেছেন নবাবপুর সরকারী হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স আর মাস্টার্স করে অধ্যাপনায় যোগ দেন। জীবনের বেশির ভাগ অধ্যাপনা করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে।
ঘটনাক্রমে তাঁর সাথে আমার দেখা হয় নোয়াখালীতে। ১৯৮৪ সালে তাঁকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দিয়ে নোয়াখালী সরকারী মহিলা কলেজে বদলী করা হয়।
আদেশে বলা ছিলো বদলীকৃত পদে যোগদান না করলে পদোন্নতি কার্যকর হবে না। মাউশি'র দোর্দন্ডপ্রতাপ কর্তারা তাঁকে ওখানে যেতে বাধ্য করলেন। আমার এক আত্মীয়া তখন ডিগ্রীর ছাত্রী ছিলেন ওই কলেজে। ঘটনাক্রমে তার সাথে দেখা হলে বললেন, তাদের একজন নতুন অধ্যাপক এসেছেন। অনেক বড়ো সাহিত্যিক।
নাম জানতে চাইলে তিনি যখন আবদুল মান্নান সৈয়দের নাম বললেন আমি চমকে উঠলাম। তাঁকে নোয়াখালী পাঠিয়েছে জেনে অবাক হলাম। জানলাম তিনি কলেজের একটা কক্ষে আছেন।
ওখান থেকে বেরিয়ে এক বড়ো ভাইয়ের কাছে ছুটলাম খবরটা দিতে। তারপর দুইজন মিলে ছুটলাম মহিলা কলেজের দিকে।
ওখানে গেটে পিয়নকে পেয়ে বললাম নতুন অধ্যাপক আবদুল মান্নান সৈয়দ কোথায় আছেন ? তাঁর সাথে আমরা দেখা করবো। তিনি যে আমাদের পেছনে রাস্তার অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন উত্তেজনার বশে সেটা খেয়াল করিনি। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, আমি আবদুল মান্নান সৈয়দ। কিন্তু আপনাদেরকে আমি চিনতে পারছি না। আমাকে কেন খুঁজছেন ?
আমরা তখন পরিচয় দিয়ে বললাম, আমরা আপনার লেখার অনুরক্ত পাঠক।
আপনি এখানে এসেছেন জেনে দেখা করতে এসেছি। তিনি খুব খুশী হলেন। কলেজের মাঠে বসে অনেক সময় ধরে তাঁর সাথে নানা বিষয়ে কথা হলো। কথা বলতে বলতে হাঁটলাম অনেক পথ। রেস্টুরেন্টে বসে চা খেলাম।
জানলাম এখানে এসে কথা বলার লোকও পাচ্ছেন না। আমাদের পেয়ে ভালো লাগছে। এটা শুনে আমরাও পেয়ে বসলাম। বলরাম অনুমতি দিলে আমরা প্রতি বিকালে তাঁর সাথে এভাবে গল্প করতে চাই। তিনি সায় দিলেন।
মনে হলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
আমরা প্রতিদিনই গেছি। তবে ১০/১৫ দিনের মধ্যে তিনি বদলী হয়ে জগন্নআথে চলে আসেন। তাঁর সাথের সেই স্মৃতি বার বার মনে পড়ছে আমার। ঢাকায় দু'একবার দেখা হয়েছে।
ব্যস্ততা দেখে আগাইনি।
মান্নান সৈয়দ জানালেন তিনি কলকাতায় ড. ক্ষেত্র গুপ্ত'র অধীনে পিএইচডি থিসিস শেষ করে জমা দিয়ে এসেছেন। নামের সাথে এই ডিগ্রী লাগাতে দেখিনি। তাঁর সেই প্রচেষ্টা কী তবে অসফল হয়েছিলো ? জানি না।
তিনি আমাকে আকৃষ্ট করেছেন ভিন্ন ধর্মী লেখার জন্য।
ষাটের দশকে এদেশে যে নতুন ধারার সাহিত্য আন্দোলন দানা বেঁধেছিলো তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত কণ্ঠস্বরের একজন নিয়মিত লেখক ছিলেন তিনি। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, সমালোচনা সাহিত্য, গবেষণা, সাহিত্য-সম্পাদনা নানা বিষয়ে ছিলো তাঁর সদর্প পদচারনা। বাংলা কবিতায় পরাবাস্তবতার চর্চা তাঁর বড়ো অবদান। ''কবিতা কোম্পানী প্রাইভেট লিমিটেড'' এবং ''পরাবাস্তব কবিতা'' তাঁর এ ধারার বড়ো কাজ।
অন্যান্য কাব্যের মধ্যে রয়েছে ''জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ'', ''জোছনা রৌদ্রের চিকিৎসা'', পার্ক স্ট্রীটে এক রাত্রি'' ''সত্যের মতো বদমাশ'' তাঁর ভিন্নধর্মী গল্পের বই। লিখেছেন ১০টি উপন্যাস। এর মধ্যে আছে ''পরিপ্রেক্ষিতের দাসদাসী"', ''কলকাতা'' পোড়ামাটির কাজ'' ইত্যাদি।
সমালোচনা সাহিত্যে তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজ ( আমার বিবেচনায়) ''শুদ্ধতম কবি"" জীবনানন্দ দাশের কবিতার ওপল দুই বাংলা মিলিয়ে এটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ। জীবনানন্দকে নিয়ে তিনি বহু কাজ করেছেন।
জীবনানন্দের প্রবন্ধ, কবিতা সমগ্র, পত্রাবলী ইত্যাদি সম্পাদনা করেছেন তিনি। এই কাজে প্রচুর শ্রম দিয়েছেন। বহু লেখকের জীবন ও সাহিত্য অমানুষিক শ্রমের মাধ্যমে তিনি সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে কালের গর্ভে হারিয়ে যাবার হাত থেকে রক্ষা করেছেন।
জীবনানন্দ দাশ ছাড়া প্রচুর কাজ করেছেন নজরুলের ওপরও। দুই বছর তিনি নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালকও ছিলেন।
আর যাদের জীবন ও সাহিত্য সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন তাঁরা হলেন সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ, আব্বাস উদ্দিন আহমদ, বেগম রোকেয়া, শাহাদাত হোসেন, ফররুখ আহমদ, আবদুল গনি হাজারী, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী প্রমুখ। প্রেমেন্দ্র মিত্র. বুদ্ধদেব বসু, যতীন্দ্রমোহন বাগচী প্রমুখের কবিতা জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের কথাসহিত্য সম্পাদনা করেছেন।
প্রকৃত পক্ষে তাঁর মতো নিরন্তর পরিশ্রমী গবেষক এই যুগে বিরল।
বাংলা সাহিত্যে তাঁর এই সব সোনালী ফসল চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হবে। ভবিষ্যতের সাহিত্যিক, গবেষককে বার তাঁর বইয়ের দ্বারস্থ হতে হবে এটা আমি নিশ্চিত।
তিনি প্রচুর শব্দ নিজে তৈরী করে বাংলা শব্দ ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯৭৪ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় এক স্বাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তাঁর তৈরী শব্দ নিয়ে একটা অভিধান প্রণয়ন করবেন। তাঁর সেই পরিকল্পনা পরে বোধ করি আলোর মুখ দেখেনি।
সাহিত্যের এই নিরলস কর্মীকে শ্রদ্ধা জানাই। আল্লাহ তাঁর আত্মাকে চিরশান্তিতে রাখুন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।